১০ কেজি মরিচে এক কেজি চাল!

344

পাঁচ টাকা কেজিতে চাষিদের কাছ থেকে কাঁচা মরিচ কিনছেন নীলফামারী বড় বাজারের আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ী মো. নুরু ইসলাম। এসব মরিচ তিনি পাইকারিতে ১০-১২ টাকা বিক্রি করছেন। তার কাছ থেকে কিনে ২০-২৫ টাকা কেজি বিক্রি করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। তাদের লাভ হলেও চরম লোকসানে পড়েছেন মরিচ চাষিরা। ক্ষোভে তারা বললেন, আগামী বছর থেকে মরিচ চাষ করবেন না।

বুধবার (১৬ জুন) ও বৃহস্পতিবার (১৭ জুন) জেলা শহরের বড় বাজার, কিচেন মার্কেট, ডোমারের মটকপুর বাজার, পাঙ্গা চৌপতির বাজার ও ডিমলা বাজারে পাঁচ টাকা কেজিতে মরিচ বিক্রি করেছেন চাষিরা।

বড় বাজার ও কিচেন মার্কেটের খুচরা ব্যবসায়ী বুলু মিয়া ও ইলিয়াস আলী জানান, মরিচের মৌসুম প্রায় শেষ। বর্ষায় মরিচের ফলন কম হওয়ায় খুচরা বাজারে কেজিতে দাম বেড়েছে ৮-১০ টাকা। আমরা ২৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করছি। পাইকারিতে মণ কিনেছি ৪৫০ টাকা।

চাষিদের অভিযোগ, মৌসুমের শুরুতে আবাদের খরচ না ওঠায় অনেক চাষি ক্ষেত থেকে মরিচ তোলেননি। ক্ষেতেই মরিচ নষ্ট হয়েছে। লোকসানের ভয়ে অনেকেই মরিচ তুলছেন না।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে এক হাজার ৭৭৫ হেক্টর জমিতে মরিচ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে কৃষি বিভাগ। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অর্জিত জমির পরিমাণ এক হাজার ৮০০ হেক্টর। ২৫ হেক্টর জমিতে অতিরিক্ত মরিচ চাষ হয়েছে। সদরে ২৯০, সৈয়দপুরে ২৫, ডোমারে ৭৮০, ডিমলায় ৫৪০, জলঢাকায় ৮০ ও কিশোরগঞ্জে ৮৫ হেক্টর জমিতে মরিচ চাষ হয়েছে।

কিচেন মার্কেটের মরিচের আড়ত ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা বাজারে ২০-২৫ টাকা কেজিতে কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১০-১২ টাকা।

সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসান বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার মরিচের বাম্পার ফলন হয়েছে। মাঠপর্যায়ে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় লোকসানের মুখে পড়েছেন। ক্ষতি উত্তরণের একমাত্র উপায়; গাছে মরিচ পাকিয়ে ঘরে তোলা।

ডোমার উপজেলার মটকপুর ইউনিয়নের পাঙ্গা গ্রামের মরিচ চাষি রহিদুল ইসলাম বলেন, এবার এক বিঘা জমিতে মরিচ চাষ করেছি। ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু বাজারে পাঁচ টাকা কেজিতে মরিচ বিক্রি করেছি। অথচ আমার কাছ থেকে মরিচ কিনে পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা দুই-তিনগুণ বেশি দামে বিক্রি করছেন। ক্ষেত থেকে মরিচ ছিঁড়াই বাদ দিয়েছি। মরিচ ছিঁড়তে যে টাকা খরচ হয়, বিক্রি করেও তা ওঠে না। ভ্যান ভাড়া নিজের পকেট থেকে দিতে হয়। মরিচ চাষ বাদ দিয়ে আগামীতে ভুট্টা চাষ করবো।

উপজেলার মরিচ প্রধান পাঙ্গা চৌপতির বাজারে দেখা যায়, ওই ইউনিয়নের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে আসা নারী-পুরুষ কাঁচা মরিচ স্তূপ করে রেখেছেন। এই বাজারে হাইব্রিড কাঁচা মরিচের মণ ২০০-২৫০ টাকা, বিন্দু মরিচের মণ ২৫০-২৮০ টাকা, জিরা মরিচের মণ ৩০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।

ডিমলা উপজেলার খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের খগাখড়িবাড়ী গ্রামের মরিচ চাষি বাবলুর রহমান বলেন, মরিচের বাম্পার ফলন হলেও এবার বাজার দর খুবই খারাপ। ওষুধ, হালচাষ, সেচ, সার, চারা, মজুরি ও পরিবহন খরচসহ বিঘাপ্রতি খরচ হয়েছে ১২-১৫ হাজার টাকা। এক বিঘায় মরিচ ফলে ২৫-৩০ মণ। প্রতি কেজি পাঁচ টাকা হলে মণ ২০০ টাকা। বিঘায় পাঁচ-ছয় হাজার টাকা। এতেই বোঝা যায় কৃষক শেষ। অথচ খুচরা ও পাইকাররা বাজারে দ্বিগুণ দামে মরিচ বিক্রি করেন।

একই এলাকার মরিচ চাষি রোস্তম আলী জানান, গত বছর মরিচের বাজার ভালো ছিল। তিন হাজার টাকা পর্যন্ত মণ বিক্রি হয়েছিল। এবার সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা বিক্রি হয়েছে প্রথম দিকে। তারপর দাম কমতে কমতে ২০০-২৫০ টাকায় নেমেছে। বারবার মরিচ চাষে আমি ক্ষতিগ্রস্ত। আগামীতে পাট ও ভুট্টা চাষের চিন্তাভাবনা করছি।

মৌসুমের শুরুতে আবাদের খরচ না ওঠায় অনেক চাষি ক্ষেত থেকে মরিচ তোলেননি
পাঙ্গা চৌপতির বাজারে মরিচ বিক্রি করতে আসা শফিকুল ইসলাম (৩০) বলেন, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মরিচ চাষ করে দাম পাই না। অথচ পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা দ্বিগুণ লাভ করে। কৃষকের খবর কেউ রাখে না। করোনায় আয়-রোজগার নেই, এখন মরিচ চাষ করে দাম পাই না। এভাবে চললে চাষাবাদ করে আমাদের মরণ ছাড়া উপায় নেই। চাল, ডাল ও তেল কিনতে বাজারে গিয়ে দিশেহারা। ১০ কেজি মরিচ বিক্রি করে এক কেজি চাল কিনি। কোথায় যাবো আমি?।

নীলফামারী বড় বাজারের আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ী মো. নুর ইসলাম বলেন, বগুড়া, পাবনা এবং কুষ্টিয়া জেলার ক্ষেতের মরিচ উঠেছে। নীলফামারীর মরিচ উঠেছে। একসঙ্গে এতো জেলার মরিচ ওঠায় বাজারে প্রভাব পড়েছে। তিন-চার টাকা কেজিতে মরিচ পাওয়া যাচ্ছে। তবে বৃষ্টি হলে দাম বাড়বে।

হাট ইজারাদার শফিকুল ইসলাম বলেন, এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় মরিচের বাম্পার ফলন হয়েছে। একসঙ্গে কুষ্টিয়া, পাবনা ও বগুড়া জেলার মরিচ উঠেছে। সেজন্য বাজার মন্দা যাচ্ছে। গতবারের চেয়ে এবার দাম কম পাওয়ায় চাষিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, মরিচের বাম্পার ফলন হয়েছে ঠিকই কিন্তু ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না চাষি। মরিচ গাছ থেকে ছিঁড়তে প্রচুর লোকবলের প্রয়োজন হয় এবং ব্যয়ও অনেক। এজন্য চাষিদের মরিচ পাকানোর পরামর্শ দিচ্ছি। পাকা মরিচের চাহিদা ও লাভ বেশি। আশা করি, ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা শুকনো মরিচ বিক্রি করে লাভবান হবেন।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

ফার্মসএন্ডফার্মার/ ১৯জুন ২০২১