রোপা আমন ধানের জাত নির্বাচন, বীজতলা তৈরি ও পরিচর্যা কৌশল

1509

বীজতলা

খাদ্য নিরাপত্তা বিধানে আমাদের দেশে ধানই মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। আমাদের দেশে তিনটি মৌসুম আউশ, আমন ও বোরোতে ধান আবাদ হয়ে থাকে। ধান উৎপাদনের তিনটি মৌসুমের মধ্যে আমন মৌসুম সবচেয়ে বেশি এলাকা আবাদ করা হয়। তবে ইদানীংকালে আমাদের দেশে গবেষণাগার ও মাঠে কৃষকের ক্ষেতে ফলনের বেশ পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।

গবেষণায় দেখা যায়, এ ফলন পার্থক্য প্রায় ১৩৩-২০০ কেজি/বিঘা। কাজেই জাতীয় উৎপাদন বাড়াতে হলে ফলন পার্থক্য কমাতে হবে। আমন ধানের ফলন বাড়ানো জন্য জাত নির্বাচন, বীজতলা তৈরি ও বীজতলা পরিচর্যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই জাত নির্বাচন, বীজতলা তৈরি ও বীজতলা পরিচর্যা বিষয়ক কলাকৌশলগুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

জাত নির্বাচন: প্রথমেই জাত নির্বাচন করতে হবে। জাত নির্বাচনে মৌসুম, জমির অবস্থান, জমির উর্বরতা ও চাহিদা /বাজার দর বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হয়। আমন ধানের জন্য অধিক ফলনশীল মাঝারি থেকে মোটা চালের জন্য বিআর১০, বিআর১১, ব্রি ধান৩০, ব্রি ধান৩১ চাষ করা যায়। জীবনকাল ১৪০-১৫০ দিন এবং গড় ফলন ৬৬৮-৭৩৫ কেজি/বিঘা। স্বল্পমেয়াদি জাত হিসেবে বিনা ৭, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৯, ব্রি ধান৪৯, বিইউ ১ আবাদ করা যায়। এ জাতগুলোর জীবনকাল ১০০-১২০ দিন এবং গড় ফলন ৬০০-৭৩৫ কেজি/বিঘা। এ জাতগুলোর বীজ আষাঢ়ের ৫ তারিখের পূর্বে বপন করা উচিত নয়।

সুগন্ধি চালের জন্য ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৭, ব্রি ধান৩৮ চাষ করা যায়। জীবনকাল ১৩৫-১৪০ দিন এবং গড় ফলন ৪৬৮ কেজি/বিঘা। বন্যাপ্রবণ এলাকার জন্য বন্যা সহিষ্ণু জাত হিসেবে ব্রি ধান৫১ ও ব্রি ধান৫২ চাষ করা যায়। এ জাতগুলোর বৈশিষ্ট হচ্ছে আকস্মিক বন্যায় ১০ থেকে ১৫ দিন জলমগ্ন থাকার পরও ফলন ভালো দেয়। জলমগ্ন না হলে জীবনকাল ১৪৫ দিন আর ১৪ দিন জলমগ্ন থাকলে ১৫৫ দিন এবং গড় ফলন ৫৩৪-৬০০ কেজি/বিঘা।

বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে অথবা নাবী জাত হিসেবে বিআর২২, বিআর২৩, ব্রি ধান৪৬ অথবা স্থানীয় জাত নাইজার শাইল, বিরইন চাষ করা যায়। এ জাতের চারা সর্বশেষ ৩১ ভাদ্র পর্যন্ত রোপণ করা যাবে। তবে মনে রাখতে হবে, রোপা আমন মৌসুমে ভাদ্র মাসের পর কোন ধান রোপণ করা যাবে না। এ জাতগুলোর জীবনকাল ১২৫-১৫০ দিন এবং গড় ফলন ৬২৮-৭৩৫ কেজি/বিঘা।

খরা সহিষ্ণু জাত হিসেবে ব্রি ধান৫৬ ও ব্রি ধান৫৭ চাষ করা যায়। এ জাতগুলো নির্দিষ্ট মাত্রায় খরা সহ্য করতে পারে। এছাড়া বৃষ্টিবহুল ও খরা প্রবণ উভয় অঞ্চলের জন্য ব্রি ধান৪২ ও ব্রি ধান৪৩ চাষ করা যায়। জীবনকাল ১১০-১১৫ দিন এবং গড় ফলন ৪০০-৬০০ কেজি/বিঘা।

সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় জুলাই আগস্ট মাসে যেহেতু বন্যা হয়ে থাকে তাই এই এলাকার নিম্নাঞ্চলগুলোতে ব্রি ধান৫১, ব্রি ধান৫২ চাষ করাই উত্তম। তবে রোপা আমন ধানের জন্য ব্রি ধান৪৯ এবং বিআর১১ খুবই উপযোগী। পুষ্টির দিকে বিবেচনা করলে জিংক সমৃদ্ধ ব্রি ধান৬২ চাষ করা যায়।

ভালো বীজ চেনার উপায়: ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির মূল উপকরণই হচ্ছে উন্নতমানের বীজ। ভালো বীজ বিজাতমুক্ত, আগাছা বীজমুক্ত, রোগ ও পোকামাকড়মুক্ত, অপদ্রব্যমুক্ত, পরিপক্ব ও পুষ্ট, সমআকার, চকচকে, সঠিক আর্দ্রতাযুক্ত (১২%), অংকুরোদগম ক্ষমতা বা গজানোর হার কমপক্ষে ৮০% এবং বিশুদ্ধতা হার কমপক্ষে ৯৫-৯৯%।

বর্তমানে বাজার থেকে প্যাকেট বীজ কেনা যায়। তবে বীজের প্যাকেটে লাগানো ট্যাগ ও লেবেলিং এ উল্লিখিত বীজ গজানোর হার ও বিশুদ্ধতার হার দেখে কিনতে হবে। সবুজ ট্যাগযুক্ত হলে ব্রিডার বীজ (মা থেকে উৎপন্ন এবং সাধারণত বাজারে সরবরাহ করা হয় না), সাদা ট্যাগযুক্ত হলে ভিত্তি বীজ, নীল ট্যাগযুক্ত হলে প্রত্যায়িত বীজ এবং হলুদ ট্যাগযুক্ত হলে মানঘোষিত বীজ অর্থাৎ উৎপাদক নিজেই প্রত্যয়ন করবেন।

বীজ বাছাই (চিটা ধান অপসারণ): বীজ ধান মেপে নিয়ে বীজতলায় ফেলার আগেও আরও কিছু কাজ করতে হবে। কারণ ভালো বীজ মানে সবল চারা। এজন্য ১০ লিটার পরিষ্কার পানিতে ৩৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার মিশিয়ে ১০ কেজি ছেড়ে হাত দিয়ে নেড়ে দিন। পুষ্ট বীজ ডুবে নিচে জমা হবে এবং অপুষ্ট ও চিটাগুলো ভেসে উঠবে। হাত বা চারনি দিয়ে ভাসমান বীজগুলো সরিয়ে ফেলুন। বালটির নিচ থেকে বীজ তুলে নিয়ে পরিষ্কার পানিতে ৩-৪ বার ভালো করে ধুয়ে নিন। ইউরিয়া মিশানো পানি সার হিসেবে বীজতলায় ব্যবহার করা যাবে।

বীজের অঙ্কুরোদগম বা গজানো পরীক্ষা: অঙ্কুরোদগম পরীক্ষার জন্য পক্ষপাতহীনভাবে ১০০টি বীজ নিন। প্লাস্টিকের পাত্রে দেড় থেকে দুই ইঞ্চি পুরু করে বালি নিন। ১০০টি বীজ বালুর বসিয়ে দিন। পানি দিয়ে বালু এমনভাবে ভিজিয়ে যাতে পানি ভেসে না থাকে। খেয়াল রাখতে হবে যাতে পানি শুকিয়ে না যায়। ১/২ সপ্তাহ পর চারাগুলো পরীক্ষা করুন। যদি কমপক্ষে ৮০টি সুস্থ সবল চারা পাওযা যায় তবে এ ধান বীজ হিসেবে ব্যবহারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। এখানে সুস্থ সবল চারা বলতে সঠিক আকৃতি/অনুপাতে পাতা ও শিকড় থাকবে। এর মাধ্যমে জমিতে কতটুকু বীজ লাগবে তা সঠিকভাবে নিরূপণ করা যায়।

বীজ শোধন ও জাগ দেয়া: বাছাইকৃত বীজ কাপড় বা চটের ব্যাগে ভরে ঢিলা করে বেঁধে নিন। এবার কেজি প্রতি বীজের জন্য এক লিটার পানি এবং দুই গ্রাম হারে ব্যাভিস্টিন/প্রোভেক্স /গিলজিম/হেডাজিম যে কোন একটি পাত্রে মিশিয়ে নিন। এরপর বীজের পোটলাটি ২৪ ঘণ্টা পানিতে ডুবিয়ে রাখুন। এভাবে বীজ শোধনও হলো আবার সঠিকভাবে ভিজেও গেল। এরপর বীজের পোটলা পানি থেকে ইট বা কাঠের টুকরার ওপর ঘণ্টাখানের রেখে দিন পানি ঝরানোর জন্য। এবার বাঁশের টুকরির বা ড্রামে ২/৩ স্তরে শুকনো খড় বিছিয়ে তার ওপর বীজের পোটলা রাখুন এবং আবারও ২/৩ স্তরে শুকনো খড় দিযে বিছিয়ে তার ওপর ভারি জিনিস দিয়ে চাপা দিন। এভাবে জাগ দিলে ৪৮ ঘণ্টা বা দুই দিনের মধ্যে ভালো বীজের অঙ্কুর বেড় হবে এবং বীজতলায় বপনের উপযুক্ত হবে।

আদর্শ বীজতলা তৈরি: মূল জমিতে রোপণের পূর্বে যে স্থানে সাময়িকভাবে চারা উৎপাদন করা হয় তাকে বীজতলা বলে। বীজতলা বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে যেমন- শুকনা ও ভেজা এবং বিশেষ ক্ষেত্রে ভাসমান ও দাপগ বীজতলা। আদর্শ ভেজা বীজতলা তৈরি করা জন্য যথাসম্ভব বাড়ির কাছাকাছি উর্বর এটেল দো-আঁশ মাটি, পর্যাপ্ত আলো বাতাসযুক্ত স্থান এবং সেচ ও নিষ্কাশনের সুবিধা আছে এমন জমিই উত্তম। জমি অনুর্বর হলে প্রতি শতকে ২০ কেজি হারে জৈব সার (পচা গোবর বা আবর্জনা) সুন্দরভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। এরপর জমিতে দুই থেকে সোয়া দুই ইঞ্চি পানি রেখে ১/২ চাষ ও মই দিয়ে ৭-১০ দিন পানি আটকিয়ে রেখে দিতে হবে। আগাছা, খড় পচে গেলে আবারও চাষ ও মই দিয়ে কাদা করে জমি তৈরি করতে হবে। এ অবস্থায় জমিকে কয়েকটি বেডে ভাগ করে নিতে হবে। প্রতিটি বেড ৪ ফুট বা দুই হাত চওড়া বা ১.১৫ মিটার এবং ৩ মিটার বা ২২ হাত বা জমির দৈর্ঘ্য অনুযায়ী হতে হবে। দুই বেডের মাঝে এক কোদাল বা এক ফুট চওড়া এবং ৪ ইঞ্চি গভীর নালা তৈরি করতে হবে। নির্ধারিত জমির দুইপাশের নালার মাটি দিয়ে বেড তৈরি করা যায়। এরপর বেডের ওপরের মাটি বাঁশ বা কাঠের চ্যাপ্টা লাঠি দিয়ে সমান করতে হবে। এভাবে তৈরি এক শতাংশ পরিমাণ বীজতলাতে যে চারা হবে তা দিয়ে ২৫-৩০ শতাংশ জমিতে রোয়া বা চারা লাগানো যায়।

বেড তৈরির ৩/৪ ঘণ্টা পর বীজ বোনা উচিত। বীজতলা তৈরির জন্য দুই বেডের মাঝে যে নালা তৈরি করা হয় তা খুবই প্রয়োজন। এ নালা যেমন সেচের কাজে লাগে তেমনি পানি নিষ্কাশন বা প্রয়োজনে সার/ওষুধ ইত্যাদি প্রয়োগে করা সহজ হয়।

বীজের হার ও বীজতলায় বীজ বপন: সতেজ সবল চারা হলে ভালো ফলনের নিশ্চয়তা বেশি। প্রতি শতাংশ বীজতলায় ২ থেকে ৩ কেজি অংকুরিত বীজ সুষমভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। যা দ্বারা ২০-২৫ শতাংশ জমিতে রোপন করা যায়। আষাঢ় মাসই বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। তবে মনে রাখতে হবে, রোপা আমন ধান ভাদ্র মাসের পর রোপন করা যাবে না। ভেজা বীজতলায় বীজ বেডের উপর থাকে বলে পাখিদের নজরে পড়ে সে জন্য বপনের সময় থেকে ৪-৫ দিন পর্যন্ত পাহারা দিতে হবে। আষাঢ় মাসই বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। স্বল্পমেয়াদি জাতের বীজ ১৫ আষাঢ়ের পূর্বে বপন করা ঠিক নয়।

বীজতলার পরিচর্যা: বীজতলায় সবসময় নালা ভরতি পানি রাখতে হবে বীজ গজানের ৫-৬ দিন পর বেডের ওপর ২-৩ সে.মি পানি রাখলে আগাছা ও পাখির আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বীজতলায় আগাছা, পোকামাকড় ও রোগবালাই দেখা দিলে তা দমন করার ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে সঠিকভাবে পরিচর্যা করার পরও ফসলের ক্ষেতে ভালো ফলন পাওয়া যাবে না। বীজতলায় চারাগাছ হলুদ হয়ে গেলে প্রতি শতক বীজতলায় প্রায় ২৮০ গ্রাম ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সার ব্যবহার করার পরও পরিবর্তন না হলে বুঝতে হবে সালফার বা গন্ধকের অভাব রয়েছে। তখন প্রতি শতক বীজতলায় প্রায় ৪০০ গ্রাম জিপসাম সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সারের উপরিপ্রয়োগর পর পানি নিকাশ করা যাবে না।

চারা উঠানো ও পরিবহন: চারা উঠানোর আগে বীজতলায় বেশি করে পানি দিতে হবে যাতে বেডের মাটি ভিজে নরম হয়। এতে করে চারা উঠাতে সুবিধা হয়। চারা উঠানোর সময় চারার কান্ড যাতে মুচড়ে না যায় বা ভেঙ্গে না যায় সে দিকে নজর রাখতে হবে। উঠানো চারার গোড়ার মাটি কাঠ বা হাতে আছাড় না দিয়ে আস্তে আস্তে পানিতে নাড়াচাড়া দিয়ে পরিস্কার করে নিতে হবে। চারা গাছের শিকড় ছিঁড়ে গেলেও রোপণের পর চারারবাড়বাড়তির তেমন সমস্যা না হলেও কান্ড মুচড়ে গেলে চারা গাছের বেশ ক্ষতি হয়। এ জন্য শুকনা খড় ভিজিয়ে নিয়ে বান্ডিল বাধতে হবে। মূল জমিতে চারা পরিবহনের সময় ঝুড়ি বা টুকরি ব্যবহার করে ভারের সাহায্যে চারা বহন করা উচিত। কখনোই বস্তাবন্দি করে চারা বহন করা ঠিক নয়।

কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আমন ধানের উৎপাদন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাঠ পর্যায়ে আমন ধানের সর্ব্বোচ্চ ফলন উৎপাদনের জন্য প্রস্তুতির সহায়ক হিসেবে জাত নির্বাচন, ভালো বীজ সংগ্রহ, বীজ বাছাই, বীজ শোধন ও জাগ দেওয়ার সাথে সাথে আদর্শ বীজতলা তৈরি করা একান্ত দরকার।

তাছাড়া সমকালীন চাষাবাদের প্রতি কৃষকদের নজর দিতে হবে। ফলে বিভিন্ন পোকামাকড়, রোগবালাই দমন ও অন্যান্য কার্যক্রমে কৃষকরা দলগতভাবে কাজ করার সুযোগ পাবে। পাশাপাশি মূল জমি তৈরির ব্যবস্থা হাতে নেওয়া এখনই দরকার।

লেখক: কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ, আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, সিলেট।

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম