ছাগল, ভেড়া, গাড়লের সেক্টরটি বর্তমানে বাংলাদেশে খুবই সম্ভাবনাময় একটি সেক্টর কিন্তু আমাদের দেশের সবচাইতে বড় সমস্যা হল এই প্রাণী গুলোকে সঠিক নিয়মে কৃমি মুক্ত করতে না পারা । কৃমির কারনেই বেশির ভাগ রোগ হয় এদের । সঠিক নিয়মে কৃমি মুক্ত রাখলে আল্লাহর রহমতে কোন সমস্যা থাকে না ছাগল, গাড়ল, ভেড়ার । কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি বাণিজ্যিক ভাবে বড় বড় ছাগলের খামার প্রতিষ্টিত হয় নাই যেমন বড় বড় পোল্টি, গরুর খামার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইতিপুর্বে। আর ডাক্তার গন সরাসরি ছাগলের বিভিন্ন চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে আগ্রহী হন না চিকিৎসা সেবার মূল্য কম থাকার কারণে তাই প্রেক্টিস করার অভিজ্ঞতা কম। তবে আমরা যা কিছু শিখেছি তা প্রতক্ষ এবং পরোক্ষ কোন না কোন ডাক্তারদের কাছ থেকেই শিখেছি কিন্তু ১-২ জন না প্রায় শত শত ডাক্তার দের পরামর্শ থেকে শিখেছি আর শিখেছি এখনো।
অনেক ডাক্তারদের পরামর্শ কাজে লেগেছে আবার অনেকের কোন কাজ হয় নাই এখান থেকে সফলতা আর ব্যর্থতা দুটিই শিক্ষা নিচ্ছি । অনেকেই আমার কাছে আমার খামারে আমি কি ভাবে কৃমি মুক্ত করি তার নিয়ম জানতে চেয়েছেন । আমি যে যে নিয়মে কৃমি মুক্ত করি নিয়ে নিচে আলোচনা করলাম আর আমি এত বড় খামারী না আমি অল্প কয়েকটি ছাগল, গাড়ল পালন করি । কৃমি মুক্ত করার ব্যাপারে বিভিন্ন ডাক্তার বা খামারী গনের কাছে থেকে বিভিন্ন পরামর্শ নিয়েছি এবং বাস্তবে ব্যবহার করেছি আল্লাহর রহমতে সব কিছুই শূন্য থেকে শিখেছি এবং আপনাদের মনে যত প্রশ্ন আছে আমার মনেও এমন প্রশ্ন গুলো ছিল তাই লেখাটি একটু বড় হবে কারন একটি পোষ্ট দিলে আমি চাই বিস্তারিত লিখে দিতে যদি একটু ধৈর্য ধরে পড়েন আল্লাহর রহমতে কৃমি মুক্ত করার ব্যাপারে ৯৫% উওর আমার পোষ্ট টিতে পাবেন তার পরেও কোন প্রশ্ন থাকলে করবেন । লেখাটি যাদের কাছে প্রয়োজনীয় মনে হয় কমপক্ষে ৩ বার পড়বেন ।
নিচে কৃমি মক্ত করার ব্যাপারে আলোচনা করা হল
ছাগল, গাড়ল, ভেড়া এই প্রাণী গুলোকে আমি বিভিন্ন উপায়ে কৃমি মুক্ত করেছি এখন ২ টি পদ্ধতি মেনে চলি । ১-৪ মাস পর্যন্ত বাচ্চা দের কৃমি মুক্ত করার পদ্ধতি এবং গাভীন সহ বড় পশু গুলোর কৃমি মুক্ত করার পদ্ধতি ।
বাচ্চা ছাগল, ভেড়া, গাড়ল
বিভিন্ন খামারী এরং ছাগল পালন কারীর সাথে আলোচনা করে এবং নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একটি কমন জিনিস লক্ষ্য করলাম সেটি হল ছাগলের ক্ষেত্রে বাচ্চা জন্মানোর প্রথম ১ মাস বাচ্চা গুলোর দৈহিক বৃদ্ধি ভাল থাকে এবং দেখতে খুব সুন্দর থাকে কৃমি মুক্ত না করা বাচ্চাগুলো দ্বিতীয় মাস থেকেই আস্তে আস্তে দৈহিক বৃদ্ধি এবং সুন্দর্য কমতে থাকে, দিন দিন শুকিয়ে যায় আর পেঠের সাইজ বড় হতে থাকে, খুবই ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হয়, আবার পায়খানার সাথে সাদা সাদা ফিতা কৃমি, হুক কৃমি, চাবু কৃমি বের হতে থাকে। বাচ্চা গুলো খুবই দূর্বল হয়ে ধীরে ধীরে হাড় চামড়ার সাথে ভেসে উঠে কিছু বাচ্চা মারা যায় আবার কিছু বাচ্চা বছর পার হলেও শরির স্বাস্হ্য খারাপ হতেই থাকে। আমার খামারেও এই সমস্যা ফেইস করেছি তাই এখন আমি নিচের নিয়মে ছাগল, গাড়লের বাচ্চাদের কৃমি মুক্ত করে খুবই ভাল রেজাল্ট পেয়েছি। বাচ্চা ১ মাস হলে নিওট্যাক্স, বা এক্সট্রাস মানুষের সিরাপ জেনেরিক নেইম লিভামিসোল প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১ এমএল হিসেবে যতটুকু হয় খাওয়াতে হবে।
২ মাস পূর্ণ হলে এলটিভেট জেনেরিক নেইম লিভামিসোল + ট্রাইক্লাবেন্ডাজল ৪০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১ টি ট্যাবলেট হিসেবে যতটুকু হয়। ৩ মাস হলে এমেকটিন প্লাস জেনেরিক নেইম আইভারমেকটিন + ক্লোরসুলন ২৫ কেজি হিসেবে ১ এমএল চামড়ার নীচে ইন্জেকশন নিতে হবে। ৪ মাস হলে প্যারাক্লিয়র ফেনবেন্ডাজল গ্রুপের ট্যাবলেট ১০-২০ কেজির জন্য ১ টি । তার ৭-৮ মাস পূর্ণ হলে বড় ছাগলের রুটিনে কৃমি মুক্ত করতে হবে । বাচ্চা গাড়ল, ভেড়া, ছাগলের ক্ষেত্রে যেহেতু ১-২ মাসের অধিক সময় পর্যন্ত মায়ের দুধ পান করে তাই কৃমির ঔষুধ খাওয়ানোর পর লিভারটনিক না খাওয়াতে পারলে তেমন কোন সমস্যা হবে না আর ৩-৪ মাসে কৃমির ঔষুধের দেওয়ার পর লিভারটনিক খাওয়াতে হবে ।
বড় এবং গাভীন ছাগল, ভেড়া, গাড়লের ক্ষেত্রে
কৃমি, বাহ্যিক পরজীবী আক্রান্ত পশুর উদাহরণ এমন যদি আপনি কোন কলসিতে পানি রাখেন এবং কলসির তলাতে চিদ্র থাকে তখন কিন্তু আপনি যতই পানি দিয়ে কলসি পুর্ণ করে রাখেন তা পানি বের হয়ে হয়ে খালি হয়ে যাবেই। তেমনি ভিতরে এবং বাহিরের পরজীবী মুক্ত না করতে পারলে আপনার পশুগুলো যদিও বেঁচে থাকে তারপরেও এই পশু থেকে লাভ করতে পারবেন না কোন সময়। কৃমির কারণে পশু দিনদিন শুকিয়ে যায় খাওয়া দাওয়ার রুচি কমে।
শরীরে রক্ত স্বল্পতা দেখা দেয়। ঘনঘন পাতলাখানা, পেঠফাপা, শরীর দুর্বল হয়। লোম ফেকাসে হয়ে যায়, থেলাজিয়া কৃমির কারণে চোঁখ দিয়ে পানি ঝড়তে দেখা যায়। অতিরিক্ত ফুসফুস কৃমিতে আক্রান্ত হলে নাকের নিচে সর্দি লেগে থাকে সবসময় এবং কেন চিকিৎসা দিয়েও সর্দি কাশি ভাল করা যায় না? প্রজনন ক্ষমতা কমে যাওয়া হিটে না আসা, বিভিন্ন চর্মরোগ দেখা দেওয়া, ইত্যাদি আরো অনেক সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু নিয়মিত কিছু ঔষুধ ব্যবহার করলে এই সকল সমস্যা থাকবে না এবং পশুগুলোর খুবই ভাল থাকবে আর উৎপাদনশীলতা বজায় থাকবে।
কি কি ঔষুধ ব্যবহার করা হলে যাবতীয় পরজীবী মুক্ত রাখা যাবে
আমাদের অনেকের মনেই প্রশ্ন থাকে যে কৃমির ঔষুধ তো যে কোন একটি হলেই চলে এখানে এত খোজে লাভ কি? এর উওর আসলে এই পশুগুলোর শরীরে ভিতরে এবং বাহিরে ২০-৩০ জাতের বেশি পরজীবী থাকে যেখানে ২-১ টি নির্দিষ্ট ঔষুধে সবগুলোকে দমন করা সম্ভব না। আবার একই কাজের ভিন্নভিন্ন গ্রুপের ঔষুধ ব্যবহার করা হয় এই কারণে যেখানে কিছু ঔষুধ নিয়মিত ব্যবহার করার ফলে পরজীবীগুলো বিরুদ্ধে সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। তাই সঠিক ফলাফলের জন্য পরজীবী একই কিন্তু চিকিৎসা ভিন্ন হলে সঠিক কার্যকারীতা পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ প্রায় ১০-১২ টির বেশি গ্রুপের পরজীবী মুক্ত করার ঔষুধ পাওয়া যায় আমি মূলত ৬ টি গ্রুপের ঔষুধ ব্যবহার করি জেনেরিক নেইম এবং ২ টি বাজার জাতকারী কোম্পানীর নামসহ নিচে দেওয়া হলো-
ফেনভেন্ডাজল
প্যারাক্লিয়ার টেকনো, ফেনাজল একমি আরো বিভিন্ন নামে বিভিন্ন কোম্পানি এটি বাজার জাত করে যেকোন কোম্পানিরই কিনেন ৩ মাস বয়স থেকে যে কোন বয়সের ছাগল, গাড়লের গোল কৃমি , ফিতা কৃমি, ফুসফুস কৃমি ইত্যাদির জন্য ১০-২০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১ টি ২১-৫০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ২ টি ৫১-১০০+ কেজি দৈহিক ওজনের ছাগ, গাড়লের জন্য ৩ টি ট্যাবলেট খাওয়াতে হবে ।
লিভামিসোল + ট্রাইক্লাবেন্ডাজল
এলটিভেট একমি, এন্টিওয়ার্ম ভেট এসিআই, এখানে মূলত দুটি গ্রুপের ঔষুধ একসাথে পাওয়া যায় তাই আমি এটি পচন্দ করি কারন একটি ঔষুধ খাওয়ালে দুটি গ্রুপ থাকার কারণে বিভিন্ন প্রকার কৃমির গোল কৃমি, ফিতা কৃমি, কলিজা কৃমি, ফুসফুস কৃমি, পাকস্থলীর কৃমি ইত্যাদির বিরুদ্ধ কাজ করে। যেকোন কোম্পানিরই কিনেন ৪০ কেজি দৈহিক ওজনের হিসেবে ১ টি ট্যাবলেট খাওয়াতে হবে। আর ৪০ কেজির বেশি হলে ৪১-১০০+ হলে ১.৫ টি ট্যাবলেট ছাগল, গাড়লের জন্য।
নাইট্রক্সিল ইন্জেকশন
নাইট্রক্স -এ একমি, নাইট্রোক্সিল এসিআই, এটি কলিজা কৃমি ও গোল কৃমি ইত্যাদি ধ্বংস করার জন্য ব্যবহার করা হয়। তবে এটি আমি বছরে ১ বার বর্ষা মৌসুম মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে একবার ব্যবহার করি। কারণ ঐ সময়ে কলিজা কৃমির আক্রমণ বেশি দেখা দেয় যার কারণে “বটল জ্বর” রোগটি হতে পারে। আর এই ইন্জেকশনটি ব্যবহারের সময় কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। যেমন এর মূল উপাদান নাইট্রকজিল কিছু কোম্পানি ২৫% বাজার জাত করে আবার কিছু ৩৪% করে। এখানে যদি আপনি ৩৪% ব্যবহার কারীর মাত্রার পরামর্শে ২৫% টি ব্যবহার করেন তাহলে কিন্তু কাজ হবে না। তেমনি ২৫% ব্যবহার কারীর পরামর্শে যদি ৩৪% করেন তাহলে বেশি হবে। তাই আগে ইন্জেকশনটি কিনে নির্দেশিকা ভাল করে পড়ে কেজি প্রতি যে মাত্রা লেখা থাকে ঐ মাত্রা থেকে একটু বেশি ব্যবহার করবেন। যদি লেখা থাকে ৫০ কেজির জন্য ২ সিসি তাহলে আপনি ২.৫ অথবা ৩ সিসি হিসেবে চামড়ার নীচে ইন্জেকশন ব্যবহার করলে ভাল ফলাফল পাওয়া যাবে। বেশি দুর্বল ছাগল, গাড়লকে এই ইন্জেকশনটি ব্যবহার করার ৪ দিন আগে এবং ৪ দিন পর পর্যন্ত প্রতি ৪৮ ঘন্টা পর পর ১০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৩ সিসি করে মাংসে এমাইনো ভেট ইন্জেকশন দিতে হবে।
আইভার মেকটিন + ক্লোরসুলন
একমি কোম্পানিরটিই ব্যবহার করি কারণ অন্যান্য কোম্পানির গুলো শুধু ১ টি উপাদান আইভারমেকটিন থাকে একমিরটি দুটি উপাদান থাকে তাই এটি আমার পছন্দ এরং খুবই ভাল কাজ করে। এটি ২৫ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১ সিসি হিসেবে চামড়ার নীচে ব্যবহার করি। এটি ব্যবহার করলে ফুসফুস কৃমি, কলিজা কৃমি, চোখের কৃমি, মাইট, আঁঠালী, নাকের মাছি ইত্যাদির বিরুদ্ধে খুব ভাল কাজ করে এবং পশুটি চর্মরোগ মুক্ত থাকবে। এই ইন্জেকশনটি খুবই সাবধানে পুশ করতে হয় এবং অভিজ্ঞ হলে নিজে অথবা অভিজ্ঞ কোন লোক দিয়ে করাতে হবে। ব্যবহারের পরে প্রথম ১-২ মিনিট চিল্লাচিল্লি বা মাঠিতে শুয়ে পড়া অথবা অস্বাভিক কোন আচরণ করলে ভয় পাবার কোন কারণ নেই। ছাগল বা গাড়লের মাথা এবং শরীরে একটু পানি দিয়ে মেসেজ তরে দিবেন দেখবেন ১-২ মিনিটে ১০০% স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
কখন কোন ঔষুধ ব্যবহার
আমি সারা বছরে মোট ৬ বার কৃমি মুক্ত করি যেমন প্রথম ফেনভেন্ডাজল এবং একমাস পর বুষ্টার ডোজ আইভারমেকটিন + ক্লোরসুলন ইন্জেকশন এমেকটিন প্লাস একমি কোম্পানিরটি। আবার ৩ মাস পর লিভামিসোল + ট্রাইক্লাবেন্ডাজল যুক্ত ট্যাবলেট এর ১ মাস পর বুষ্টার ডোজ মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝে রুটিনে নাট্রক্সিল ইন্জেকশন। আবার ৩মাস পর ফেনভেন্ডাজল এবং একমাস পর বুষ্টার ডোজ আইভারমেকটিন + ক্লোরসুলন ইন্জেকশন এমেকটিন প্লাস একমি কোম্পানিরটি। মোট ১২ মাসে ৬ বার এই নিয়মে এই নিয়েমে বাস্তবে ব্যবহার করে খুবই ভাল রেজাল্ট পাচ্ছি আল্লাহর রহমতে।
নির্দিষ্ট মাত্রাতে ৬ বার ব্যবহার করলে লিভারে বা অন্য কোন রকম সমস্যা হয় না। বছরের যে কোন সময়ই এই নিয়মে শুরু করা যাবে।
শেষ কথা
ছাগল, গাড়ল, ভেড়া পালন করতে হলে এর সফলতার কিছু পূর্ব শর্ত থাকে তার মধ্যে সঠিক ভাবে কৃমি মুক্ত করা অন্যতম। নিয়মিত কৃমি মুক্ত রাখলে আর্থিকভাবে লাভবান এবং চিন্তা মুক্ত থাকা যায় আল্লাহর রহমতে।
লেখক:- Md Zahir
B.Baria Goats Farm
ফার্মসএন্ডফার্মার/১০মার্চ২০