মুখ থুবড়ে পড়ার শঙ্কায় পোলট্রি শিল্প, উত্তোরণ কি অসম্ভব!

319

পোল্ট্রির শেড প্রস্তুত করা
দেশের পোলট্রির চাহিদা ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর থাকা সত্ত্বেও এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা রয়েছে চরম দুর্দশায়। সরাসরি সরকারি ইতিবাচক সাড়া না পেলে এবং এ শিল্পকে শিল্পের মর্যাদা না দিলে ভবিষ্যতে এ শিল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানা গেছে।

বিভিন্ন স্তরের পোলট্রি শিল্প মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেখানে প্রতি বছর এ শিল্প গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা সেখানে ক্রমান্বয়ে কমছে জ্যামিতিক হারে। শুধু কুমিল্লা জেলাতেই গত দুই বছরে প্রায় পাঁচশ’র অধিক ফার্ম বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হওয়ার উপক্রম রয়েছে আরো একাধিক ফার্ম। মালিকরা টিকে থাকতে বর্তমানে পোলট্রির সঙ্গে যুক্ত করেছে ডেইরি ও মৎস্য খামার।

জানা যায়, দেশের সম্ভাবনাময়ী ফুড শিল্পের মধ্যে পোলট্রি অন্যতম। নানাবিধ কারণে দেশীয় মুরগির তীব্র অপ্রতুলতা এবং অধিক জনসংখ্যার কারণে আমাদের দেশে পোলট্রির চাহিদা আকাশচুম্বি। সরকারের অদূরদর্শিতার কারণে সৃষ্টি হয়েছে মধ্যসত্বভোগী। এই মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটেই চলে যায় মুনাফার বিশাল একটি অংশ। এর পরের মুনাফাটা পায় খুচরা বিক্রেতারা। কিন্তু যারা গ্রামীণ মহাজন থেকে চড়া সুদে অর্থ লগ্নি করে ফার্ম দাঁড় করিয়েছে, লাভের অংশটা তাদের পকেটে যায় কালেভদ্রে।

কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর এই তিন জেলার একাধিক পোলট্রি ফার্মের মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব কারণে বর্তমানে পোলট্রি শিল্প মুখ থুবড়ে আছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- ১. এ শিল্পের প্রসারে সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই, ২. পোলট্রির জন্য সুনির্দিষ্টভাবে কোনো ব্যাংক ঋণ দেয়া হয় না, ৩. এ শিল্পের কোনো বীমা নেই, ৪. সরকারি মনিটরিংয়ের অভাব, ৫. শ্রমিক সংকট, ৬. ড্রেনেজ ব্যবস্থার সমস্যা, ৭. সরকারি নজরদারি না থাকায় ব্যাঙের ছাতার ন্যায় অনেক ওষুধ কোম্পানি সৃষ্টি হয়েছে তারা নিম্নমানের ওষুধ দিয়ে অল্প শিক্ষিত বা স্বশিক্ষিত পোলট্রি মালিকদের প্রতারিত করছে। যার নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে মুরগির স্বাস্থ্যের ওপর, ৮. খাদ্যের দাম বেশি, ৯. বিক্রয় ব্যবস্থাপনায় রয়েছে চরম অব্যবস্থাপনা, ১০. পরিবহন সংকট, ১১. পর্যাপ্ত চিকিৎসক না পাওয়া এবং ১২. পুলিশি চাঁদাবাজি ।

কীভাবে পোলট্রি শিল্পকে আরো এগিয়ে নেয়া যায় জানতে চাইলে বেশ কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরেন এর সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরা। এ প্রতিবেদককে তারা জানান, প্রথমেই সরকারকে পোলট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িত লোকদের সমন্বয় করে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করতে হবে। ১. যেই নীতিমালার ওপর এর বিকাশ এবং প্রসার হবে। ২. বর্তমানে আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো অলিখিতভাবে পোলট্রির ওপর থেকে ঋণ দেয়া বন্ধ করে রেখেছে যা দ্রুত প্রত্যাহার করে সহজ শর্তে কিংবা বিনা সুদে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের ব্যাংক ঋণ দিতে হবে, ৩. নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে খামার করতে হবে, ৪. পোলট্রি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক উপজেলাতেও দিতে হবে, ৫. বীমার ব্যবস্থা করতে হবে। ৬. বিক্রয় ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। যাতে পোলট্রি ভর্তি পরিবহনগুলো যখন মার্কেটে মার্কেটে যাবে এ সময় পুলিশের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। একইসঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ে বাইরে শহরে গাড়ি প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে। ৭. হ্যাচারিগুলো যাতে নিম্নমানের বাচ্চা উৎপাদন করতে না পারে সে ব্যাপারে সরকারি মনিটরিং থাকতে হবে প্রভৃতি।

এ বিষয়ে কথা বললে কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার গলিয়ারা ইউনিয়নের কনেশতলা গ্রামে প্রতিষ্ঠিত রূপালী প্রোটিন প্রোডাক্টের স্বত্বাধিকারী হাসান আহমেদ দুঃখ করে বলেন, ২০১১ সালে বার্ড ফ্লু আক্রান্ত আমার ডিমপাড়া ২৪ সপ্তাহ বয়সের ১২ হাজার মুরগি সরকার মেরে ফেলে। আমার এই মুরগির তখন বাজার মূল্য ছিল ৭২ লাখ টাকা। তিন বছর ঘুরিয়ে সরকার আমাকে দিল ১৭ লাখ টাকা। যদি বীমা থাকত তাহলে আমি যথাযথ ক্ষতিপূরণ পেতাম। এখন বাধ্য হয়ে আমি পোলট্রির সঙ্গে ডেইরি এবং মৎস্য চাষও করছি। বৃহত্তর কুমিল্লার হাজার হাজার পোলট্রি ফার্ম গত কয়েক বছরে এভাবে বন্ধ হয়ে মালিকরা এখন পথে বসেছেন।

তিনি বলেন, এ শিল্পকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই সরকারি নীতিমালা করতে হবে, ব্যাংক ঋণ দিতে হবে, বীমা করাতে এবং হ্যাচারিগুলো যাতে নিম্নমানের বাচ্চা উৎপাদন করতে না পারে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে পোলট্রি শিল্পের সুদিন আসবে না।

পোলট্রি শিল্পকে ব্যাংকগুলো কেন ঋণ দিতে চায় না জানতে চাইলে এ বিষয়ে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক কুমিল্লা জিলা স্কুল রোড শাখার ব্যবস্থাপক কাজী ফখরুল আলম বলেন, ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে চায় না আসলে বিষয়টি এমন না। সব ব্যাংকই তার ঋণের টাকাটা ফিরে আসার নিশ্চয়তাটা দেখে আগে। অনেক সময় দেখা যায়, অনেক অনভিজ্ঞ লোক কিছু না বুঝেই ঋণ নিয়ে একটি পোলট্রি ফার্ম দিল। কিন্তু দেখা গেল তার অনভিজ্ঞতার কারণে স্বল্প সময়ের মধ্যেই মুরগিগুলো মারা গেল। তখন সে নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হলো এবং ব্যাংকের টাকাটাও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল।

কুমিল্লা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আবদুল মান্নান জানান, পোলট্রি ফার্মের মালিকরা যে বলছেন অভিজ্ঞ চিকিৎসক নেই, তা নয়। অভিজ্ঞ চিকিৎসক আছেন। তারা ডাকলেই আমাদের পাবেন। আর এ শিল্পের অন্যান্য সমস্যাগুলো নিয়ে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।সূত্র: অন্তর্জাল থেকে সংগ্রহিত।

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন