লক্ষ্মীপুরের ‘সয়াল্যান্ডে’ সয়াবিনের বীজ বোনা শুরু

163

মেঘনার উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর। অনুকূল আবহাওয়া ও উর্বর মাটির কারণে এ অঞ্চলে সয়াবিনের বাম্পার ফলন হয়। দেশে উৎপাদিত মোট সয়াবিনের ৭০ ভাগ সয়াবিন লক্ষ্মীপুরে উৎপাদিত হয়ে থাকে। ব্যাপক ভাবে এই ফসলের আবাদ ও বাম্পার ফলন হওয়ায় লক্ষ্মীপুর ‘সয়াবিনের রাজধানী’ খ্যাতি পেয়েছে। যে কারণে ব্রান্ডিং হিসাবে লক্ষ্মীপুরকে ‘সয়াল্যান্ড’ নামকরণও করা হয়।

বিশেষ করে জেলার কমলনগর এবং রামগতি উপজেলাতে সবচেয়ে বেশি সয়াবিনের চাষাবাদ হয়। এছাড়া রায়পুর, সদর উপজেলা ও রামগঞ্জের কিছু অঞ্চলে বিভিন্ন জাতের সয়াবিনের আবাদ করা হয়।

এখন সয়াল্যান্ডে শুরু হয়েছে সয়াবিনের আবাদ। জানুয়ারি মাসের শুরু থেকেই চাষিরা তাদের জমিতে সয়াবিনের বীজ বুনতে শুরু করেছে। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সয়াবিনের বীজ বপন করার কাজে ব্যস্ত থাকবেন কৃষকরা। এরই মধ্যে অনেক এলাকার কৃষি জমিতে সয়াবিনের কচি গাছ দেখা গেছে। কৃষকরা সেগুলো পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।

এদিকে, সয়াবিন চাষিদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছে কৃষি বিভাগ। প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে চাষিদের। সারিবদ্ধভাবে বীজ বপন এবং উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড জাতের সয়াবিন চাষাবাদে উৎসাহ দিচ্ছে কৃষি বিভাগ। যদিও এখনো পর্যন্ত জেলার বেশিরভাগ কৃষক দেশি প্রজাতির (সোহাগ) সয়াবিন চাষাবাদ করেন। এছাড়া জমিতে সয়াবিন বীজ ছিটিয়ে বপন করেন।

অন্যদিকে, আবহাওয়া অনূকূলে থাকলে এ অঞ্চলে সয়াবিনের বাম্পার ফলন হয় বলে জানায় কৃষক এবং কৃষি বিভাগ। এছাড়া চাষকৃত সয়াবিনের জমি উর্বর থাকায় এ জমিতে পরবর্তীকালে ধানের ফলনও ভালো হয়।

তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে গত কয়েক বছর থেকে সায়বিন চাষাবাদে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষকরা। ফলে সঠিক সময়ে ও সঠিক নিয়মে সয়াবিনের বীজ বপন এবং স্বল্পমেয়াদি সয়াবিনের চাষাবাদে উৎসাহ দিচ্ছে কৃষি বিভাগ।

সদর উপজেলার চররমনী মোহনের চর আলী হাসান গ্রামের কৃষক নুর আলম বলেন, সয়াবিন চাষাবাদে অন্যান্য ফসলের চেয়ে খরচ কম হয়। তাই কৃষকরা রবি মৌসুমে সয়াবিন চাষাবাদে ঝুঁকছেন। আমন ধান কাটার পরপরই জমি চাষ দিয়ে সয়াবিনের বীজ বপন করা হয়। চাষাবাদে সার এবং ওষুধ খরচ খুব কম লাগে।

একই এলাকার সাবের চরের কৃষক মানিক ডালী জানান, চলতি মৌসুমে তিনি ১৩ একর জমিতে দেশীয় জাতের সয়াবিনের বীজ বপন করেছেন। ক্ষেতে চারা গজিয়েছে। ক্ষেত থেকে আমন ধান কাটার পর জমিতে ট্রাক্টর দিয়ে দুই চাষ দেওয়ার পর জমি শুকিয়ে বীজ ছিটিয়ে দিয়েছেন। এরপর পুনরায় ট্রাক্টর দিয়ে চাষ দিয়েছেন। বীজ বপনের আগে আগাছা নির্মূলের ওষুধ এবং প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ করেছেন তিনি।

অন্য এক কৃষক বলেন, সারিবদ্ধভাবে সয়াবিন চাষ করতে খরচ এবং সময় বেশি লাগে। তাই ছিটিয়ে সয়াবিনের বীজ বপন করি। আর এ এলাকার জমিগুলো মেঘনা নদীর খুব কাছাকাছি হওয়ায় জোয়ারের পানি উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এতে হাইব্রিড জাতীয় সয়াবিন গাছ টিকতে পারবে না। তাই দেশীয় জাতের সয়াবিনের আবাদ করি।

চররমনী মোহন ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কৃষক দুলালা হোসেন বলেন, চলতি মৌসুমে মেঘনার চরে প্রায় সাড়ে ৫ একর জমিতে সয়াবিনের আবাদ করব। তিন ধাপে বীজ বপন করি, যাতে ধাপে ধাপে পাকা সয়াবিন ঘরে তুলতে পারি। এরইমধ্যে দুই ধাপে বীজ বপন করেছি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে লক্ষ্মীপুরে ৪০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। প্রতি হেক্টর জমিতে গড়ে ১ দশমিক ৯ মেট্রিক টন থেকে ২ মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সে হিসেবে এ অঞ্চলে এবার প্রায় ৭৮ হাজার মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গত মৌসুমে আবাদ হয়েছে ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. জাকির হোসেন বলেন, চলতি মৌসুমে কৃষি বিভাগ থেকে জেলাতে ৬ হাজার ৭০০ জন কৃষককে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। তাদের বীজ এবং সার দেওয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, সয়াবিনের উৎপাদন বাড়াতে আমরা কৃষকদের নানা পরামর্শ দিয়ে আসছি। কৃষকরা যাতে সারিবদ্ধভাবে এবং উচ্চ ফলনশীল (হাইব্রিড) জাতের বীজ বপন করে। হাইব্রিডের মধ্যে বিইউ-১, বিইউ-২, বারি-৬, বীনা-৫ ও বীনা-৬ জাতের সয়াবিন রয়েছে। এগুলোতে ফলন ভালো হয়। কোনো কোনো জাতের সয়াবিন হেক্টরে সাড়ে ৩-৪ টন ফলন পাওয়া যায়। এছাড়া সময়কালও কম লাগে। বিইউ-১ জাতের সয়াবিন রোপনের পর ফলন আসতে ৮০ দিন সময় লাগে। যেখানে দেশীয় জাতের সয়াবিন ফলন উঠতে সময় লাগে ১০০ দিনের মতো। যেসব সয়াবিনে সময়কাল কম লাগে, সেগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে না। তাই সঠিক সময়ে পাকা সয়াবিন ঘরে তোলা সম্ভব।