সম্ভবনাময় ও লাভজনক লাল তেলাপিয়া মাছের চাষ গ্রাম পর্যায়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। স্বল্প বিনিয়োগ এবং অল্প কায়িক পরিশ্রমে অধিক মুনাফার সুযোগ আছে এ মাছ চাষ করে। এছাড়া এ মাছ চাষে তেমন ঝুঁকিও নাই। এছাড়া সাথী ফসল হিসেবে মাগুর ও গুলশা মাছকেও অন্তর্ভূক্ত করে মিশ্রচাষ করা যায়। স্বাদু ও লবাণাক্ত পাতিতে এ মাছ সহজে চাষ করা যায়। পুকুরে লাল তেলাপিয়া এককভাবে চাস ককরলে বেশি মুনাফা পাওয়া যায়। এ মাছ চাষ করে যে কেউ খুলতে পারবেন ভাগ্যের দরজা।
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি:
ছোট বড় যে কোনো পুকুরে লাল তেলাপিয়া চাষ করা যায়। তবে পানির গভীরতা তিন থেকে ৫ ফুট থাকে এমন ২০ থেকে ৫০ শাতাংশ আয়তনের পুকুরে এ মাছ চাষের জন্য নির্বাচন করার যেতে পারে। প্রথমে পুকুরের পাড় মেরামত, জলজ আগাছা পরিস্কার এবং অবাঞ্চিত মাছ দূর করে প্রতি শতাংশে এক কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হয়। এবং চুন প্রয়োগের তিন দিন পরে প্রতি শতাংশে ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হয়। সার প্রয়োগের তিন দিন পর পুকুরে লাল তেলপিয়ার পোনা মুজদের ব্যবস্থা নিতে হবে।
পোনা মজুদ ও চাষ ব্যবস্থাপনা:
পুকুর প্রস্তুতির পর প্রতি শতাংশে ৬ থেকে ৮ গ্রাম ওজনের সুস্থ সবল ১৮০ থেকে ২০০ টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে। পোনা মজুদের পর ২৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ সম্পূরুক খাদ্য প্রতিদিন পুকুরে মজুদকৃত মাছের মোট দৈহিক ওজনের ৩ থেকে ১০% হারে নিম্নের সারণি অনুসারে প্রয়োগ করতে হবে। পোনার বয়স অনুপাতে খাদ্যের হার ও ধরণ পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাচুর্য্য বৃদ্ধির জন্য ৭ থেকে ১০ দিন অন্তর অন্তর ৫০ গ্রাম করে ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করা যেতে পারে। প্রতি ১৫ দিন অন্তর অন্তর জাল টেনে মাছের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করে সম্পূরক খাদ্যের পরিমাণ পুননির্ধারণ করতে হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী পুকুরের বাইরে হতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। এবং পুকুরের পানির পিএইচ মাছ চাষের উপযোগী মাত্রায় রাখার জন্য প্রতি মাসে একবার ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম চুন প্রয়োগ করতে হবে।
মাছ আহরণ ও উৎপাদন:
এ পদ্ধতিতে ৪ থেকে ৫ মাস মাছ চাষ করার পর মাছের ওজন ১৮০ থেকে ১৯০ গ্রাম ওজনের হবে। তখন তা বিক্রির জন্য আহরণ করতে হবে। পুকুরে বেড় জাল টেনে এবং পরবর্তীতে শুকিয়ে সমস্ত মাছ আহরণ করা যায়। এবং আধা নিবিড় পদ্ধতিতে লাল তেলাপিয়া মাছ চাষ করে ৪ থেকে ৫ মাসে প্রতি হেক্টরে ৭ থেকে ৮ টন মাছ উৎপাদন সম্ভব।
লাল তেলাপিয়া মাছের রোগ ও প্রতিকার:
লাল তেলাপিয়া একটি উচ্চ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন মাছ। তবে উচ্চ মজুদ ঘনত্ব ও বদ্ধ জলজ পরিবেশে পরিত্যক্ত খাবার, মাছের বিপাকীয় বর্জ্য ও অন্যান্য আবর্জনা পচনের ফলে পানি দূষিত হয়ে অনেক সময়ে রোগের ঝুকি বৃদ্ধি করে। সাধারণত লাল তেলাপিয়া স্ট্রেপটোকক্কাস ও এরোমোনাস সেপটিসেমিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। এরুপ অবস্থায় ১ থেকে ২ গ্রাম ইরাইথ্রোমাইসিন বা অক্সিটেট্রাইক্লিন প্রতি কেজি খাবারে মিশিয়ে ৫ থেকে ৭ দিন খাওয়াতে হবে। এবং আক্রান্ত পুকুরে প্রতি শতাংশে ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম চুন প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
পরামর্শ:
প্রজনন পুকুরে স্ত্রী ও পুরুষ মাছের অনুপাত সঠিক হারে হতে হবে। রেণু পোনা স্থানান্তর খুব ভোরে করা উচিত। লাল তেলায়িার সাথে গিফট তেলাপিয়ার যাতে মিশ্রণ না ঘটে সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। পোনা উৎপাদন পুকুর সব সময় পরিস্কার ও প্রয়োজনীয় পরিমানে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পুকুরের ৩-৪টি স্থান নির্বাচন করে ঐ স্থানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি মাসে মাছের নমুনা গ্রহণ করে মজুদকৃত মাছের মোট দৈহিক ওজনের ভিত্তিতে খাদ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। মেঘলা দিনে স্বাভাবিকের চেয়ে কম খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। শীতকালে খাদ্য প্রয়োগের হার স্বাভাবিকের চেয়ে অর্ধেক বা তিন ভাগের এক ভাগ কমিয়ে আনতে হবে এবং মাছ ঠিক মতো খাদ্য খায় কিনা তা পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হবে।
লিখেছেন:
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, স্বাদুপানি কেন্দ্র, ময়মনসিংহ এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এএইচএম কোহিনুর ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মশিউর রহমান।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১১মার্চ২০