চা উৎপাদনে যুগান্তকারী সম্ভাবনা

562

চা বাগান

দেশের চা শিল্পের ১৬৫ বছরের ইতিহাস ভেঙ্গে দিয়ে এবার ৯০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যা চা উৎপাদনে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করবে। অনুকূল আবহাওয়া এবং সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কৌশলের কারণে এ সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন চা শিল্পের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টরা।

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের লস্করপুর ভ্যালীতে চলতি বছর রোগ বালাই কম থাকায় এবং পরিমিত বৃষ্টি হওয়ায় চা উৎপাদনের নতুন রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে। চা শিল্পের ইতিহাসে এ প্রথম ভ্যালীতে চলতি মৌসুমের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন অর্থাৎ ৯১ লাখ ৩১ হাজার ২শ ৪৬ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় ১৯.৩৪ শতাংশ বেশি।এখনও পরিমতি বৃষ্টি হওয়ায় এখনও ভালো উৎপাদন হচ্ছে।

এ সময়ে বৃষ্টিপাত হওয়ায় উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি চায়ের মারও ভালো হচ্ছে। মওসুমের আগামী ৩ মাস উৎপাদনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে চায়ের উৎপাদন ভ্যালীতে অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। পাশাপাশি চা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানী বাড়লে নতুন যুগে প্রবেশ করবে চা শিল্প। শুধু এ ভ্যালীতেই নয়, দেশের সকল এলাকায়ই এবার ভালো ফলন হয়েছে বলে চা শিল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

চা বাগান ও ভ্যালী সুত্রে জানা যায়, চা শিল্পকে টিকিয়ে রাখায় সরকারের গৃহীত নানান পদক্ষেপ এর পাশাপাশি বাগান ব্যবস্থাপনায় আমুল পরিবর্তন, নতৃন বাগান সৃষ্টি, শ্রমিক অসন্তোষ কম থাকা, আবহাওয়া অনুক’লে থাকা, চলতি বছর আগাম বৃষ্টি হওয়ায় এবং রোগ বালাই কম থাকার কারণে চলতি মওসুমে (মার্চ-সেপ্টেম্বর) হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার লস্করপুরে ভ্যালীর ১৭টি চা বাগানে ১৯.৩৪ শতাংশ চা বেশি উৎপাদন হয়েছে।

২০১৮ সালে ৭ মাসে উৎপাদিত হয়েছিল ৭৬ লাখ ৫১ হাজার ৬শ ২৬কেজি চা। চলতি বছর এ সময়ে ভ্যালীতে উৎপাদিত হয়েছে ৯১ লাখ ৩১ হাজার ২শ ৪৬কেজি চা। যা ভ্যালীর ইতিহাসে এবারই প্রথম। এর মধ্যে শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই ভ্যালীতে উৎপাদন ১১.০৪ শতাংশ বেশি হয়েছে।

২০১৮ সালে ভ্যালীতে একই সময়ে উৎপাদিত হয়েছিল ১৭ লাখ ৪৩ হাজার ১শ ০৪কেজি চা। চলতি বছর উৎপাদিত হয়েছে ১৯ লাখ ৩৫ হাজার ৪শ ৯৮ কেজি। এখানে উল্লেখ্য যে, ২০১৬ সালে ভ্যালীতে সর্ব্বোচ্চ ১ কোটি ২৯ লাখ কেজি তৈরী চা উৎপাদিত হয়েছিল। চা সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন আগামী অক্টোবর ও নভেম্বর বৃষ্টির পরিমান ভালো থাকলে এ উৎপাদন ১ কোটি ২৯ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এনিয়ে চা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে।

চলতি চায়ের মওসুমে আগাম বৃষ্টির কারণে মার্চের পরিবর্তে ফেব্রুয়ারী মাসেই উৎসব মুখর পরিবেশে ভ্যালীর ১৭টি চা বাগানে চা উৎপাদন শুরু হয়। গত বছরের তুলনায় ভ্যালীতে উৎপাদন প্রায় ২০ শতাংশ বেশি হয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখ করার মতো হচ্ছে, এবার সেপ্টেম্বর মাসে ভ্যালীর কোন বাগানেই উৎপাদনে ঘাটতি নেই। অক্টোবর মাসেও ঘাটতির সম্ভাবনা কম। ভ্যালীতে এবার বাগান ভিত্তিক সর্ব্বোচ্চ ৯৩ শতাংশ পর্যন্ত বেশি উৎপাদন হয়েছে। অর্থাৎ বৃদ্ধির হার শতভাগের কাছাকাছি চলে গেছে। অথচ গত বছর বেশ কয়েকটি বাগানে উৎপাদনে ঘাটতি ছিল।

ভ্যালীর বৈকন্ঠপুর চা বাগান ২০১৯ সালে ৯৩ লাখ ৮শ ২৫কেজি চা উৎপাদন করেছে। যা ২০১৮ সালের চেয়ে ৭৮.৮০ শতাংশ বেশি। নালূয়া চা বাগান ভ্যালীর সর্বেŸাচ্চ রেকর্ড সংখ্যক ১০ লাখ ৮০ হাজার কেজি চা উৎপাদন করেছে। যা ২০১৮ সালের চেয়ে ১০.১০ শতাংশ বেশি। অথচ এ বাগানে শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে ২/৩দিন উৎপাদন হয়নি। আর না হলে এ উৎপাদন আরও বেশি হত বলে মনে করেন ওই বাগানের কর্মকর্তারা।

চান্দপুর বাগান উৎপাদন করেছে ৯ লাখ ৬ হাজার ৬৭০ কেজি চা। যা ২০১৮ সালের চেয়ে ২২.৮১ শতাংশ বেশি। একই ভাবে লালচান্দ ৪৭ শতাংশ, রেমা চা বাগান ৪৫ শতাংশ, দেউন্দি চা বাগানে ৩৭.৭৭ শতাংশ, বৃন্দাবন চা বাগানে ৩৩.২৮ শতাংশ ও জগদীশপুর চা বাগানে ২০ শতাংশ চা উৎপাদন বেশি হয়েছে।

২০১৮ সালে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভ্যালীতে বৃষ্টিপাত হয়েছিল ২২৪.৭৫ সেঃ মিটার। ২০১৯ সালে ভ্যালীতে বৃষ্টিপাত হয়েছে ২০৯.২৯ সেঃ মিটার। বৃষ্টিপাত কিছুটা কম হলেও আনুপাতিক বৃষ্টির কারণে উৎপাদন বেড়েছে। চলতি বছর রোগ বালাই কম থাকার কারণে এবং তাপমাত্রা চা গাছের সহনীয় মাত্রায় থাকায় উৎপাদন বেড়েছে দ্রুত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দেউন্দি টি কোম্পানীর দেউন্দি চা বাগানের ডিপুটি ম্যানেজার আরমান হোসেন ফরহাদ বলেন, চলতি বছর আগাম বৃষ্টি, অনুকূল আবহাওয়া ও পরিবেশ, নতুন চা এলাকা সম্প্রসারণ, ক্লোন চা গাছের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং চা বোর্ডের নজরদারির ফলে চলতি মৌসুমে চা শিল্পের ইতিহাসে সর্বোচ্চ চা উৎপাদিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু চলতি বছর চায়ের মূুল্য কমে যাওয়ায় বাগানগুলো সংকটে পড়তে পারে।

চান্দপুর চা বাগানের ব্যবস্থাপক শামীম আহমেদ জানান, এ বছর উৎপাদনের রেকর্ড হবে। তবে লস্কপুর ভ্যালীর চেয়ে মৌলভীবাজার জেলায় বেশি উৎপাদন হবে। কারণ মে-জুন মাসে খরার কারণে এদিকে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। যদিও পরবর্তিতে আর কোন সমস্যা হয়নি। ওই সময়ে এ সমস্যা দেখা না দিলে স্মরণকালের বেশি চা উৎপাদন হত আমাদের এলাকায়।

লস্করপুর ভ্যালীর চেয়ারম্যান ও চন্ডিছড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, চা বোর্ড এবং বাগান ব্যবস্থাপকদের আন্তরিক চেষ্টা, আগাম ও পরিমিত বৃষ্টি এবং চা শ্রমিকদের আপ্রাণ চেষ্টার কারণেই এবার ভ্যালীতে উৎপাদন বাড়তে যাচ্ছে। আশা করি এবার রেকর্ড উৎপাদনে যাবে লস্করপুর ভ্যালী।

লস্করপুর ভ্যালীর ১৭টি চা বাগানের ফাড়িঁসহ ২৪টি বাগানের উৎপাদনের এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে দেশের চা শিল্পের ইতিহাসে চলতি বছর ভ্যালীতে উৎপাদনের রেকর্ড সৃষ্টি হবে এবং চা শিল্পের বিপর্যয়রোধ হবে। পাশাপাশি দেশের চাহিদা মিটিয়ে আবার চা রপ্তানী করা সম্ভব হবে বলে চা সংশি¬ষ্টরা মনে করছেন।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা) মুনির আহমেদ বলেন, এ বছর চায়ের বাম্পার ফলন হবে। ২০১৬ সালে রেকর্ড ৮৫ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়েছিল। ২০১৮ সালে ২য় রেকর্ড ৮২ মিলিয়ন কেজির বেশি চা উৎপাদন হয়। এবার সেটি ৯০ মিলিয়ন ছেড়ে যাবে। যা অভ্যন্তরীন চাহিদার কাছাকাছি।

এ বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা কারণ হিসাবে তিনি মনে করেন, সরকারের ক্লোজ সুপারভিশন এর মাধ্যমে নিলাম ও বাজার সম্পর্কে তদারকি, দেশের চা বাগানগুলোতে সঠিক সময়ে ১৪ হাজার মেট্রিক টন সার ভর্তুকি মূল্যে বিতরণ করা, সঠিক সময়ে ও পরিমিত বৃষ্টি, অতি খরা ও অতি বৃষ্টি না হওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ না দেখা দেয়া।

এছাড়াও এ বছর ৫শ হেক্টর জমির নতুন লাগানো গাছ থেকে চা উৎপাদন হয়েছে। সেচ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং শ্রম কল্যাণে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপও সহায়ত হয়েছে। কারণ শ্রম কল্যাণে কাজ করলে তাদের কর্মক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ে। এর ফলে বাগানগুলোতে এবার শ্রম অসন্তোষ কম ছিল। এটিও উৎপাদন বৃষ্টির অন্যতম নিয়ামত ছিল।

তিনি আরও বলেন, দেশের পঞ্চগড় এলাকায় এবার চা উৎপাদন বেড়েছে। নতুন নতুন এলাকা আবাদ হচ্ছে। সেখান থেকে ১০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হবে। সরকার এ চা শিল্পের উন্নয়নে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আগামীতে ময়মনসিংহ এবং খাগড়াছড়িতে চা বাগান সৃজন করা হবে। এতে করে ময়মনসিংয়ে ৮/১০ মিলিয়ন কেজি চা এবং খাগড়াছড়িতে ১৫/২০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এতে করে ওই দুই এলাকার অব্যবহৃত জমিও কাজে লাগবে এবং চা উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

তিনি আরও বলেন, এ বছর সরকার নজর দেয়ায় বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট এর তদারকি বেড়েছে। প্রতি মাসে তাদেরকে প্রতিবেদন দেয়ার বিধান করায় তারা আরও তৎপর ছিল। এ শিল্পের বিকাশে সম্মিলিতভাবে কাজ করার বিকল্প নেই। শ্রীমঙ্গলস্থ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) এর পরিচালক মোহাম্মদ আলীও আশাবদ ব্যক্ত করেন এবার চা উৎপাদন ৯০ মিলিয়ন কেজির বেশি হবে।

এর কারণ হিসাবে তিনি মনে করেন আবহাওয়া অনুক’ল থাকায় রোগ বালাই কম হয়েছে। অতি বৃষ্টি এবং অনা বৃষ্টি ছিল না। বৃষ্টি হয়েছে পরিমিত। যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ডিসেম্বরে উৎপাদন মৌসুম শেষ হওয়ার পূর্বের সময় এখন চলছে। এ সময়েও বৃষ্টি হওয়ায় উৎপাদন বাড়ছে ও গুণগত মান ভালো হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, চা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবার বাগানে বাগানে গিয়ে তদারকি করেছে এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করেছে। প্রতি বছর বাগানে লাল মাকড়শা, মশা ও লিপ্রাস এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় বলে বালাই নাশক ব্যবহার করতে হয়। এখন কাজ চলছে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা উন্নত করেছে কিভাবে ওষুধ কম ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ানো যায়।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড, জহিরুল হক শাকিল বলেন, চা শিল্প শুধু অর্থই দিচ্ছেনা, এর মাধ্যমে বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান, পরিবেশের উন্নয়ন এবং পর্যটন শিল্পের বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

বাংলাদেশের সকল চা বাগানের আইন উপদেষ্টা এডভোকেট আবুল খায়ের জানান, চা বাগানের বাংলোতে ডাকাতি, চা বাগানের জমি থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন এবং বাগানের জমি দখলসহ বিভিন্ন সমস্যার জন্য চা শিল্প বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। তবে প্রশাসনের সঠিক হস্তক্ষেপের কারণে এ অপরাধ দমন সম্ভব হয়েছে। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এ দিকে সরকারের আরও বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন।

ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ