ভ্যাকসিন সংকটে মিলছে না লাম্পি স্কিন রোগের চিকিৎসা

83

রংপুর জেলায় দিন দিন বাড়ছে গরুর লাম্পি স্কিন রোগের প্রাদুর্ভাব। ইতোমধ্যে আট উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগ। এতে গরুর মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে বাড়ছে খামারিদের চিকিৎসা ব্যয়।

গত এক মাসে জেলায় পাঁচ শতাধিক গরুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন খামারিরা। এর মধ্যে কেবল বদরগঞ্জ উপজেলাতেই মারা গেছে তিন শতাধিক গরু। এই উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের খামারপাড়া গ্রামে এর সংখ্যা প্রায় অর্ধশত।

এদিকে লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত গরুর চিকিৎসায় সহসাই মিলছে না ভ্যাকসিন। উপজেলা পর্যায়ে ভ্যাকসিনের মজুত হ্রাস পাওয়ায় খামারিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্থানীয় পল্লি চিকিৎসকরা ভ্যাকসিনের নামে বিভিন্ন ইনজেকশন পুশ করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আর ভ্যাকসিন শূন্যতায় অনেক উপজেলায় প্রাণিসম্পদ কার্যালয়গুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে রয়েছে।

জানা গেছে, লাম্পি স্কিনের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি বদরগঞ্জ উপজেলায়। গত এক মাসে উপজেলার দক্ষিণ খামারপাড়া গ্রামের রাজ্জাক ও মহেবুল এবং ঠনঠনিয়াপাড়া গ্রামের রজব আলীর ও ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের আব্দুল আহারের দুটি করে গরু মারা গেছে লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হয়ে। এছাড়া দক্ষিণ খামারপাড়া গ্রামের জালাল উদ্দিন, ডাক্তারপাড়া গ্রামের টিপু ও কবিরাজপাড়া গ্রামের আক্তার হোসেনের গরু মারা গেছে তিনটি করে। এই উপজেলার অন্তত আরও ৫০ জনের কমপক্ষে একটি করে গরু মারা গেছে। খামারিদের দাবি, সব মিলিয়ে উপজেলয় অন্তত ৩০০ গরু লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। আক্রান্ত আছে আরও শতাধিক।

গত সোমবার (১০ জুলাই) দুপুর ১২টার দিকে বদরগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয়ে অন্তত ১৫টি গরুকে দেখা যায় যেগুলোকে লাম্পি স্কিন রোগের চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়েছিল। কার্যালয়ের ভেটেরিনারি সার্জন ডা. আবু মুছা একা সেগুলোকে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। সেখানে চিকিৎসার জন্য অপেক্ষমাণ অবস্থাতেই একটি গরুর মৃত্যু হয়। ওই সময় উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আজমল হুদা তপন উপজেলার মাসিক সমন্বয় সভায় যোগ দিতে ইউএনও কার্যালয়ে ছিলেন।

জানতে চাইলে ডা. আবু মুছা বলেন, ‘আমার কার্যালয়ে প্রতিদিনই ল্যাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত ১৫-২০টি করে গরু আসছে। এগুলোকে একা একা চিকিৎসা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। বাইরে গিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ নেই।’

গত বুধবার (‌১২ জুলাই) দুপুরে রংপুর প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের সামনেও লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত গরু নিয়ে উপস্থিত থাকতে দেখা গেল খামারিদের। নবদীগঞ্জ এলাকার কল্যাণী ইউনিয়নের লোকমান মিয়া ভ্যানে করে তার একটি গরু নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানে। সামনে আরও তিন-চারটি ভ্যানে ছিল আরও কয়েকটি গরু।

জানতে চাইলে লোকমান মিয়া বলেন, ‘গরু-বাছুর কিছু খাওছে (খাচ্ছে) না। পুরা শরীরে গুটির মতো উঠছে। গ্রামোত ১০ দিন চিকিৎসা করনু (করলাম), কমিল না। হাসপাতালোত আলছু (এসেছি)। এই রোগে হামার ওটে (আমাদের ওখানে) গরু মরি গেইছে। গরুটা নিয়া খুব চিন্তায় আছু।’

মিঠাপুকুরেও লাম্পি স্কিন রোগে অর্ধশত গরুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ১৭টি ইউনিয়নের প্রায় সব জায়গায় এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সামনে গিয়ে দেখা যায়, অটোরিকশা ও ভ্যানে করে আক্রান্ত গরু নিয়ে চিকিৎসার জন্য এসেছেন লোকজন।

লতিবপুর গ্রামের অর্জুন রায় জানান, তার বাড়ির পাঁচটি গরু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। চিথলী উত্তরপাড়ার মমিন মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, খুব দ্রুত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। চিকিৎসা দিয়েও কাজ হচ্ছে না।

রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রংপুরের আট উপজেলায় ছোট-বড় গরুর খামার রয়েছে ১ হাজার ৬৬৮টি। গৃহপালিত গরু রয়েছে আরও প্রায় ১০ লাখ। জেলা-উপজেলার হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন গড়ে দেড় শতাধিক লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত গরুর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ বছর ছোট বকনা বাছুরগুলোতে এ রোগের প্রকোপ বেশি।

জেলা ভেটেরিনারি সার্জন ডা. বলরাম কুমার বলেন, এ বছর গরুর বাছুরে ল্যাম্পি স্কিন রোগের প্রকোপ বেশি। প্রতিদিন জেলা প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে এ রোগে আক্রান্ত গরু আসছে গড়ে ৩০টি। একা চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে লাম্পি স্কিন রোগ হয়। পল্লি চিকিৎসকরা একই সিরিঞ্জ একাধিক গরুতে ব্যবহার করায় এ রোগ বেশি ছড়াচ্ছে। রক্তচোষা মাছি-মশা, আঁটালি তো আছেই। তাছাড়া পল্লি চিকিৎসক ও খামারিরা নিজেরাই অ্যান্টিবায়োটিক ও পেইন কিলার গরুকে খাওয়াচ্ছেন, যা সম্পূর্ণ ভুল চিকিৎসা। এভাবে গরু বাঁচানো যাবে না।

রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সিরাজুল ইসলাম বলেন, লাম্পি স্কিন রোগে গরু আক্রান্ত হচ্ছে। তবে আট উপজেলায় গরু মারা যাওয়ার তেমন কোনো তথ্য নেই।

বদরগঞ্জে তিন শতাধিক গরু মারা যাওয়ার তথ্যকে তিনি ভুয়া বলে দাবি করেন। ওই উপজেলায় পাঁচটি গরু মারা গেছে, এমন তথ্য দেওয়ার চ্যালেঞ্জ জানান তিনি। পরে বদরগঞ্জ উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার হিসাবেই অন্তত ৫০টি গরুর মৃত্যুর তথ্য জানালে ডা. সিরাজুল বলেন, তিনি (উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা) তো আমাকে একটি গরুর মৃত্যুর তথ্যও দেননি। বিষয়টি আমি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।