সুনামগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলে নিরাপদ পোল্ট্রি পালন বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত

324

[metaslider id=”14618″]

ঘূর্ণিঝড় ফণির প্রভাবে সারাদেশে যখন ঝড়োহাওয়া ও বৃষ্টির কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত ঠিক তখন সিলেটের সুনামগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হলো নিরাপদ পোল্ট্রি পালন বিষয়ক কর্মশালা।

দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া উপেক্ষা করেই খামারিরা উপস্থিত হলেন অনুষ্ঠানস্থলে। গত ৪ মে স্থানীয় একটি কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠিত হলো সুনামগঞ্জের কর্মশালাটি অন্যদিকে উপজেলা কৃষি অফিসের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হলো শ্রীমঙ্গলের কর্মশালা।

ঝড়ো বাতাস ও বৃষ্টির মধ্যে বিপিআইসিসি’র প্রতিনিধিদল যখন সুনামগঞ্জের কর্মশালায় উপস্থিত হলেন তখন প্রায় কানায় কানায় ভর্তি ছিল লতিফা কমিউনিটি সেন্টারের সম্মেলন কক্ষ। বিপিআইসিসি’র উপদেষ্টা শ্যামল কান্তি ঘোষ উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন- সুনামগঞ্জের খামারিদের কাছে হার মানল ঘূর্ণিঝড় ফণি।

খামারিরা বললেন, খামার ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের মাধ্যমে কিভাবে উৎপাদন খরচ কমানো যায় তা জানতেই তারা বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে উপস্থিত হয়েছেন।

খামারিরা অভিযোগ করে বললেন, ডিলার ও ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভদের ভুল পরামর্শের কারণে তারা ওষুধের ওপর অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন ফলে লাভের টাকা ঘরে তুলতে পারছেন না।

সুনামগঞ্জের নারী খামারি রোকেয়া বেগম বললেন, একেবারে শুরু থেকেই তাদের বিভিন্ন ধরনের ওষুধ, ভিটামিন, প্রোটিন খাওয়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়।

রোকেয়া বলেন, ওষুধ খাওয়ালেই তাদের মুরগি ভাল থাকে, না খাওয়ালেই অসুস্থ হয়ে যায়।

অপর একজন নারী খামারি জাহেদা অভিযোগ করে বললেন, একদিন বয়সী বাচ্চা দেয়ার সময় ডিলাররা ভালো ও খারাপ বাচ্চা মিশিয়ে দেয়। ফলে বেশি দাম দিয়ে কিনেও আশানুরূপ ফল পাচ্ছেন না তারা।

পুরুষ খামারিদের অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, ডিলারদের কাছে তারা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাচ্চার প্যাকেট ও ফিডের প্যাকেটের গায়ে লেখা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য মুছে ফেলা হয়, ফলে অধিক মূল্যে ফিড ও বাচ্চা কিনতে বাধ্য হন তারা।

সুনামগঞ্জের কর্মশালায় নিরাপদ পোল্ট্রি উৎপাদন ও জীবনিরাপত্তা বিষয়ে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. হাবিবুর রহমান। খামারিদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন ডা. হাবিবুর রহমান ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ইনচার্জ) তপন কান্তি পাল।

ডা. হাবিবুর রহমান জানান, সুনামগঞ্জে ব্রয়লার ও লেয়ার খামারের মোট সংখ্যা ১০০০টি, হাঁসের খামারের সংখ্যা ২০০০টি। লেয়ার খামারের সংখ্যা নগণ্য হলেও ডিম উৎপাদনের দিক থেকে অনেক এগিয়ে সুনামগঞ্জ। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবছর প্রায় দুই কোটি ডিম জেলার বাইরে সরবরাহ করা হয় তবে সেগুলো মূলতই হাঁসের ডিম।

৫ মে শ্রীমঙ্গলে অনুষ্ঠিত কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিলেটের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডা. আবুল কাশেম।

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম, সন্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ নিলুফার ইয়াসমিন মোনালিসা সুইটি।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এবিএম সাইফুজ্জামান। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বিপিআইসিসি’র যোগাযোগ ও মিডিয়া উপদেষ্টা মো. সাজ্জাদ হোসেন এবং কর্মকর্তা আবু বকর।

কর্মশালার সমন্বয়কারি উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. রুহুল আমিন জানান, এ উপজেলায় মোট মুরগির সংখ্যা ৪,৪০,৬১৩ টি এবং হাঁসের সংখ্যা ৮৫,৪৪৫ টি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও বিপিআইসিসি’র যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী শ্রীমঙ্গল উপজেলায় মোট খামারের সংখ্যা ৯৭টি- এর মধ্যে ৯১টি ব্রয়লার ও ৬টি লেয়ার খামার রয়েছে। নিবন্ধিত খামারের সংখ্যা মাত্র ১৪টি যার মধ্যে ১১টি ব্রয়লার এবং ৩টি লেয়ার খামার।

শ্রীমঙ্গলের খামারি মতিউর রহমান বলেন, খামারিরা অনেক কষ্টে দিন পার করছে, অনেককেই ভিটামাটি বিক্রি করে দিতে হয়েছে। কৃষকদের যেমন সারে ভর্তুকী দেয়া হয় তেমনি পোল্ট্রি খামারিদের জন্য ফিডে ভর্তুকীর দাবি জানান তিনি।

খামারি তুহিন চৌধুরি জানান, কৃষকরা ঋণ পেলেও ক্ষুদ্র খামারিরা কোন ঋণ পাচ্ছেন না।

পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাবিবুর রহমান বলেন, মাত্র ২/৩ দিনের ব্যবধানে মুরগির দাম কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত কমে যাচ্ছে। এ অস্বাভাবিক উঠানামা বন্ধে উদ্যোগ নিতে হবে, একই সাথে অপপ্রচার বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত হোসেন বলেন, একটি বিদেশি কোম্পানির কারণে স্থানীয় খামারিরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। তারা যখন মার্কেটে মুরগি ও বাচ্চা ছাড়ছে তখন বাজারে দরপতন হচ্ছে। ক্ষুদ্র খামারিদের রক্ষার স্বার্থে এ ধরনের বিদেশি কোম্পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি বাড়ানো দাবি জানান তারা।

কর্মশালা দু’টির উন্মুক্ত আলোচনা থেকে জানা যায়- ভূ-প্রকৃতিগত দিক থেকে সিলেট দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা হলেও বিগত বছরগুলোর তুলনায় বর্তমানে এ অঞ্চলের খামারিদের উৎপাদন খরচ বেশ খানিকটা বেড়েছে। রোগজীবানুর সংক্রমণের কারণে খামারিদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে। সে প্রেক্ষাপটে জীবনিরাপত্তাই হতে পারে সবচেয়ে বড় রক্ষাকবজ।

এন্টিবায়োটিকের দায়িত্বশীল ব্যবহার ও ছোট-বড় সব ধরনের খামার, হ্যাচারি ও ফিড মিলগুলো সরকারিভাবে নিবন্ধনের ওপর জোর দেন বিপিআইসিসি’র সচিব দেবাশিস নাগ। তিনি বলেন, মাঠ পর্যায়ে অপ্রয়োজনীয় ওষুধের ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বিপিআইসিসি’র উপদেষ্টা শ্যামল কান্তি ঘোষ বলেন, পোল্ট্রিতে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ, অ্যাডিটিভসের ব্যবহার একেবারেই কাম্য নয়।

তিনি বলেন, খামারিদের সচেতন হতে হবে এবং নিরাপদ পোল্ট্রি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস ও কর্তব্যরত ভেটেরিনারি ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন জনাব শ্যামল কান্তি ঘোষ।

সুনামগঞ্জের কর্মশালায় ৬০ জন এবং শ্রীমঙ্গলের কর্মশালায় ৭০ জন খামারি অংশগ্রহণ করেন।

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/ মোমিন