শাপলা বেচে জীবিকা নির্বাহ

720

mbg120170715183639

রুবেল ইসলাম, মুন্সীগঞ্জ থেকে:  মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে তেইশ বছর ধরে শাপলা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে আমেনা বেগম। তার দুই ছেলে ও তিন মেয়ে মিলে বছরের কয়েক মাস তারা শাপলা বিক্রি করেন। মূলত এ চার-পাঁচ মাস শাপলার সঙ্গেই ছয়জনের এ পরিবারটির বসবাস।

বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা। বর্ষার পানিতে ভাসমান ফুলের সৌন্দর্য ছড়ানো ছাড়াও শবজি হিসেবে রয়েছে শাপলার বাড়তি কদর। সে কারণে বর্ষা মৌসুমে শাপলার হাট বসে কোথাও কোথাও। তেমনি বাড়ি বাড়ি ফেরি করে বিক্রি হয় শহরসহ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। শাপলা বিক্রি করে এসময় অনেকেই দুটো বাড়তি টাকা আয় করেন। অনেকে আবার বর্ষা এলেই সাজিয়ে বসেন শাপলার পসরা। তেমনি একজন আমেনা বেগম। সঙ্গে তার আরও পাঁচ ছেলে-মেয়ে। ছয়জন মিলে বর্ষার চার-পাঁচ মাস শাপলা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা। তবে এ পেশায় শুধু আমেনা বা তার পরিবারই নয় শাপলার সঙ্গে বসবাস লৌহজংও শ্রীনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার পরিবারের।

স্থানীয়রা জানান, চার থেকে পাঁচ মাস কৃষি জমি পানির নিচে থাকায় এ মৌসুমে কৃষকের তেমন কোনো কাজ নেই। তাই এলাকার অনেক কৃষক এ পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন। কোনো পুঁজির প্রয়োজন না হওয়ায় বিভিন্ন বয়সের মহিলা পুরুষ এ পেশায় অংশ নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

লৌহজংয়ের কয়েকটি ইউনিয়নে প্রচুর শাপলা জন্মে। এ কারণে নিয়মিত বসে শাপলার বাজার। মাওয়া চৌরাস্তার পশ্চিমে খুব ভোরে নামাজ পড়ে উপজেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন ছুটে আসে পরিবার পরিজনকে নিয়ে এ বাজারে। প্রতিদিন সকালে বেশ জমে উঠতে থাকে শাপলাসহ সবজির বাজারটি।

এ বাজারেই শাপলা বিক্রি করতে আসেন আমেনা। তিনি শাপলা সংগ্রহ করেন মেদিনীমন্ডল বিল থেকে।

আমেনা বেগম জানান, ১২বছর ধইরা স্বামী নাই আমার সংসারে। পুলাপাইনগ লইয়া করুম কি সংসারের কাজের শেষে দুই পুলা তিন মাইয়াসহ প্রতিদিন ৫/৬ঘণ্টা একেক জন কমপক্ষে ৬০ থেকে ৭০ মুডা শাপলা উডাইতে পারি। এতে খুব কষ্ট হয় সংসার চালাইতে।”

তিনি বলেন, “আষাঢ় থেকে শুরু করে ভাদ্র পর্যন্ত তিন মাস বেশি শাপলা পাওয়া যায়। কোন রকম পুঁজি ছাড়াই শাপলা টুকাইয়া আইন্না বেচি। তাদিয়া যা হয় ৫/৬ ডা পুলাপান লইয়া ২৩বছর ধইরা দুঃখ কষ্ট কইড়া দুগা ভাত খাইতে পাড়ি। তয় সরকার বলে কতকিছু দেয় গরীবগো। না পাই কোন সরকারি চাউল, বা দানদক্ষিণা। এসব ছাড়াই বেশ ভালো দিন কাটাইতাছি “

তিনি জানান, দিনের শেষে পাইকাররা তাদের সংগ্রহকারীরদের কাছ থেকে এসব শাপলা সংগ্রহ করেন। পরে তারা একত্রে করে নিয়ে যান শহর এলাকায়। অল্পদামে কিনে ট্রাকে করে নিয়ে বেশি দামে বিক্রি করেন। সেই সাথে স্থানীয় স্বছল ও শাপলাপ্রিয় মানুষগুলো ছুটে আসেন এই পদ্মা পাড়ে।

কোলাপাড়া, মাহমুদপট্টি, রসুনিয়া, বন্দিছড়া, কান্দিপাড়া, সমষপুর, ইমামগঞ্জ, শিমুলতলা, চারিপাড়া, তালতলা, বালাশুর ,পশ্চিম কুমারভোগ, খানবাড়ী, কউট্টাহার, দোগাছি, ছন বাড়ীর মোড় ও আড়িয়াল বিলের পাশে শাপলার পাইকারি ক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। পাইকাররা এখান থেকেই নিয়মিত শাপলা ক্রয় করে ঢাকার যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন পাইকারি বাজারে বিক্রি করে থাকেন।

ঢাকার পাইকার মো. মনির মিঞা নিউজবাংলাদেশকে জানান, শাপলা সংগ্রহকারীদের থেকে এক মুঠা শাপলা ২৫ টাকা দরে ক্রয় করা হয়। তারপর গাড়ি ভাড়া গড়ে ৩ টাকা, লেবার ১ টাকা, আড়ত খরচ ২ টাকাসহ মোট ৩১ থেকে ৩২ টাকা খরচ পড়ে। যাত্রাবাড়ী আড়তে শাপলা বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৬০ টাকা মুঠা।

মুন্সীগঞ্জ সদরসহ বেশ কিছু এলাকায় বেকার হয়েপড়া কৃষক ও অভাবী দিনমজুর লোকজনেরাও শাপলা বিক্রির সঙ্গে জড়িত। এলাকাবাসী জানান, বর্ষায় ডুবে যাওয়া ধান, পাট ও ধঞ্চে ক্ষেতে শাপলা বেশি জন্মায়। শাপলা সংগ্রহকারীরা ভোরে ডিঙ্গীনৌকা নিয়ে ডুবে যাওয়া জমিতে ও বিলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে শাপলা তোলেন। কয়েকজন শাপলা সংগ্রহকারী বলেন, এ মৌসমে একেকজন কমপক্ষে ৪০ থেকে সর্বোচ্চ ৭০ মোঠা (৭০/৮০টিতে ১ মুঠা) সংগ্রহ করতে পারেন। তেমনি ঢাকাসহ দূর দূরান্তের পাইকারাও এখানে আসে তাজা শাপলা কিনতে। তবে দাম একটু চওড়া হলেও তাজা শাপলার কোন প্রকার জুড়ি নেই।

তারা জানান, দিন শেষে ৪০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা আয় করে থাকেন সংগ্রহকারীরা। বছরের ৩ মাস এ কাজ করেন পাইকাররা। লৌহজং ও সিরাজদিখান আর শ্রীনর উপজেলার হাসাড়াও আড়িয়ল বিল এলাকায় প্রায় ৫ হাজার শাপলা কুড়ানো পেশায় জড়িত পরিবার রয়েছে।

উপজেলার সমষপুর গ্রামের পাইকার রাজা মিয়া জানান, শাপলা সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার থেকে দুই হাজার মুঠা শাপলা ক্রয় করে থাকেন। সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে এক মুঠা শাপলা ২৫-৩০ টাকা দরে ক্রয় করেন তিনি। তারপর ট্রাক ভাড়া গড়ে ৩ টাকা, লেবার ১ টাকা, আড়ত খরচ ২ টাকাসহ পায় ৩৭ টাকার মতো খরচ পড়ে।

এই বিষয়ে জেলার কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির জানান, শাপলা আসলে কোন কৃষি পণ্য আওয়াতাভুক্ত নয়। এটি প্রাকৃতিকভাবে কৃষি জমি ও পুকুর কিংবা ডোবাতে জন্ম নেয় ,এই বিষয়ে আমাদের কোন পরামর্শ দেয়ার সুযোগ হয়ে উঠে না। তবে আমরা চেষ্টা করি কৃষকদের সহায়তা করার। এছাড়াও আমারা কৃষকদের শাপলা বেশি দিন সংরক্ষণ করার পরামর্শ দিয়ে থাকি।

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম