বাংলাদেশের কৃষকের মতে ইঁদুর হচ্ছে দুই নম্বর ক্ষতিকারক গুরুত্বপূর্ণ বালাই। পোকামাকড় হচ্ছে এক নম্বর ক্ষতিকারক বালাই। ইঁদুর জাতীয় প্রাণী প্রাকৃতিক পরিবেশে বৃহৎ এলাকা দখল করে আছে। বনজ ও আগাছা, ভূমি, মানুষের কৃষি জমি, গ্রাম ও শহর, রাস্তাঘাট, বাঁধ, সেচের নালা, হাঁস-মুরগির খামার এবং যেখানে মানুষ বাস করে সেখানে ইঁদুরের বিচরণ রয়েছে।
সারা পৃথিবীতে ২৭০০টির অধিক অপকারী ও উপকারী ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর প্রজাতি আছে। বাস্তবে পৃথিবীর সব স্তন্যপায়ী প্রজাতির শতকরা ৪২ ভাগ ইঁদুর জাতীয় প্রাণী। বেশিরভাগ ইঁদুরের প্রজাতি অধিক পরিমাণে বংশ বিস্তার করতে পারে। এজন্য এদের মারা হলে পরিবেশের ভারসাম্যের কোনো ক্ষতি হবে না, বরং দমন না করা হলে মাঠের ফসল, বাসা-বাড়ির জিনিসপত্র, অফিসের যন্ত্রপাতি ও মূল্যবান কাগজপত্র, রাস্তাঘাটের ক্ষতি এবং পরিবেশের দূষণ এবং ৬০ প্রকারের অধিক মারাত্মক রোগজীবাণুর বিস্তার ও ক্ষতির মাত্রা বেড়ে যাবে।
একজন আদর্শ কৃষক বলেছেন ‘ইঁদুর স্মার্ট প্রাণী, এদের মারতে হলে বৃদ্ধি ও দমন কৌশল প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্মার্ট বা প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ হতে হবে।’ কারণ ইঁদুরের স্মরণশক্তি, ঘ্রাণশক্তি, প্রতিনিয়ত নিজের পরিবেশ যাচাই করার অভ্যাস, সন্দেহ প্রবণতা প্রখর, যে কোনো খাদ্য জিহ্বা বা ঘ্রাণ নিয়ে যাচাই করার পর গ্রহণ করে। বাচ্চাদের খাবার ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা না পেলে স্ত্রী ইঁদুর গর্ভধারণ করে না। বাচ্চার সংখ্যা বাড়ানোর ও কমানোর ক্ষমতা রয়েছে। ইঁদুর মারতে হলে সঠিক দমন কৌশল নির্বাচন করতে হবে। প্রতিটি ইঁদুরের প্রজাতির আচরণ ও খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।
বন্যা বা বর্ষার পানি বেশি হলে মাঠের ইঁদুর রাস্তাঘাট, বাঁধ, উঁচু স্থানের অল্প জায়গায় আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। সিলেট অঞ্চলে এবার বন্যার পানিতে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় কারণ হিসেবে অতিবৃষ্টি ও ইঁদুরকে দায়ী করেছেন। বাস্তবে বাঁধ সহজে ভেঙে যাওয়ার জন্য ইঁদুরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইঁদুরের গর্তের কারণে সহজে বাঁধের ভেতর পানি ঢুকে গেছে। বন্যার পানি ফসলের জমিতে আসার সাথে সাথে মাঠের কালো ইঁদুর ও মাঠের বড় কালো ইঁদুর বাঁধের দুইধারে গর্ত খুঁড়ে আশ্রয় গ্রহণ করে।
এ সময় এতো বেশি মাঠের ইঁদুর বাঁধে জড়ো হয় যা বাঁধ এলাকায় ইঁদুর বন্যার সৃষ্টি হয়। বাঁধ ও সড়কে বর্ষার সময় প্রতি কিলোমিটারে ৩০০-৫০০টির বেশি ইঁদুরের গর্ত পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এক কিলোমিটারে বাঁধে বা রাস্তায় ৫০০টির বেশি ইঁদুর জড় হয়। বাঁধে বা রাস্তাঘাটে ইঁদুর দমনের কোনো ব্যবস্থা নেই। কাজেই এটি ইঁদুরের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল। বর্ষার শুরু হতে বাঁধে ইঁদুর নিধন করা হলে বাঁধের ক্ষয়ক্ষতি রোধ করা যাবে। এছাড়া পরবর্তীতে আমন ফসলের ক্ষয়ক্ষতি কম হবে। বর্ষার প্রারম্ভে প্রতিটি ইঁদুরের গর্তে একটি গ্যাস বড়ি (Phostoxin Tablet) প্রয়োগ করে সহজেই ইঁদুর দমন করা যায়। এছাড়াও চিংড়ি মাছ অথবা শামুকে জিংক ফসফাইড বিষ দিয়ে প্রতিটি সতেজ গর্তে প্রয়োগ করে ইঁদুর নিধন করা যাবে। দুঃখজনক যে বাঁধ উঁচু রাস্তাঘাট, মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে ইঁদুর দমন ব্যবস্থাপনার কোনো ব্যবস্থা আগেও ছিল না, বর্তমানেও নেই এবং ভবিষ্যতে হবে বলে মনে হয় না। ইঁদুরের গর্তে শুধু মাটি দিয়ে মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা রয়েছে। এতে কোনো কাজ হয় না। বাঁধ, মহাসড়ক বিভাগে বর্ষার সময় ইঁদুর দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে কোটি কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা পাবে।
দেশের প্রতিটি শহরে ইঁদুরের কারণে কোটি কোটি টাকার রাস্তাঘাটের ক্ষতি, পানির অপচয়, ড্রেনে ইঁদুরের মাটি ভরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ইঁদুর দ্বারা নানা প্রকার রোগের বিস্তার ঘটে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা বা শহরে মশা নিধনের কার্যক্রম থাকলেও ইঁদুর দমনের কোনো কর্মসূচি নেই। সিঙ্গাপুরে ইঁদুরবাহিত রোগ (যেমন- প্লেগ) বিস্তার রোধে আইন রয়েছে কারও বাসাবাড়ির আঙিনায় ইঁদুরের উপস্থিতি থাকা আইনত দ-নীয় অপরাধ এবং জরিমানা দিতে হয়। আমাদের দেশে আইন নেই এবং ইঁদুর মারার ব্যবস্থাও নেই। কাজেই এখন শহরে যেমন মানুষের সংখ্যা বেশি তেমনি গ্রামের চেয়ে শহরের ইঁদুরের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে।
বাংলাদেশের কৃষক নানাভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইঁদুর নিধন করে থাকে। সবাই মরা ইঁদুর দেখতে পছন্দ করে। তাই অধিকাংশ কৃষক (৬০%) বিষটোপ দ্বারা ফসলের মাঠে ও ঘরবাড়িতে ইঁদুর নিধন করে। কৃষকের অভিমত ইঁদুরের বিষে কাজ হয় না, খায় না এবং মরে না। প্রধান কারণ সঠিক স্থানে, সময়ে ও সঠিকভাবে বিষটোপ ব্যবহার করেন না। তাদের বিষটোপ ব্যবহারে জ্ঞানের অভাব। বর্তমানে ৬-৭% বেশি কৃষক ইঁদুর নিধনে গ্যাস বড়ি প্রয়োগ করে থাকে। গ্যাস বড়ি ব্যবহারে কৃষকের প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন। অপরদিকে ৩৯% কৃষক নানা রকম ফাঁদ ব্যবহার করে যা বেশি কার্যকর। জরিপের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার ফাঁদ সংগ্রহ করে কার্যকারিতা পরীক্ষা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিএআরআই এ কাজটি ডিএইর সাথে যৌথভাবে করতে পারে। শহরে বা বাসাবাড়িতে ইঁদুর নিধনের গ্লুবোর্ড ব্যবহার করা ভালো।
দেশের অধিকাংশ কৃষক (৬১%) মনে করেন ইঁদুর নিধনের দায়িত্ব সরকার ও কৃষকের। এটি একটি সামাজিক সমস্যা। কিন্তু সামাজিকভাবে ইঁদুর দমনের সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ বা প্রকল্প নেই। অধিকাংশ কৃষক ইঁদুর নিধনে ক্যানভাসার বা কীটনাশক ডিলারের পরামর্শ গ্রহণ করে থাকে। কৃষকের মতে ইঁদুর দমনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে থাকে যথা-ক্যানভাসার>টেলিভিশন>কৃষিকথা> উপজেলা কৃষি অফিস। টেলিভিশনে ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতি ও ব্যবস্থাপনার কলাকৌশল বেশি প্রচারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
এক জরিপের তথ্যে দেখা গেছে, ৮৬% কৃষক ইঁদুর নিধন অভিযানের পুরস্কার বা নগদ অর্থের পরিবর্তে বাজারে কার্যকর বিষটোপ পাওয়ার নিশ্চয়তা চেয়েছেন। অভিযানের পুরস্কারের মাধ্যমে অল্পসংখ্যক কৃষক বা ব্যক্তি উপকৃত হন। পুরস্কারের পরিবর্তে বিষটোপ/ গ্যাসবড়ি/ফাঁদ প্রতিটি উপজেলার এক/দুইটি গ্রামের কৃষককে প্রদান করে একযোগে ইঁদুর নিধন করা হলে বেশি ইঁদুর মারা পড়বে, জনগণের কর্মোদ্দ্যোগ বৃদ্ধি পাবে ও প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষতা লাভ করবে।
এতে ইঁদুর নিধন অভিযানের সফলতা বৃদ্ধি পাবে। প্রতিটি গ্রাম ২ জন কৃষক নিয়ে ইউনিয়নে ইঁদুর দমন দল গঠন করা যেতে পারে। এদের ডিএই/বিএআরআই যৌথভাবে একদিনের প্রশিক্ষণ প্রদান করলে দমন প্রযুক্তির প্রসার ঘটবে। ফসল ও সম্পদের ইঁদুরজনিত ক্ষয়ক্ষতি কম থাকবে।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৮ফেব্রু২০২০