বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক ফসল বিলাতি ধনিপাতার ব্যবহার ও চাষ পদ্ধতি

1670

বিলাতি ধনিয়া মুলত একটি মসলা জাতীয় উদ্ভিদ। এই বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্ব পার্বত্য অঞ্চল যেমন রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি এলাকায় ব্যাপকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে। এই ফসলটি বাণিজ্যিকভাবে অনেক লাভজনক একটি ফসল।

গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকার বাহিরে এর পরিচিতি কম এবং ইংরেজি কোনো সুনির্দিষ্ট নাম না থাকায় বিভিন্ন দেশে এটি ৭৩ টি ভিন্ন নামে পরিচিত। তবে অনেক দেশে এটাকে false coriander, culantro, Mexican coriander, shado beni, spiny or serrated coriander, Shadobeni, cilantro, Fitweed, Chardon, বনঢুলা প্রভৃতি নামে অভিহিত করে থাকে। ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এটাকে Eryngium বলা হয়।

রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার ওয়াগগা, বেতবুনিয়া, কাউখালী, খগড়া এলাকায় ব্যাপকভাবে এবং খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার কিছু কিছু এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে এ ফসলটির চাষ হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। এজন্য প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. মামুনুর রশিদ তাঁর সবজির চাষ বইটিতে এটিকে বাংলা ধানিয়া নামে অভিহিত করছেন।

উৎপত্তি ও বিস্তার : প্রাপ্যতা ও বিস্তৃতির ধরন দেখে আসাম, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলই এ প্রজাতিটির উৎপত্তিস্থল বলে ধারণা করা হয়। কোনো কোনো বিজ্ঞানীর মতে, দক্ষিণ আমেরিকাই এর উৎপত্তিস্থল যা ক্রমান্বয়ে পাক-ভারত উপমহাদেশসহ গ্রীষ্মমন্ডলীয় বিভিন্ন দেশে বিস্তার লাভ করেছে।

ভিয়েতনাম এবং ওয়েস্টইন্ডিজের ত্রিনিদাদ ও টোবাগো থেকে কুলিনারি হার্ব বা সালাদ জাতীয় অর্থকরী ফসল হিসেবে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করা হয়। অবশ্য Eryngium yuccifolium নামে এর অন্য একটি প্রজাতি অল্প পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রে চাষ করা হয়।

এছাড়াও আর্জেন্টিনাতে Eryngium paniculatum Cav তুরস্কে Eryngium giganteum এবং জর্ডানে Eryngium creticum নামক প্রজাতির চাষ হয়। শীতপ্রধান দেশের মধ্য জার্মানিতে গ্রীষ্মকালে Eryngium maritimum প্রজাতির চাষ হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল ও ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও মিয়ানমারের কিয়দংশে এর চাষাবাদের সম্প্রসারণ বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।

উদ্ভিদতত্ত্ব : Apiaceae পরিবারেরর Eryngium গণের ২২৮ টি প্রজাতির একটি হলো Eryngium foetidum L. বিলাতি ধনিয়া বা বাংলা। এটি একটি ক্ষুদ্রাকার দীর্ঘজীবী বিরুৎ। কাণ্ড অস্পষ্ট ও ভূসংলগ্ন। ফুল আসার সময় উপরদিকে বাড়ে এবং কাণ্ড ফাঁপা হয়ে শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়।

পাতা দৈর্ঘ্যে ১৫-২০ সেন্টিমিটার ও প্রস্থে ২-৩ সেন্টিমিটার এবং পত্রফলকের কিনারা সামান্য খাঁজযুক্ত ও অগ্রভাগ ছোট ছোট সূক্ষ্ম কাঁটাযুক্ত হয়। এটি একটি ছায়াপ্রিয় উদ্ভিদ। ফুল ক্ষুদ্রাকৃতির বৃন্তবিহীন এবং মঞ্জুরি দণ্ডে ঘন সন্নিবেশিত থাকে। বীজ দ্বিবীজপত্রী, অমসৃণ, ক্ষুদ্রাকৃতির বৃন্তবিহীন এবং মঞ্জুরি দণ্ডে ঘন সন্নিবেশিত থাকে। সাধারণত বীজ এবং পার্শ্ব সাকার থেকে এর বংশবিস্তার হয়ে থাকে।

ব্যবহার: বিলাতি ধনিয়ার পাতা মসলা বা খাদ্য সুগন্ধিকারক (কিউলিনারী হার্ব) হিসেবে বিভিন্ন দেশে ব্যবহার করা হয়। এ দেশের মতো ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ফোরিডা, হাওয়াই প্রভৃতি দেশেও রান্নার মসলা হিসেবে বিলাতি ধনিয়া বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত: এর কাঁচা পাতা ব্যবহার হয়। শুকালে এর পাতার তীব্র সুগন্ধ নষ্ট হয় না। বিলাতি ধনিয়া যে শুধু রান্নাকে সুগন্ধময় ও সুস্বাদু করে তাই নয়, এর ভেষজ মূল্যও আছে।

ভেষজগুণ: জ্বর, হাইপার টেনশন, অ্যাজমা, পাকস্থলীর জ্বলা পোড়া, কৃমি, সাপে কামড়ানো, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায় বিলাতি ধনিয়া সফলভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে।

বিলাতি ধনিয়া এবং ধনে পাতার পার্থক্যঃ বিলাতি ধনিয়া এবং ধনে পাতার মধ্যে কোন সাদৃশ্য নেই। বিলাতি ধনিয়া দেখতেও ধনে পাতার মতো নয়। ধনে পাতা পাতলা ও চতুদিকে চেরাচেরা। বিলাতি ধনিয়ার পাতা লম্বা, কয়েকটি পাতা মিলে একটি গোছা বা গাছ হয়। পাতার চারদিকে নরম কাঁটা থাকে। ধনে পাতার গাছে কান্ড হয়। কিন্তু বিলাতি ধনিয়াতে কোন কান্ড হয় না।

জমি তৈরি : বিলাতি ধনিয়া চাষের জন্য খুব ভালোভাবে জমি প্রস্তুত করা প্রয়োজন। ৫/৬টি চাষ ও উপর্যুপরি মই দিয়ে মাটির ঢেলা ভেঙে ঝুরঝুরা করা প্রয়োজন। কেননা বিলাতি ধনিয়ার বীজ খুব ক্ষুদ্রাকৃতির বালির দানার মতো ছোট হওয়ায় বড় আকারের ঢেলার মধ্যে গজানো সম্ভব নয়। এজন্য মটরদানা বা মার্বেলের চেয়ে বড় আকারে ঢেলা থাকা ঠিক না। বীজ বপনের আগে মাটিতে প্রয়োজনীয় রস বা জো অবস্থা থাকা খুব প্রয়োজন। প্রয়োজনে বপনের আগে একবার হালকা সেচ দেয়া যেতে পারে। তবে নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে অধিকাংশ মাটিতে প্রয়োজনীয় রস থাকে। এক মিটার চওড়া বেড, জমির সমান লম্বা এবং ৩০ সেন্টিমিটার চওড়া নালা রাখা প্রয়োজন। এ নালার মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরিচর্যা, পানি সেচ ও নিষ্কাশনের কাজ সহজ হয়।

বীজ বপন : নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি (মধ্য কার্তিক থেকে মধ্য ফাল্গুন)মাস বিলাতি ধনিয়ার বীজ বপনের উত্তম সময়। মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকলে মার্চ মাস পর্যন্ত বপন করা যেতে পারে। তবে বীজ বপনের পরেও অন্তত ২০-২৫ দিন কম তাপমাত্রা থাকা প্রয়োজন। কেননা বিলাতি ধনিয়া বীজের অঙ্কুরোদগমের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা হলো ১২-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে এর গজানো হার কমে আসে।

বিলাতি ধনিয়ার বীজে এক মাসের বেশি সাধারণ অবস্থায় অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা থাকে না। এজন্য বীজ সংগ্রহের পর যত দ্রুত সম্ভব হালকাভাবে ছায়াতে শুকিয়ে বপন করা উচিত। বিলাতি ধনিয়ার ক্ষুদ্রাকৃতির বীজ সমানভাবে বোনা বেশ কষ্টকর এবং বিশেষ দক্ষতারও প্রয়োজন। তাই বালির সাথে মিশিয়ে বীজ বোনা উত্তম। ১০-১৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে সারিতে অথবা ছিটিয়ে বীজ বপন করা য়ায়।

ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে বীজ বপনের পর মাটি ওপরের স্তরের ১-১.৫ সেমি গভীরতা পর্যন্ত মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। লাইনে বপন করলে ১.৫-২.৫ সেমি গভীর নালা করে নালাতে লাইন করে বীজ ছিটিয়ে দুই পাশে মাটি দিয়ে হালকাভাবে ঢেকে দিতে হবে।

বীজের হারঃ গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি হেক্টরে ৩৫-৪০ কেজি হারে বা প্রতি বর্গমিটারে ৪ গ্রাম অর্থাৎ প্রতি শতাংশ জমিতে ১৬০ গ্রাম বীজ বপন করে সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া যায়।

অতি ক্ষুদ্রাকৃতির বীজ হলেও প্রতি শতাংশে ১৫০-১৬০ গ্রাম বীজ আপাত দৃষ্টিতে অনেক বেশি বলে মনে হয়। কিন্তু এর সব বীজ এক সাথে গজায় না। কয়েক মাস পর্যন্ত বীজ ক্রমান্বয়ে গজাতে থাকে। একই দিনে বোনা বীজ গজাতে ১৫-১২০ দিন পর্যন্ত সময় নেয়। ফলে একবার বীজ বপন করেও কৃষক অনেক বার মানে অন্তত ৮-১২ বার ফসল তুলতে পারেন।

জাতঃ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটইউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে ২০১৩ সালে বারি বিলাতি ধনিয়া-১ নামের একটি জাত অনুমোদিত হয়েছে। এ জাতটির প্রতিটি গাছের গড় ওজন ৬.৮১ গ্রাম, পাতার সংখ্যা ৭.৪ টি, পাতার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ১৪.১ ও ৩.২ হয়ে থাকে। এর পাতা সবুজ রঙের সুগন্ধিযুক্ত, সুস্বাদু, উচ্চতর পুষ্টিমূল্য ও ঔষধি গুন সমৃদ্ধ। এই জাতটি বাংলাদেশের আবহওয়া উপযোগী ও উচ্চ ফলনশীল। হেক্টর প্রতি পাতা ৩০-৫০ টন এবং বীজের ফলন ৪০০-৫০০ কেজি হয়ে থাকে।

জমিতে আন্ত: ফসল চাষ: বিলাতি ধনিয়া দীর্ঘমেয়াদী ফসল। এটি ছায়াবিলাসী ফসল। তাই এই ফসলে ছায়ার জন্য মাচা তৈরি করে তাতে বেশ কিছু ফসল উঠিয়ে দেয়া যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে লতানো উদ্ভিদের মধ্যে মিষ্টি কুমড়া, লাউ, করলা, চালকুমড়া, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, শিম, বরবটি ইত্যাদি সবজি চাষ করে বাড়তি আয় পাওয়া যায়।

সার প্রয়োগ : বিলতি ধনিয়া পাতাজাতীয় ফসল হওয়ায় এর জন্য ইউরিয়া ও পটাশ জাতীয় সার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বীজ বপনের আগে শতাংশপ্রতি ৮০ কেজি পচা গোবর বা আবর্জনা পচা সার কম্পোস্ট, ২০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৮০০ গ্রাম টিএসপি ও ৮০০-১০০০ গ্রাম এমওপি শেষ চাষের সময় বীজ বপনের ৩/৪ দিন পূর্বে জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে। চারা গজানো পর থেকে ১ মাস পর অথবা প্রতি দুইবার ফসল সংগ্রহের পর প্রতি শতাংশে ২০০ গ্রাম হারে ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এভাবে প্রতি হেক্টর জমিতে মোট ২০ টন কম্পোস্ট, ৩০০-৪০০ কেজি ইউরিয়া ২০০ কেজি টিএসপি এবং ২০০-২৫০ কেজি এমওপি সারের প্রয়োজন হবে।

অন্যান্য পরিচর্যাঃ আগাছা দমনঃ চারা গজানোর পর সাধারণত ১ বার আগাছা পরিস্কার করলেই চলে। তবু জমিতে যেন আগাছা জন্মাতে না পারে একটু সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়াজন। ক্রমে ফসল বড় হয়ে মাঠ ছেয়ে গেলে তখন আগাছা নিড়ানোর প্রয়োজন হয়না।

ছাউনি দেওয়াঃ ছাউনি না দিলে প্রখর সূর্যালোকের কারণে বিলাতি ধনিয়ার পাতা শক্ত ও কাঁটাযুক্ত হয়ে যায়। আবার সূর্যালোক না পাইলে ফসল ভাল হয় না। মোট সূর্যালোকের ২০-৪০ ভাগ বিক্ষিপ্ত আলো বিলাতি ধনিয়ার জন্য যথেষ্ট। এজন্য বাঁশের তৈরি মাচায় নারিকেল পাতা, ছন, ধৈঞ্চা, কলাপাতা ইত্যাদি দিয়ে ছাউনি করা ভালো। এ ছাড়া মাচায় কুমড়া জাতীয় আন্ত:ফসল তুলে দিলে বাড়তি ফসল পাওয়া যাবে।

সেচ প্রদানঃ বিলাতি ধনিয়া আর্দ্রতা বেশি পছন্দ করে। তাই এ ফসলে জমিতে সব সময় রস থাকতে হবে। তবে জলাবদ্ধতা হতে দেয়া যাবে না। ঝরণা সেচ ৭ দিন পর পর দিলে সবচেয়ে ভালো।

বালাই দমনঃ বিলাতি ধনিয়ায় সাধারণত তেমন রোগ ও পোকার আক্রমণ হয় না। তবে মাঝে মাঝে গোড়া পঁচা রোগ ও পাতা ঝলসানো ছত্রাকজনিত রোগ দেখা দিতে পারে। অনুমোদিত ছত্রাকনাশক দিয়ে এ রোগ দমন করতে হবে।

ফসল সংগ্রহ ও বিপণনঃ কাঁচা পাতার ফলন হেক্টরে প্রায় ৩৫-৪৭ টন। গাছ বড় হতে শুরু করলে অর্থাৎ সবুজপাতা যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন বড় গাছগুলোর গোড়াসহ ওঠিয়ে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে আঁটি বেঁধে অথবা স্তুপাকারে প্লাষ্টিকের ক্যাইসে (বাক্স) ভরে বাজারে প্রেরণ করতে হবে। এর চাহিদা বেশি থাকায় পাইকারগণ জমি থেকেই ফসল ক্রয় করে থাকেন। ক্ষুদ্র চাষিগণ পূর্নতাপ্রাপ্ত পাতা গাছ থেকে ধারালো যন্ত্রের সাহায্যে কেটে ছোট ছোট আঁটি বেঁধে পাইকার বা বিক্রেতার/ ক্রেতার কাছে বিক্রি করে থাকেন।

বিলাতি ধনিয়ার গাছে ফুল ফোটার ৪০ দিনের মধ্যে বীজ পেকে যায়। বেশি পাকতে দিলে বীজ ঝরে যায়। এ জন্য বেশি না পাকিয়ে কেটে এনে প্লাষ্টিকের বিছানার উপর রেখে শুকাতে হবে। দন্ড শুকানোর পর মাড়াই না করেও মঞ্জুরী দন্ডসহ ফুল শুকিয়ে পলিব্যাগ বা কৌটায় ভরে রাখা যাবে। চাষের পূর্বে বীজ বুনার আগে মাড়াই করে বীজ বুনতে হবে।

ধনেপাতার উপকারিতা

কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করেঃ আমাদের দেহে এলডিএল নামক এক ধরনের ক্ষতিকর কোলেস্টেরল থাকে, যা দেহের শিরা-উপশিরার দেয়ালে জমে হৃৎপিন্ডে রক্ত চলাচলে সমস্যা বাড়ায়। এর কারণে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ধনেপাতা এই ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমিয়ে দেয় । আবার দেহের জন্য ভালো বা উপকারি এক ধরনের কোলেস্টেরল, এইচডিএল-এর মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে শরীর সুস্থ রাখতেও সাহায্য করে এই ধনেপাতা। ধনেপাতায় থাকা আয়রন রক্ত তৈরি বা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে। ধনেপাতায় রয়েছে প্রচুর ভিটামিন-কে। এই কারনে ধনেপাতা কোলেস্টেরলমুক্ত। ফলে দেহের চর্বির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ধনেপাতা। ধনেপাতা রক্ত পরিষ্কার করতেও অনেক সাহায্য করে।

রূপচর্চায় ধনে পাতাঃ রূপচর্চায়ও অনেক উপকারি এই ধনেপাতা। ত্বক ও চুলের ক্ষয়রোধ করে থাকে। ধনে পাতায় রয়েছে ভিটামিন এ , ভিটামিন সি, ফসফরাস ও ক্লোরিন। তাই প্রাকৃতিক ব্লিচ হিসেবে ধনে পাতা দারুন ভূমিকা। যাদের ঠোঁটে কালো দাগ আছে তারা রোজ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ধনে পাতার রসের সাথে দুধের সর মিশিয়ে ঠোঁটে লাগিয়ে রাখলে, এইভাবে এক মাস লাগালে ঠোঁটের কালো দাগ দূর হবে আর ঠোঁট কোমল ও সুন্দর হবে। এছাড়া ধনাপাতা ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধ করে থাকে।ধনে পাতায় আরো রয়েছে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ফাইবার, আয়রন, ফ্লেভোনয়েড, ম্যাগনেশিয়ামসহ বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান যা স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী। শীতকালীন ঠোঁট ও ত্বক ফাটা, ঠান্ডা লাগা, জ্বর জ্বর ভাব অনুভব হওয়ার ক্ষেত্রে বন্ধুর মতো কাজ করে এই পাতা। পরিমাণমতো ধনেপাতা খেলে তারুণ্য ধরে রাখা যায়।

ধনের বীজের গুনাগুনঃ ধনে গাছের বীজেরও রয়েছে নানাবিধ উপকারিতা। অর্থাৎ এরও রয়েছে ওষুধি গুণ। যেমন এর বীজের তেল ব্যাথানাশক, খাবার হজমে সহায়ক, ছত্রাকনাশক, খিদে বাড়ানোর ক্ষেত্রেও যথেষ্ট কাজ দেয়। ধনে পাতার রস দিয়ে দাঁত মাজলে মাড়ি মজবুত হয়। রক্ত পড়া বন্ধ করে ও মুখের দুর্গন্ধ দূর হয়। সাধারণত গ্যাসট্রিকের সমস্যা থাকলে মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে। ধনে গুঁড়ো তরকারিতে মসলা হিসেবে খাওয়ার প্রচলন রয়েছে বিভিন্ন দেশে। চিবিয়ে খাওয়া যায় গোটা ধনের বীজ।

পাকস্থলির সমস্যায় ধনে পাতাঃ ধনেপাতা শরীর ঠান্ডা রাখে এবং হজমে সাহায্য করে। আরো অনেক ক্ষেত্রে ধনে পাতা উপকার করে যেমন পেট ফাঁপা ও পাকস্থলির বিভিন্ন সমস্যা দূর করে হজমশক্তি বাড়াতেও সাহায্য করে। ধনেপাতা ক্ষুধা বৃদ্ধি করেও থাকে এবং বায়ুনাশক।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণঃ পুষ্টিবিদরা জানিয়েছেন, ধনে পাতা কেবল সৌন্দর্য আর স্বাদ বাড়াতেই অনন্য নয়, স্বাস্থ্যের জন্যও বেশ উপকারী। ধনে পাতা রক্তে চিনির পরিমাণ কমিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে।

মেয়েদের মাসিকেও কার্যকরঃ মেয়েদের মাসিকে অতিরিক্ত ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণে আনতেও ধনে পাতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য পাঁচশ মিলিলিটার পানিতে ছয় গ্রাম ধনে পাতা ফুটিয়ে নিতে হবে। এরপর ওই গরম পানিতে এক টেবিল চামচ চিনি ভালোভাবে মিশিয়ে খাইলে মাসিকের অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ নিরাময় করা যায়।

চুলকানি-পাঁচড়ায় ধনেপাতাঃ দেহের কাটা-ছেঁড়া অংশগুলো দ্রুত শুকানোর জন্য খুবই উপকারি এই উপাদান। দেহের চুলকানি-পাঁচড়ায় ধনেপাতার রস লাগালে তাড়াতাড়ি ভলো হয়ে যায়। অপারেশন বা আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত জায়গা দ্রুত নিরাময় করে এই ধনেপাতা।

দাঁতের রক্ত পড়া বন্ধতেঃ ধনেপাতা রক্ষা করে মুখের ভেতরের নরম অংশগুলোকে। এমনকি লড়াই করে মুখগহবরের ক্যান্সারের বিরুদ্ধেও। ধনেপাতা চিবিয়ে রস বের করে তা দিয়ে দাঁত মাজলে দাঁত থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয় খুব দ্রুত। সাথে মাড়িও শক্ত করতে সাহায্য করে ধনেপাতা।

মস্তিষ্কের রোগ নিরাময়েঃ ধনেপাতায় রয়েছে আলজিমারস নামক পদার্থ। এই পদার্থ মস্তিষ্কে রোগ নিরাময়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। ফলে ধনেপাতার গুনাগুনের জন্য মস্তিষ্কে কোন রোগ ঠিকভাবে বাসা বাধতে পারে না।

হাড় মজবুত করতেঃ হাড় মজবুত করতে ধনেপাতার গুন তো বলে শেষ করা যায় না। এটি হাড়কে মজবুত করে। সুতরাং ধনেপাতা নিয়মিত পরিমাণমত খাওয়া উচিত।

বাতের ব্যথা উপশমে
বাত ব্যথাই ধনেপাতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যে সকল মানুষের বাত এর সমস্যা থাকে। তারা যদি পরিমাণমত নিয়মিত ধনেপাতা খাই তাহলে বাত রোগ নিরাময় করতে পারবে। যেভাবে খেতে হবে- ধনে পাতা সিদ্ধ করে সেই পানি খেলে বাতের ব্যথা সেরে যায়।

চোখের রোগ নিরাময়েঃ ধনেপাতাই ভিটামিন-এ থাকে প্রচুর পরিমাণে। আর চোখের পুষ্টি জোগায় এই ভিটামিন-এ। যাদের রাতকানা রোগ আছে। তাদের জন্য ধনেপাতা অনেক উপকার। রাতকানা রোগ দূর করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে ধনেপাতা।

অর্শরোগে রক্ত বন্ধ করতেঃ অর্শরোগে ধনেপাতা অনেক সহায়ক। ধনেপাতার বেটে সেই রস খেলে অর্শরোগীর রক্ত পড়া বন্ধ হয়।

অরুচি বাড়াতে সহায়কঃ ধনেপাতা অত্যন্ত স্বাদময় সবজি। আর এই ধনেপাতা বেটে ভর্তা করে খেলে মুখের রুচি বাড়াতে সাহায্য করে। দেহের পিত্তও ঠান্ডা রাখে ধনেপাতা।

তথ্যসূত্রঃ এগ্রিকালচার লারনিং

ফার্মসএন্ডফার্মার/১৫জুন২০