মসলার মধ্যে বিলাতি ধনিয়া একটি কিউলিনারি হার্ব। এটিকে বাংলা ধনিয়া এবং সিলেটে একে বনঢুলা বলে। বর্তমানে এই ফসলটি পার্বত্য অঞ্চলের রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি এলাকায় ব্যাপকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে।
রাঙ্গামাটি জেলার রাণীর হাট এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে বিলাতি ধনিয়ার ব্যাপক চাষ হচ্ছে। বিলাতি ধনিয়ার চাহিদা সারা দেশে বিদ্যমান। মসলাজাত এই ফসলটি রপ্তানিরও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ইউরোপে বিভিন্ন হোটেল বিশেষ করে স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বাঙালি হোটেলগুলোতে এর প্রচুর চাহিদা আছে। চীনারা সর্বপ্রথম ধনিয়ার বিকল্প হিসেবে বিলাতি ধনিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রচলন করেন। বর্তমানে বিলাতি ধনিয়া বাংলাদেশ ছাড়াও ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়া, চীন প্রভৃতি দেশে চাষ হচ্ছে।
ব্যবহার: বিলাতি ধনিয়ার পাতা মসলা বা খাদ্য সুগন্ধিকারক (কিউলিনারি হার্ব) হিসেবে বিভিন্ন দেশে ব্যবহার করা হয়। এ দেশের মতো ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ফোরিডা, হাওয়াই প্রভৃতি দেশেও রান্নার মসলা হিসেবে বিলাতি ধনিয়া বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত: এর কাঁচা পাতা ব্যবহার হয়। শুকালে এর পাতার তীব্র সুগন্ধ নষ্ট হয় না। বিলাতি ধনিয়া যে শুধু রান্নাকে সুগন্ধময় ও সুস্বাদু করে তাই নয়, এর ভেষজ মূল্যও আছে।
ভেষজগুণ: জ্বর, হাইপার টেনশন, অ্যাজমা, পাকস্থলীর জ্বালা পোড়া, কৃমি, সাপে কামড়ানো, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায় বিলাতি ধনিয়া সফলভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে।
বিলাতি ধনিয়া এবং ধনে পাতার পার্থক্য: বিলাতি ধনিয়া এবং ধনে পাতার মধ্যে কোন সাদৃশ্য নেই। বিলাতি ধনিয়া দেখতেও ধনে পাতার মতো নয়। ধনে পাতা পাতলা ও চতুদিকে চেরাচেরা। বিলাতি ধনিয়ার পাতা লম্বা, কয়েকটি পাতা মিলে একটি গোছা বা গাছ হয়। পাতার চারদিকে নরম কাঁটা থাকে। ধনে পাতার গাছে কাণ্ড হয়। কিন্তু বিলাতি ধনিয়াতে কোন কান্ড হয় না।
জমি ও চারা তৈরি: সারা বছরই বিলাতি ধনিয়ার চাষ করা যায়। তবে খরিপ মৌসুমে এর ফসল ভাল হয়। জৈবসার সমৃদ্ধ জমিতে এর চাষ সবচেয়ে ভাল হয়। শুকনো মৌসুমে ও শীতকালে পানি সেচ নিশ্চিত করতে পারলে সারা বছর এই ফসলের চাষ করা যায়। সাধারণত জুন-জুলাই মাসে বিলাতি ধনিয়ার বীজ বপন করা হয়। অথবা বীজতলায় বীজ বপন করে চারা করা হয় এবং চারা একটু বড় হলে সরাসরি জমিতে সারিতে ১০-১৫ সে.মি. দূরত্বে লাগাতে হয়। জমিতে বীজ বপন করলেও একই দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। সারিতে বা ছিটিয়ে বপনের পর বীজ ভাল করে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হয়। বিলম্বে চারা গজাতে দেখলে হতাশ না হয়ে চারা গজানোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। জমিতে রস না থাকলে প্রয়োজনে হালকা সেচ দেয়া যেতে পারে। বিলাতি ধনিয়ার বীজ কয়েক মাস পর্যন্ত ধীরে ধীরে গজাতে থাকে। ফলে একবার বীজ বপন করলে জমি থেকে ৮-১২ বার ফসল তোলা যাবে।
জমিতে আন্তঃফসল চাষ: বিলাতি ধনিয়া দীর্ঘমিয়াদি ফসল। এটি ছায়াবিলাসী ফসল। তাই এই ফসলে ছায়ার জন্য মাচা তৈরি করে তাতে বেশ কিছু ফসল উঠিয়ে দেয়া যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে লতানো উদ্ভিদের মধ্যে মিষ্টি কুমড়া, লাউ, করলা, চালকুমড়া, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, শিম, বরবটি ইত্যাদি সবজি চাষ করে বাড়তি আয় পাওয়া যায়।
সার প্রয়োগ ও পরিচর্যা: বিলাতি ধনিয়া ‘পাতা জাতীয়’ ফসল হওয়ায় এই ফসলে ইউরিয়া ও পটাশ সার বেশী লাগে। বীজ বোনার পূর্বে প্রতি শতাংশে জমিতে ৮০ কেজি পঁচা গোবর বা আবর্জনা পঁচা সার, ২০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৮০০ গ্রাম টি এস পি ও ৮০০-১০০০ গ্রাম এম ও পি সার শেষ চাষের ৩-৪ দিন আগে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। চারা গজানোর পর থেকে ১ মাস অন্তর অথবা ২ বার ফসল সংগ্রহের পর প্রতি শতাংশে ২০০ গ্রাম হারে ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করতে হবে। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে ছায়াযুক্ত স্থানে ইউরিয়া বেশি দিলে পাতায্ক্তু গাছের ফলন বাড়ে।
বিবিধ ব্যবস্থাপনা:
ক. আগাছা দমন: চারা গজানোর পর সাধারণত ১ বার আগাছা পরিস্কার করলেই চলে। তবু জমিতে যেন আগাছা জন্মাতে না পারে একটু সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়াজন। ক্রমে ফসল বড় হয়ে মাঠ ছেয়ে গেলে তখন আগাছা নিড়ানোর প্রয়োজন হয়না।
খ. ছাউনি দেয়া: ছাউনি না দিলে প্রখর সূর্যালোকের কারণে বিলাতি ধনিয়ার পাতা শক্ত ও কাঁটাযুক্ত হয়ে যায়। আবার সূর্যালোক না পাইলে ফসল ভাল হয় না। মোট সূর্যালোকের ২০-৪০ ভাগ বিক্ষিপ্ত আলো বিলাতি ধনিয়ার জন্য যথেষ্ট। এজন্য বাঁশের তৈরি মাচায় নারিকেল পাতা, ছন, ধৈঞ্চা, কলাপাতা ইত্যাদি দিয়ে ছাউনি করা ভালো। এ ছাড়া মাচায় কুমড়া জাতীয় আন্ত:ফসল তুলে দিলে বাড়তি ফসল পাওয়া যাবে।
গ. সেচ: বিলাতি ধনিয়া আর্দ্রতা বেশি পছন্দ করে। তাই এ ফসলে জমিতে সব সময় রস থাকতে হবে। তবে জলাবদ্ধতা হতে দেয়া যাবে না। ঝরণা সেচ ৭ দিন পর পর দিলে সবচেয়ে ভালো।
ঘ. বালাই দমন: বিলাতি ধনিয়ায় সাধারণত: তেমন রোগ ও পোকার আক্রমণ হয় না। তবে মাঝে মাঝে গোড়া পঁচা রোগ ও পাতা ঝলসানো ছত্রাকজনিত রোগ দেখা দিতে পারে। অনুমোদিত ছত্রাকনাশক দিয়ে এ রোগ দমন করতে হবে।
ঙ. ফসল সংগ্রহ ও বিপণন: কাঁচা পাতার ফলন হেক্টরে প্রায় ৩৫-৪৭ টন। গাছ বড় হতে শুরু করলে অর্থাৎ সবুজপাতা যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন বড় গাছগুলোর গোড়াসহ ওঠিয়ে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে আঁটি বেঁধে অথবা স্তুপাকারে প্লাষ্টিকের ক্যাইসে (বাক্স) ভরে বাজারে প্রেরণ করতে হবে। এর চাহিদা বেশি থাকায় পাইকারগণ জমি থেকেই ফসল ক্রয় করে থাকেন। ক্ষুদ্র চাষিগণ পূর্নতাপ্রাপ্ত পাতা গাছ থেকে ধারালো যন্ত্রের সাহায্যে কেটে ছোট ছোট আঁটি বেঁধে পাইকার বা বিক্রেতার/ ক্রেতার কাছে বিক্রি করে থাকেন।
বিলাতি ধনিয়ার গাছে ফুল ফোটার ৪০ দিনের মধ্যে বীজ পেকে যায়। বেশি পাকতে দিলে বীজ ঝরে যায়। এ জন্য বেশি না পাকিয়ে কেটে এনে প্লাষ্টিকের বিছানার উপর রেখে শুকাতে হবে। দন্ড শুকানোর পর মাড়াই না করেও মঞ্জুরী দণ্ডসহ ফুল শুকিয়ে পলিব্যাগ বা কৌটায় ভরে রাখা যাবে। চাষের পূর্বে বীজ বুনার আগে মাড়াই করে বীজ বুনতে হবে।
- রফতানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে উৎপাদনের গুণগতমান নিশ্চিত করুন : রাষ্ট্রপতি
- দেশের ২০ ভাগ প্রত্যক্ষ ও ৫০ ভাগ মানুষ পরোক্ষভাবে পোল্ট্রি খাতে জড়িত: প্রধানমন্ত্রী
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন