মুখ থুবড়ে পড়েছে তাঁতশিল্প

345

গত কয়েক বছরের ব্যবধানে তাঁতজাত পণ্যের উপকরণের দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধির কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে কুষ্টিয়ার কুমারখালী তাঁতশিল্প। এই শিল্পের প্রধান উপকরণ রং, সুতা ও কেমিক্যালের দাম বৃদ্ধিতে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কারখানা। ফলে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁতশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

২০২০ সালের আগেও কুষ্টিয়ার কুমারখালী পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের কারিগরপাড়া হস্তচালিত তাঁতের খটখট শব্দে মুখর থাকত। সেখানে প্রায় ৭০-৮০টি পরিবারের প্রধান পেশা ছিল তাঁত ও তাঁতজাত পণ্য। তবে গত কয়েক বছরের ব্যবধানে সেখানকার প্রেক্ষাপটে ব্যাপক রদবদল ঘটেছে। বর্তমানে সেখানে তাঁতি পরিবারের সংখ্যা মাত্র আট থেকে ১০টি।

জানা গেছে, প্রায় ১৫০ বছর আগে কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর কূলঘেঁষে ১৮৬৯ সালে গড়ে ওঠে কুমারখালী পৌরসভা। তখন থেকেই ঐতিহ্য ছড়াচ্ছে এখানকার তাঁতশিল্প। সর্বশেষ তাঁতি ও তাঁত জরিপ ২০১৯ সাল অনুযায়ী, উপজেলায় তাঁত ও তাঁতির সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। তবে করোনাভাইরাস, রং-সুতার দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে গত তিন বছরে তাঁতিদের সংখ্যা কমেছে প্রায় দুই হাজারের বেশি। সপ্তাহের প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার উপজেলার শেরকান্দি এলাকায় বসে বড় লুঙ্গির হাট। এ হাটের অধিকাংশ মানুষই কুমারখালী ও খোকসা এলাকার। স্থানীয় মানুষই এখানে বেশি। তবে অনেক দূরদূরান্ত থেকেও লোক আসে এখানে ব্যবসা করতে। তাছাড়া ক্রেতারাও আসে দূরদুরান্ত থেকে। তাদের ভিড়ও বেশ। নিজেদের পছন্দমতো ও চাহিদা অনুযায়ী তারা কেনাকাটা করতে পারে। প্রতিহাটে কয়েক কোটি টাকা বিক্রি হয়।

স্থানীয় কারিগরপাড়ার বাসিন্দারা জানান, মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে গত কয়েক বছরে তাঁতজাত পণ্যের উপকরণ সুতা, রং ও কেমিক্যালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু সেই তুলনায় লুঙ্গি-গামছার দাম বাড়েনি। সেজন্য লোকসানের পর লোকসান গুনতে গুনতে পুঁজি হারিয়েছেন তাঁতিরা। জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে অনেকেই পেশা বদল করেছেন। কেউ কেউ আবার যান্ত্রিক তাঁতে (পাওয়ার লুম) মহাজনের অর্ডারের কাজ করেন।

তাঁতিদের ভাষ্যমতে, হয় উপকরণের দাম কমানো হোক, না হলে পণ্যের দাম বৃদ্ধি করা হোক। তা না হলে ঐতিহ্য হারাবে তাঁতশিল্প। বিলুপ্তি হবে তাঁত ও তাঁতি।

সরেজমিনে দেখা যায়, কারিগরপাড়ার ষাটোর্ধ্ব মো. আতিয়ার রহমান। বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হস্তচালিত তাঁতে রঙিন গামছা তৈরির কাজ করছেন। পাশে তার স্ত্রী হাতচরকার মাধ্যমে বোবিনে সুতা পেঁচাচ্ছেন।

এসময় আতিয়ার রহমান বলেন, রং ও সুতার দাম দ্বিগুণ বৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু লুঙ্গি-গামছার দাম তেমন বাড়েনি। সেজন্য এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছে মানুষ। তার অন্য কাজের অভ্যাস নেই। তাই পৈতৃক পেশা টিকিয়ে রেখে কোনোমতে জীবন চালাচ্ছেন।

তার স্ত্রী আয়েশা খাতুন বলেন, তিনি প্রায় ৪০ বছর ধরে হাতচরকার কাজ করছেন। লুঙ্গির দাম কম হওয়ায় করোনাকালে তাদের ব্যাপক লোকসান হয়েছে। পুঁজি কম থাকায় এখন লুঙ্গি ছেড়ে তার স্বামী গামছার কাজ করছেন।

একই এলাকার য্বুক আসাদুল ইসলাম বলেন, কয়েক বছর আগে ঘরে ঘরে তাঁত ছিল। তার বাড়িতেও দুটি তাঁত ছিল। কিন্তু লোকসানের পর লোকসান হওয়ায় সেগুলো বিক্রি করে দেনা শোধ করার পর এখন ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

জানা গেছে, কয়েক বছর আগেও কুমারখালী উপজেলার যদুবয়রা ইউনিয়নের যদুবয়রা পুরাতন বাজার ও স্কুলপাড়ায় শতাধিক তাঁতি পরিবার ছিল। খুব সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হস্তচালিত তাঁতের খটখট শব্দ শোনা যেত। যদুবয়রা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, তাঁতের সেই পুরোনো খটখট শব্দ নেই। হাতেগোনা কয়েকটি পরিবার যান্ত্রিক তাঁতে মহাজনের অর্ডারের লুঙ্গি তৈরি করছেন।

এসময় তাঁতি জাহিদুর রহমান বলেন, উপকরণের দাম দ্বিগুণ বেড়েছে। আর সেই তুলনায় প্রতিটি লুঙ্গির দাম বেড়েছে মাত্র ১০ থেকে ১৫ টাকা। বর্তমানে তিনি এক মহাজনের অর্ডারের লুঙ্গি তৈরি করেন। প্রতিটিতে ৩০ টাকা মজুরি পান তিনি। প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় হয় তার।

একই এলাকার তাঁতি মো. আইয়ুব আলী জানান, করোনার আগের তিন হাজার টাকা কেজির সুতার দাম এখন প্রায় ছয় হাজার টাকা। প্রতি পাউন্ডে সুতার দাম বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকা। তিনি অভাবে তাঁত বিক্রি করে এখন একটি এনজিওতে চাকরি করছেন।

কুমারখালী শেরকান্দি কাপুড়িয়া হাটের ব্যবসায়ী মো. তারেক বলেন, মঙ্গলবারে হাটে মান ও আকারভেদে প্রতিটি গ্রে লুঙ্গি বিক্রি হয়েছে ১৭৫ থেকে ২২৫ টাকায়, যা গত হাটের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা কম।

কুমারখালী মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও রং-সুতার ব্যবসায়ী মো. আবদুল কাইয়ুম জানান, ৪০ কাউন্টের প্রতি পাউন্ড সুতা ১৭৫ টাকা, ৫০ কাউন্টের প্রতি পাউন্ড সুতা ২০০ টাকা এবং ৬০ কাউন্টের প্রতি পাউন্ড সুতা বিক্রি হচ্ছে ২৩০ টাকায়। বর্তমান মূল্যের চেয়ে ২০২০ সালের আগে ৫০ থেকে ৭০ টাকা কম ছিল। করোনার আগে প্রতি কেজি রং বিক্রি হতো প্রায় তিন হাজার টাকা, যা কয়েক দফা বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ছয় হাজার টাকায়।

তার ভাষ্যমতে, রং ও সুতার দাম বৃদ্ধির ফলে প্রকৃত তাঁত ও তাঁতি বিলুপ্তির পথে। অনেকেই এই পেশা থেকে হারিয়ে গেছে। বর্তমানে কিছু মহাজনের মাধ্যমে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাঁতশিল্প টিকে আছে।

কুমারখালী কাপুড়িয়া হাটের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা বলেন, গত তিন বছরে লুঙ্গি ও গামছার দাম বেড়েছে মাত্র ১০ থেকে ১৫ টাকা। এভাবে চলতে থাকলে তাঁতশিল্প হারিয়ে যাবে। তিনি সরকারিভাবে দাম নিয়ন্ত্রণের দাবি জানান।

রং-সুতার দাম বৃদ্ধি ও পণ্যের দাম কম এবং তাঁতিদের সংখ্যা কমার বিষয় স্বীকার করে কুমারখালী তাঁতবোর্ডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. মেহেদী হাসান জানান, গত তিন বছরে প্রায় দুই হাজার তাঁতি পেশা বদল করেছে। তাঁতশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে প্রায় ৩৪ কোটি টাকা আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে ট্রায়াল চলছে। সেখানে উৎপাদন শুরু হলে কাপড়ের মান বৃদ্ধির পাশাপাশি দামও বাড়বে।

কুমারখালী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিতান কুমার মণ্ডল বলেন, আঞ্চলিক পর্যায় থেকে দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তিনি বিষয়টি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করবেন।