স্ট্রবেরির ফলন বৃদ্ধিতে চিংড়ির খোলসের জৈব সার!

570

স্পট্রবরি

স্ট্রবেরি গাছে বেশি পরিমাণে ফুল ধরানোর জন্য প্লাস্টিক ও খড়ের ব্যবহার হয়ে এসেছে এতদিন। আবার মাটি ও বায়ুবাহিত বিভিন্ন রোগ ও কীটপতঙ্গ থেকে স্ট্রবেরির গাছ ও ফলকে রক্ষা করার জন্য কৃষকরাও উচ্চমাত্রার সিনথেটিক বালাইনাশক ব্যবহার করে এসেছেন। এসব কীটনাশক যেমন ভোক্তাস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি, তেমনি প্লাস্টিকের ব্যবহারও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। স্ট্রবেরি আবাদের ক্ষেত্রে এসব রাসায়নিক সার, কীটনাশকের ও প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোয় তথা পরিবেশগত ঝুঁকি হ্রাসের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে চিংড়ির খোলস।

সাধারণত স্ট্রবেরির গাছ লাগানোর পর এর গোড়া থেকে প্রচুর রানার বা কচুর লতির মতো লতা বের হতে থাকে। এগুলো জমি ঢেকে ফেলার কারণে ফলন ভালো হয় না। এসব লতা যাতে কম বের হয়, সেজন্য গাছের গোড়ায় খড় বা পলিথিন বিছিয়ে দিতে হয়। এ পদ্ধতিতে একটি পলিথিন শিটকে ৩০ সেন্টিমিটার পরপর গোলাকার ছিদ্র করে স্ট্রবেরি গাছের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিতে হয়। এভাবে ফলন বাড়াতে গিয়ে একই সঙ্গে বেড়ে যায় প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ। কিন্তু এখন থেকে সেটির ব্যবহার আর প্রয়োজন হবে না।

কোনো সিনথেটিক ও বালাইনাশকের ব্যবহার ছাড়াই উচ্চমানের স্ট্রবেরি উৎপাদনের জন্য একটি পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ জৈবপ্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন দুই গবেষক। তাদের এ গবেষণার ফলাফল সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী প্লস ওয়ানে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমআরএইউ) ও যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হয়েছে গবেষণাটি। ‘প্রাকৃতিক বায়োপলিমার কিটোসান প্রয়োগে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ স্ট্রবেরির ফলন বৃদ্ধি’ শীর্ষক গবেষণায় নেতৃত্ব দেন বিএসএমআরএইউর জীবপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. তোফাজ্জাল ইসলাম এবং প্রধান অনুসন্ধানকারী হিসেবে গবেষণায় ছিলেন ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. মাহফুজুর রহমান।

গবেষণায় বলা হয়েছে, চিংড়ি শিল্পের বর্জ্য খোলস থেকে তৈরি করা হয়েছে প্রাকৃতিক কিটোসান। রাসায়নিক বালাইনাশকের কোনো ধরনের ব্যবহার ছাড়াই এ কিটোসান প্রয়োগ করে স্ট্রবেরির ফলন ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব। এ প্রাকৃতিক কিটোসান ব্যবহারে স্ট্রবেরির ফলন বাড়ে দুই থেকে তিন গুণ। এছাড়া এতে ফলে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান যেমন ফেনলিক ও ভিটামিন সির উপস্থিতিও বাড়ে। উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কার্যকলাপসমৃদ্ধ এ স্ট্রবেরি ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ থেকে মানুষের রক্ষাকবচ হিসেবে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।

অধ্যাপক ড. মো. তোফাজ্জাল ইসলাম বলেন, চিংড়ির বাহ্যিক খোলস থেকে তৈরি পলিমার কিটোসান প্রয়োগে উচ্চ গুণগত মানসম্পন্ন ও অধিক ফলনশীল স্ট্রবেরি উৎপাদনের কৌশল আবিষ্কার করা হয়েছে। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করেই উচ্চমানের স্ট্রবেরি উৎপাদনের জন্য জৈব উদ্দীপক হিসেবে কিটোসান ব্যবহার করা যাবে।

স্প্রবেরি

প্রাকৃতিক জৈব উদ্দীপক হিসেবে কিটোসান ব্যবহারের মাধ্যমে স্ট্রবেরির উৎপাদন বৃদ্ধির কৌশলটি নতুন কিছু সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। স্ট্রবেরি উৎপাদনের অনুষঙ্গ হিসেবে স্থানীয় চিংড়ি শিল্পের বর্জ্য থেকে তৈরি কিটোসানের নিজেরই বেশ শিল্প সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাকৃতিক এ পদার্থ প্রয়োগ করলে তা মাটির স্বাস্থ্যহানি ঘটাবে না। পাশাপাশি পরিবেশগত দূষণ কমাবে এবং পরিবেশে সিনথেটিক রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে উত্পন্ন গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণও কমাবে। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, এতে স্ট্রবেরির উৎপাদন খরচ কমবে।

জানা গেছে, স্ট্রবেরি গাছের শিকড় মাটির ওপর দিকে থাকে। এজন্য মাটি ঝুরঝুরা করে নির্ধারিত মাত্রায় সার ও জৈব সার প্রয়োগ করতে হয়। এজন্য প্রতি একরে ৫০-৬০ কেজি ইউরিয়া সার, ৭০ কেজি টিএসপি সার এবং ৮০ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হয়। কিটোসান প্রয়োগে এগুলোর ব্যবহার তথা উৎপাদনের ব্যয় কমবে। দেশের কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাসের জন্য বিকল্প প্রযুক্তি হিসেবে অত্যন্ত কার্যকর এক উপায় হতে পারে পদ্ধতিটি।

বাংলাদেশে স্ট্রবেরির আবাদ সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম মনজুর হোসেন। তিনি ১৯৯৬ সালে জাপান থেকে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য জাতের স্ট্রবেরি বাংলাদেশে নিয়ে এসে প্রথম আবাদ করেন। অত্যন্ত পুষ্টিগুণসম্পন্ন ফল স্ট্রবেরি ক্যারটিনয়েড, ভিটামিন, অ্যানথোসায়ানিন, ফেনলস, ফ্ল্যাভনয়েডসহ প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের অত্যন্ত কার্যকর একটি উৎস।

গবেষকরা বলছেন, স্ট্রবেরি ফলে বিদ্যমান মেজর ফেনোলিক যৌগ বা ফ্ল্যাভনয়েড উপাদানে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ক্যান্সার প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। উচ্চমাত্রার সেকেন্ডারি মেটাবলাইটযুক্ত স্ট্রবেরি মানুষের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়তা করে। দেখা গেছে, কিটোসান প্রয়োগের মাধ্যমে স্ট্রবেরিতে সেকেন্ডারি মেটাবলাইট অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পরিমাণ বেড়ে যায়। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্ট্রবেরির বাণিজ্যিক চাষাবাদ করলে তা ভোক্তাদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যরক্ষায় অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে জানিয়েছেন ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. মাহফুজুর রহমান।

তিনি বলেন, স্ট্রবেরি বিভিন্ন ছত্রাক ও অণুজীবঘটিত রোগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সংবেদনশীল। বাংলাদেশের উচ্চ আর্দ্রতা এবং উষ্ণ আবহাওয়া রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটানোর জন্য অনুকূল। রোগ একটি বড় সমস্যা হয়ে উঠতে পারে, যদি একই জমি একই ফসলের বারবার উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন কীটপতঙ্গ থেকে এ নতুন ফসল রক্ষা করতে বাংলাদেশের স্ট্রবেরি চাষীরা অননুমোদিতভাবেই অনেক কৃত্রিম রাসায়নিককে ককটেল হিসেবে ব্যবহার করেন। এটি মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কিটোসান ভ্যাকসিন হিসেবেও কিছু রোগের বিরুদ্ধে বেশ শক্তিশালী দমনকারী হিসেবে কার্যকর।

রাসায়নিক কৃত্রিম বালাইনাশকের বিকল্প হিসেবে এবং বাংলাদেশের নিরাপদ ও সুস্বাদু স্ট্রবেরির টেকসই উৎপাদন বাড়ানোর জন্য জৈব উদ্দীপক হিসেবে এ প্রাকৃতিক সারটিকে শিল্পায়িত করা উচিত। সূত্র: বিবি।

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন