রকমেলন হল মাস্কমেলন গোত্রের একটি উচ্চমূল্যের বিদেশি ফল। আরবে একে সাম্মাম (شمام) বলে। ফলের উপরের ত্বক পাথর (রক) এর মত, তাই অস্ট্রেলিয়াতে রকমেলন নামে পরিচিত। উর্দুতে খরবুজ বা খরবুজা, আমেরিকাতে ক্যান্টালোপ, এশিয়াতে মেলন নামে পরিচিত। সুইট-মেলন বা মিষ্টি বাংগিও বলেন অনেকে।
পুষ্টিগুণে রকমেলন অনন্য। বিভিন্ন এন্টি-অক্সিডেন্ট সম্পন্ন এই ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন এ এবং সি যা উচ্চ রক্তচাপ, এসমা কমিয়ে দেয়। এতে উপস্থিত বেটা ক্যারোটিন, ক্যান্সার রোধ করে। এছাড়াও এটি খুব রসালো ফল, ৯০% পানি, যা হাইড্রেশন বজায় রাখে ও হজমে সহায়তা করে। চুল ও ত্বকের জন্যও এই ফল উপকারি। তবে ডায়েবেটিক ও কিডনি রোগির ফল খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
রকমেলন চাষঃ বর্তমানে অনেকেই অধিক লাভের আশায় আমাদের দেশে এ ফল চাষের চেষ্টা করছেন। তবে সঠিক পদ্ধতি-জ্ঞান ও এ দেশের আবহাওয়া উপযোগী ভালো জাতের অভাবে অনেকেই ভালো মানের ফলন পাচ্ছেন না।
জাতঃ গার্ডেন ফ্রেশ বাংলাদেশ বহু দিনের নিরলস পরিশ্রম, চেষ্টা ও গবেষণায় আবহাওয়া উপযোগী মিষ্টি একটি জাত বাজারজাতের জন্য পছন্দ করেছে। নামকরন হয়েছেঃ “হানি জুস”। এই জাতের বীজে ১০ গ্রামে প্রায় ৩৫০ থেকে ৪০০ টি টি বীজ থাকে। বিঘায় প্রায় ২৪০০-২৫০০ চারা বপন করা যায়। বিঘায় প্রায় ৯০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। চারা লাগানোর ৫৫-৬০ দিনে ফলন পাওয়া যায়।
চাষের সময়ঃ সাধারণত খোলা মাঠে হানি জুস জাতটি ২ বার চাষ করা যায়। একবার শীত চলে যাওয়ার পর (রাতের তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে), মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ (ফালগুন) মাসে, আরেক বার তাপমাত্রা কমে গেলে (দিনের তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম হলে) মধ্য জুন- মধ্য সেপ্টেম্বর (আষাঢ়-ভাদ্র) মাসে। বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টি থেকে বাঁচাতে পলি টানেল বা পলি হাউজ করলে খুব ভালো ফসল পাওয়া সম্ভব। এছাড়া বছরের প্রায় পুরো সময়ে গ্রিন হাউজে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করেও চাষ করা সম্ভব।
জমি প্রস্তুতিঃ জমি প্রথমে চাষ দিয়ে পরে বিঘা প্রতি ৫ ট্রলি (৫ টন) শুকনা গোবর ও প্রায় ২৫০ কেজি জিপসাম দিয়ে পুনরায় চাষ দিয়ে ৩ সপ্তাহ ফেলে রাখতে হবে।
জমি তৈরির সময় সার প্রয়োগ
সারের নাম গাছ প্রতি
গোবর সার ৬ কেজি
জিপসাম / চুন* ১০০ গ্রাম
ইউরিয়া ৫ গ্রাম
টি এস পি ১৫ গ্রাম
পটাশ / এমওপি ২০ গ্রাম
জিংক (গ্রোজিন) ১ চা চামচ
বোরন ১ চা চামচ
ম্যাগনেসিয়াম সালফেট/ ম্যাগসার* ৫০ গ্রাম
সালফার (থিওভিট) ১ চা চামচ
রিজেন্ট (অটোক্রপ) ১ চা চামচ
রাগবি ১ চা চামচ
* মাটির পি এইচ ৬ এর নিচে হলেই কেবল শতক প্রতি ৪ কেজি চুন দিতে হবে। তাহলে, বাকি টুকু হবে (৩.৫) কেজি জিপসাম দিলেই হবে। মাটিতে চুন দিলে আর ম্যাগসার দেয়ার প্রয়োজন নেই।
তবে এর আগে মাটি পরীক্ষা করে নিতে পারলে খুব ভালো। এজন্য গার্ডেন ফ্রেশ বাংলাদেশ থেকে জাপানি পি এইচ মিটার সংগ্রহ করে নিজেই মাটির পি এইচ মান পরীক্ষা করা সম্ভব, অথবা এলাকার কৃষি অফিসে যোগাযোগ করে নমুনা প্রদান করে জেনে নেয়া যায়।
পি এইচ মান ৬ এর নিচে হলে শতক প্রতি ৪ কেজি হারে বিঘায় ১৩২ কেজি ডলোচুন প্রয়োগ করতে হবে। আর ডলোচুন দিলে জিপসাম ওই পরিমান কম দিতে হবে। অর্থাৎ ২৫০ থেকে ১৩২ কেজি কম তথা ১১৮ কেজি জিপসাম। এই চুন বা জিপসাম গোবরের সাথে দেয়ার পর জমি অবশ্যই ২-৩ সপ্তাহ ফেলে রাখতে হবে।
চারা তৈরিঃ প্যাকেট থেকে বীজ বের করে ১ ঘন্টা রোঁদে শুকিয়ে নিতে হবে। খেয়াল করতে হবে, পাখি বা মুরগি খেয়ে না ফেলে। এরপর এক ঘন্টা ছায়ায় রেখে ঠান্ডা করে নিতে হবে।
বীজ বিশোধনের জন্য একটি পাত্রে খুব অল্প পানি (২ চা চামচ) নিয়ে এক চিমটি কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাক নাশক (অটোস্টিন, অটোক্রপ কেয়ার) ও ১ ফোঁটা ইমিডাক্লোপ্রিড (ইমিটাফ) দিয়ে মিশিয়ে তা দিয়ে বীজ ২০ মিনিট ভিজিয়ে নিতে হবে। এরপর ধুয়ে আরো ৩-৪ ঘন্টা শুধু পানিতে ভিজিয়ে নিতে হবে। বীজ উঠিয়ে ঝেড়ে সীড ট্রে তে দিতে হবে।
কোকোডাস্ট ও ভার্মিকম্পোস্ট ১:২ অনুপাতে মিশিয়ে ট্রে ভালভাবে ভরে নিতে হবে।
বীজ দেয়ার পর ভালোভাবে পানি স্প্রে করে দুই-একদিন ট্রে ঢেকে রাখলে দ্রুত অঙ্কুরোদগম হবে। এরপর চারার ট্রে রোদে রাখতে হবে। পলি টানেলের ভিতরে রাখলে কুয়াশা ও বৃষ্টির হাত থেকে চারা রক্ষা পাবে। সর্বদা ট্রে স্প্রে করে ভিজিয়ে রাখতে হবে যাতে কখনো মাটি শুকিয়ে না যায়।
বীজ বপনের সাত দিন পর রিডোমিল গোল্ড লিটার প্রতি ২ গ্রাম (মেনকোজেব+ মেটালাক্সিন) ও অটোস্টিন (কার্বেন্ডাজিম) লিটার প্রতি ০.৫ গ্রাম, প্রটোজিম লিটার প্রতি ২ মিলি হারে মিশিয়ে ভোরে স্প্রে করে দিতে হবে।
চারার বয়স ১০-১২ দিন হলে অর্থাৎ বীজ পাতার পর দুই-আড়াই পাতা হলে জমিতে দিতে হবে। এর আগে জমি প্রস্তুত করে নিতে হবে।
বেড তৈরিঃ
জিপসাম দেয়ার ১৫ দিন পর আবার চাষ দিতে হবে। প্রদত্ত টেবিল থেকে কীটনাশক ও সারের ৫০ ভাগ জমিতে দিয়ে শেষ চাষ দিয়ে বেড তৈরি করতে হবে।
প্রথমে ক্ষেতের চারপাশে ১ ফিট চওড়া নালা থাকতে হবে। বেড হবে ৩.৫ ফিট চওড়া ও আধা থেকে ১ ফিট উচা। দুই বেডের মাঝে নালা থাকবে ২ ফিট চওড়া। অর্থাৎ সাড়ে চার ফিট পর পর জমিতে সুতা ধরে ছোট লাঙ্গল দিয়ে দাগ কেটে দাগে উভয় পাশে ১ ফিট করে মাটি উঠালে মাঝে হবে দুই ফিট নালা, আর বেড হবে সাড়ে তিন ফিট।
এরপর বাকি ৫০ ভাগ সার বেডের উপর ছিটিয়ে দিতে হবে। এর উপর ম্যাগসালফ দিতে হবে। ভার্মি কম্পোস্ট (বিঘায় ২৫০ কেজি) বা আরও কিছু শুকনো গোবর (বিঘায় ১ টন) দিতে পারলে খুব ভালো হয়। এরপর বেডে ফাইনাল মাটি দিয়ে মই করে সমান করে নিতে হবে।সর্বশেষ টিমসেন ¯েপ্র কওে বেড ছত্রাকমুক্ত করতে হবে।
মালচিং শিট বেড তৈরির পর বিছাতে হবে। রকমেলন করতে বিঘায় ২ টি মালচিং শিট প্রয়োজন যেগুলো ১.২ মিটার বা প্রায় ৪ ফিট চওড়া ও ৪০০ মিটার বা প্রায় ১৩০০ ফিট লম্বা। গার্ডেন ফ্রেশ বাংলাদেশ থেকে ভালো মানের মালচিং পেপার সরবরাহ করা হয়।
১৬ সাইজের গুনা ৯-১০ ইঞ্চি করে কেটে দুই পাশ বাঁকিয়ে মালচিং পেপারের দুই সাইডে মাটির সাথে গেঁথে দিতে হবে। মাঝে মাঝে পেপারে অল্প মাটি তুলে দিতে হবে যাতে বাতাসে উড়ে না যায়। এরপর শাটারের ¯স্প্রিং ৪ ইঞ্চি ডায়াতে গোল করে ঝালাই করে রড লাগিয়ে কাটার তৈরি করে মালচিং পেপার ছিদ্র করতে হবে। এক মালচিং এর মাঝ বরাবর দুই সারিতে চারা লাগানোর জন্য ছিদ্র করতে হবে। চারা থেকে চারার দুরত্ব ২ ফিট। সারি থেকে সারির দুরত্ব ২ ফিট।
চারা বপনঃ ট্রে থেকে চারা তুলে ছিদ্রে গর্ত করে বপন করতে হবে। এরপর ২ দিনের মাঝে আড়াআড়ি ক্রস করে প্রায় ৬ ফিট লম্বা কঞ্চি প্রতি গর্তে স্থাপন করতে হবে।
ক্রস সেকশন গুনা দিয়ে বেঁধে গুনার দুই প্রান্তে বেডের দুই মাথায় মোটা বাঁশ স্থাপন করে আটকে দিতে হবে। প্রয়োজনে সাপোর্টের জন্য বেডের মাঝে আরো কিছু বাঁশ দিতে হবে।
গাছের যত্নঃ চারা স্থাপনের পর ক্ষেতে পানি সেচ দিতে হবে। বেড বেশি উঁচা হলে পাত্র দিয়ে পানি গাছের গোড়ায় দিয়ে দিতে হবে। টেবিল অনুসারে বালাইনাশক ও সার স্প্রে করতে হবে।
কাটিং রকমেলন চাষে খুব গুরুত্বপূর্ণ। গাছের নিচের দিকে কেবল একটি ডাল রেখে বাকি গুলো ফেলে দিতে হবে। গাছ ৭-৮ পাতা হলে আগা কেটে দিতে হবে। এরপর দুই শাখা বের হবে। সেখানে গাছের প্রথম পাতা (বীজ পাতা বাদে) থেকে হিসাব করে ৮ম-১২তম পাতার গোড়ায় আসা ফল পরাগায়ন করে নিতে হবে। এরপর ফল ১৫০-২০০ গ্রাম হলে একটি গাছে প্রতি ডালে একটি করে মোট ২টি ফল রাখতে হবে। এর বেশি ফল রাখা যাবে না।
পানি সেচ নিয়মিত দিতে হবে, তবে প্লাবন সেচ নয়, কেবল নালা ভরে সেচ দিতে হবে। বেড বেশি উঁচা হলে পাত্র দিয়ে গাছের গোড়ায় পানি পৌছে দিতে হবে। ক্ষেত যথা সম্ভব আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
গাছে পুরূষ ফুল ফোঁটা শুরু হলে শতক প্রতি ১ থেকে ২ টি করে সাড়ে চার ফিট উচ্চতায় ফেরোমোন ট্রাপ (ইসপাহানি কিউ লিওর) স্থাপন করতে হবে।
ফলের যত্নঃ ফল ধরে গেলে নন-অভেন (NWF) টিস্যু ব্যাগ দিয়ে ব্যাগিং করলে মাছি পোকা ও কাটুই পোকা থেকে ফল ভালো থাকে। এছাড়াও কাটুই পোকা থেকে বাঁচাতে পুরো ক্ষেতে ডেসিস স্প্রে করে দিতে হবে।
চারা বপনের ৪৫ দিনের পর আর সেচ দেয়া যাবে না। প্রয়োজন থাকলে আগেই সেচ দিয়ে নিতে হবে। ফল পাকা শুরু হলে ইথ্রেল স্প্রে করে ফল উত্তোলন করে সুন্দর করে বক্সে প্যাকিং করতে হবে। এক কার্টুনে ২ লেয়ারের বেশি ফল দেয়া যাবে না। প্রতিটি ফল পেপারে মুড়িয়ে নিতে হবে। দেরি না করে দ্রুত বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
লেখক:
ইব্রাহীম ইবনে মোল্লা মোশাররফ
ফাউন্ডার ও সিইও
গার্ডেন ফ্রেশ বাংলাদেশ
ফার্মসএন্ডফার্মার/১১জুলাই২০