ভ্যানামী চিংড়ির দাপটে কমছে বাগদা চিংড়ির রপ্তানি

1628

বাগদা

বাংলাদেশি বাগদা চিংড়ির রপ্তানি বাজার দখল করে নিচ্ছে ‘ভ্যানামী’ চিংড়ি নামের একটি প্রজাতি। দ্রুত বর্ধনশীল, অধিক উৎপাদন এবং মূল্য কম হওয়ার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমাগতভাবে ভ্যানামী চিংড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশেও ভ্যানামী চিংড়ি চাষ শুরু করার প্রস্তাব দিয়েছে রপ্তানিকারকরা।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক সমিতির (বিএফএফইএ) সহসভাপতি দেবব্রত বড়ুয়া বলেন, ‘‘পাইলট প্রজেক্টের মাধ্যমে বাংলাদেশে ভ্যানামী চিংড়ি চাষ শুরু করার জন্য মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহযোগিতা পেলে টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহার করে চিংড়ি চাষিদের উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে আমাদের দেশেও ভ্যানামী চিংড়ি উৎপাদন করতে পারব।’’

তিনি আরো বলেন, “অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা কক্সবাজার জেলার চকরিয়ার রামপুর মৌজায় ৪৮ একরের সরকারি খাসজমি এবং খুলনা অঞ্চলের পাইকগাছার বিএফআরআইয়ের অধীন জমিতে মৎস্য অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক সমিতির (বিএফএফইএ) যৌথ উদ্যোগে পাইলট প্রকল্প করার জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।”

জানা গেছে, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, স্পেন, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশে এশিয়ান হিমায়িত চিংড়ির বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। ভ্যানামী প্রজাতিটি উত্তর আমেরিকার হলেও বিগত সাত-আট বছর ধরে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, চীন ও ভারতে ব্যাপকভাবে এই চিংড়ি চাষ হচ্ছে। ওই দেশগুলো ভ্যানামী অধিক হারে চিংড়ি উৎপাদন করে আন্তর্জাতিক বাজারগুলো দখল করে নিচ্ছে। এতে করে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো ভ্যানামী চিংড়ি উৎপাদনের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হচ্ছে।

রপ্তানিকারকরা বলেন, বাংলাদেশে প্রতি হেক্টরে ৩০০ থেকে ৪০০ কেজি বাগদা চিংড়ি উৎপাদন হয়। আর ভারতে প্রতি হেক্টরে ভ্যানামী চিংড়ি চাষ হয় প্রায় ছয় মেট্রিক টন। সনাতনী প্রক্রিয়ায় চিংড়ি চাষের কারণে এ দেশে চিংড়ির উৎপাদন হার বিশ্বে সর্বনিম্নে। তাই এ দেশের চিংড়ি রপ্তানিজাতকরণ শিল্প-কারখানাগুলো কাঁচামালের অভাবে উৎপাদন ক্ষমতার ২০ শতাংশও ব্যবহার করতে পারছে না। বিশ্ব রপ্তানি বাণিজ্যে টিকে থাকা ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর স্বার্থে বাংলাদেশেও ভ্যানামী চিংড়ি চাষ করা প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন চিংড়ি রপ্তানিকারকরা।

রপ্তানিকারকরা জানান, দেশে বর্তমানে ১১০টি হিমায়িত চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু কাঁচামালের অভাবে এসব কারখানার মালিক রপ্তানি করতে পারছে ৫০ হাজার মেট্রিক টনের নিচে। অর্থাৎ কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতার ২০ শতাংশ কাঁচামালও পাচ্ছে না।

রপ্তানিকারকরা আরো জানান, বাংলাদেশ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪৭ হাজার ৬৩৫ মেট্রিক টন। ওই বছর এই খাতে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির পরিমাণ এবং রপ্তানি আয় দুটিই কমেছে। পরবর্তী বছরগুলোতে ভ্যানামী চিংড়ির কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় আরো কমতে শুরু করে। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ৭০৬ মেট্রিক টন। আর রপ্তানি আয় হয়েছে ৪৪৬ মিলিয়ন ডলার। এই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চার বছরের ব্যবধানে রপ্তানি আয় কমেছে ১০৪ মিলিয়ন ডলার। একইভাবে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির পরিমাণও কমেছে।

বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক সমিতির নেতারা প্রতিবেশী দেশ ভারতের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ২০১১-১২ অর্থবছরে ভারত বাণিজ্যিকভাবে ভ্যানামী চিংড়ি চাষ শুরু করে। ওই বছরই তারা ১৯ শতাংশ চিংড়ি উৎপাদন বাড়ায়। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে তারা ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটায়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ভারতে ভ্যানামী চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে ছয় লাখ মেট্রিক টন। চাষের মাধ্যমে চিংড়ি উৎপাদনকারী ৩৩টি দেশে ভ্যানামী চিংড়ি চাষ হয়। শুধু বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারে এখনো ভ্যানামী চাষ শুরু হয়নি।

মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, আমাদের দেশে উৎপাদিত বাগদা চিংড়ি বছরে দুবার উৎপাদন হয়। কিন্তু ভ্যানামী চিংড়ি সারা বছর হারভেস্ট করা যায়। ভ্যানামী চিংড়ি দ্রুত বর্ধনশীল এবং বাগদা চিংড়ির তুলনায় উৎপাদন খরচ কম। বিভিন্ন দেশে ভ্যানামীর চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এদিকে রপ্তানিকারকরা জানান, ভ্যানামী চিংড়ির উৎপাদন খরচ কম, রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন, পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর প্রতিক্রিয়াহীন এবং অধিক হারে সরবরাহ থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির দাম কেজিপ্রতি এক দশমিক পাঁচ ডলার থেকে দুই দশমিক তিন ডলার কমে গেছে। সূত্র: কেকে

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন