সবজি আমাদের দৈনন্দিন খাবারের অন্যতম অনুষঙ্গ। কথায় আছে ‘সুস্থ সুন্দর দেহমন, হাসিখুশি সারাক্ষণ’। আর সেটি নিশ্চিত করতে হলে খাবার টেবিলে সবজি রাখার বিকল্প নেই। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের দৈনিক প্রায় ২৫০ গ্রাম সবজি খাওয়া প্রয়োজন। খাদ্য উপাদানের প্রত্যেকটি উপাদান বিভিন্ন সবজির মধ্যে কমবেশি বিদ্যমান। বাণিজ্যিকভাবেও সবজি উৎপাদন খুবই লাভজনক। বাংলাদেশে প্রায় ৮৯ ধরনের শাকসবজি চাষ করা হয়। সবজির ভালো উৎপাদন অনেকাংশে গুণগত মানের চারার ওপর নির্ভরশীল। শীতের সবজি খেতে কার না ভালো লাগে। আর তা যদি আগাম শীত সবজি হয় তা খেতে যেমন সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর বাজারে দামও থাকে বেশি। তাই শীতের সবজির আগাম চারা উৎপাদনে বিশেষ প্রযুক্তি ও কলা-কৌশল অনুসরণ করতে হয়। সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা থাকছে এই নিবন্ধে। আমাদের দেশে সাধারণত টমেটো, বেগুন, ফুলকপি, লাউ, বাঁধাকপি, মরিচ, পেঁয়াজ এসব সবজির চারা উৎপাদন করা হয়। আগাম শীতকালীন ও রবি মৌসুমের সবজি চাষের জন্য সবজি চারা উৎপাদনের এখনই গুরুত্বপূর্ণ সময়। উৎকৃষ্ট মানের সবজির চারা উৎপাদনের জন্য প্রচুর দক্ষতা এবং বিশেষ কিছু প্রযুক্তি বিবেচনা করা উচিত।
সবজির বীজ: কথায় আছে ভালো বীজে ভালো ফসল। যেন-তেন কোম্পানির বীজ কিনে অনেক সময় কৃষকরা প্রতারিত হয়ে থাকেন। তাই বিশ্বস্ত ও প্রকৃত বীজ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাহিদা মাফিক সঠিক জাতের সবজি বীজ ক্রয় করতে হবে। জাত নির্বাচন ও বীজ ক্রয়ের ব্যাপারে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী অথবা একজন আদর্শ কৃষকের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। প্যাকেটের গায়ে বীজের গুণগত মানের কতগুলো তথ্যাদিসহ ওই বীজের মেয়াদ স্পষ্ট করে লেখা আছে এমন বীজের প্যাকেট কিনতে হবে। হাইব্রিড বীজ ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
বীজতলা নির্বাচন: সবজির চারা উৎপাদনের জন্য সঠিক স্থানে বীজতলা তৈরি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বীজতলাকে শিশু চারার বিছানা বলা হয়ে থাকে। নরম, তুলতুলে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও রোগ জীবাণুমুক্ত বীজতলা সবজি চারা উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। তাই বীজতলা তৈরির স্থান নির্বাচনের জন্য কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা দরকার। যেমন- অপেক্ষাকৃত উঁচু জমি, যেখানে বৃষ্টি বা বন্যার পানি জমে না এবং সহজে নিষ্কাশন করা যায়। ছায়াবিহীন, পরিষ্কার এবং পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচলের উপযোগী স্থানে বীজতলা করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, বীজতলার কাছাকাছি যেন পানির উৎস থাকে এবং বাড়ি, খামার বা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হলে অফিসের কাছাকাছি হওয়া উচিত। বীজতলার মাটি বেলে দো-আঁশ বা দো-আঁশ এবং অবশ্যই উর্বর হতে হবে। বাণিজ্যিকভাবে চারা উৎপাদন করতে হলে বীজতলা যতদূর সম্ভব ক্রেতাদের কাছাকাছি এবং ভালো যোগাযোগ সম্পন্ন স্থানে স্থাপন করতে হবে।
বীজতলা প্রস্তুতি: একক বীজতলা সাধারণত এক মিটার চওড়া ও তিন মিটার লম্বা হবে। প্রয়োজনে বড় জমিকে ভাগ করে একাধিক বীজতলা তৈরি করা যায়। পাশাপাশি দুটি বীজতলার মধ্যে কমপক্ষে ৬০ সেমি ফাঁকা রাখতে হবে। বীজ বপনের কয়েকদিন আগে বীজতলার মাটি ২০-২৫ সেমি গভীর করে ঝুরঝুরা ও ঢেলামুক্ত করে তৈরি করতে হবে। বীজতলা সাধারণত ১০-১৫ সেমি উঁচু করে তৈরি করতে হবে। মাটি, বালি ও পচা গোবর সার বা কম্পোস্ট মিশিয়ে বীজতলার মাটি তৈরি করতে হয়। মাটি উর্বর হলে রাসায়নিক সার না দেয়াই ভালো। উর্বরতা কম হলে প্রতি বীজতলায় ১০০ গ্রাম টিএসপি সার বীজ বপনের অন্তত এক সপ্তাহ আগে ছিটিয়ে দিয়ে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মেশাতে হবে। বাণিজ্যিকভাবে চারা উৎপাদন করতে চাইলে ইট সিমেন্ট দিয়ে স্থায়ী বেডে বীজতলা তৈরি করাই শ্রেয়।
বীজ বপন: বীজ বপনের আগে বীজ পরীক্ষাকরণ, বীজ শোধন ও বীজতলার মাটি শোধন করে নিতে হবে। বীজতলায় সারি বা ছিটিয়ে বীজ বপন করা যায়, তবে সারিতে বপন করা উত্তম। সারিতে বপনের জন্য প্রথমে নির্দিষ্ট দূরত্বে (৪ সেমি) কাঠি দিয়ে ক্ষুদ্র নালা তৈরি করে তাতে বীজ ফেলে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। শুকনা মাটিতে বীজ বপন করে সেচ দেয়া উচিত নয়, এতে মাটিতে চটা বেঁধে চারা গজাতে ও বাতাস চলাচলে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে। তাই সেচ দেয়া মাটির জো অবস্থা এলে বীজ বপন করতে হয়। যেসব বীজের আবরণ শক্ত, যেগুলোয় সহজে পানি প্রবেশ করে না, সেগুলোকে সাধারণত বোনার আগে পরিষ্কার পানিতে ১৫-২০ ঘণ্টা অথবা শতকরা এক ভাগ পটাশিয়াম নাইট্রেট দ্রবণে এক রাত্রি ভিজিয়ে বপন করতে হয় (যেমন- শিম, লাউ, চিচিঙ্গা, মিষ্টি কুমড়া, করলা, উচ্ছে ও ঝিঙ্গা ইত্যাদি)।
বীজতলায় আচ্ছাদন: বৃষ্টির পানি ও অতিরিক্ত সূর্যতাপ থেকে বীজতলাকে রক্ষা করার জন্য আচ্ছাদন দেয়া প্রয়োজন। কম খরচে বাঁশের ফালি করে বীজতলায় প্রস্থ বরাবর ৫০ সেমি পরপর পুঁতে নৌকার ছৈয়ের আকার তৈরি করে, বৃষ্টির সময় পলিথিন দিয়ে এবং প্রখর রোদে চাটাই দিয়ে বীজতলার চারা রক্ষা করা যায়। সাধারণত সাদা মাছি নিয়ন্ত্রণের জন্য বীজতলায় আচ্ছাদনের পাশাপাশি মশারির ব্যবস্থা করলে খুব ভালো হয়। চারা গজানোর পর হালকা ছায়া, পরিকল্পিতভাবে পানি সেচ, চারা গজানোর ১০-১২ দিন পর দ্বিতীয় বীজতলায় সারি করে রোপণ এসব করলে ভালোমানের চারা তৈরি হয়।
দ্বিতীয় বীজতলায় চারা স্থানান্তর: জমিতে চারা লাগানোর আগে মূল বীজতলা থেকে তুলে দ্বিতীয় বীজতলায় সবজি চারা রোপণের পদ্ধতিকে সবজির চারার দ্বিতীয় বীজতলায় চারা স্থানান্তরকরণ পদ্ধতি বলে। সাধারণত ১০-১২ দিনের চারা দ্বিতীয় বীজতলায় স্থানান্তরিত করা হলে কপি গোত্রের সবজি, বেগুন ও টমেটো চারা শিকড় বিস্তৃত ও শক্ত হয়, চারা অধিক সবল ও তেজি হয়। চারা লাগানোর পর হালকা পানি দিতে হবে এবং বৃষ্টির পানি ও প্রখর রোদ থেকে রক্ষার জন্য পলিথিন বা চাটাই দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
চারার রোগ দমন: বীজতলায় বপনকৃত বীজ গজানোর আগে এবং পরে রোগাক্রান্ত হতে পারে। তাই আগেই বীজতলার মাটি কাঠের গুঁড়া পুড়িয়ে, সৌরতাপ, পোল্ট্রি রিফিউজ ও খৈল ব্যবহার করে শোধন করে নিতে হবে। বীজতলার মাটি সুনিষ্কাশিত রাখা রোগ দমনের প্রধান উপায়। প্রতিষেধক হিসেবে মাটিতে কপার অক্সি-ক্লোরাইড দুই গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে বীজতলার মাটি ভালো করে ভিজিয়ে কয়েকদিন পর বীজ বপন করতে হবে। বন্যার সময় বীজতলায় চারা উৎপাদনের জন্য বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে সবজির চারা কাঠের বা প্লাস্টিকের ট্রে, পলিথিনের ব্যাগে, মাটির টবে, গামলায়, থালায়, কলার খোলে উৎপাদন করা যায়। ছোট আকারের পলিথিনের ব্যাগে বা অন্যান্য মাধ্যমে এদের চারা উৎপাদন করলে সহজে শেকড় ও মাটিসহ চারা রোপণ করা যায়। এসব কলাকৌশলগুলো সঠিকভাবে মেনে চললে সবজির সুস্থ-সবল চারা উৎপাদন করা সম্ভব।
লেখক: আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, সিলেট।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৫জুন২০