চীনাবাদাম বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেলবীজ ফসল। তবে বাংলাদেশে চীনাবাদাম বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর খাদ্য তালিকায় উদ্ভিদ উৎস থেকে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য উপাদান। বর্তমানে বাংলাদেশে যা চীনাবাদাম উৎপাদিত হয় তা চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ মাত্র। এ চাহিদাকে সামনে রেখে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীগণের উন্নত জাত উদ্ভাবনের চেষ্টার অংশ হিসেবে চীনাবাদামের একটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছেন যা ‘বিনাচীনাবাদাম-৪’ নামে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক বাণিজ্যিকভাবে সারাবছর চাষাবাদের জন্য ছাড়পত্র পায়। এ জাতটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো জাতটি খরাসহিষ্ণু ফলে চর এলাকায় চাষাবাদের জন্য উপযোগী। কলার রট, সার্কোস্পোরা লিফ স্পট ও মরিচা রোগ সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন। বাদাম ও বীজ মাতৃজাত ঢাকা-১ এর চেয়ে বড়, ফলে বাজারে চাহিদা বেশি থাকার ফলে কৃষক সহজেই বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে। শীত মৌসুমে হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ২.৬০ টন এবং খরিফ মৌসুমে ২.৪৭ টন।
বপনের সময় :
বছরের যে কোনো সময় এর চাষ করা যায়, তবে রবি মৌসুমে মধ্য অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত (০১ কার্তিক হতে ১৫ ফাল্গুন) এবং খরিফ মৌসুমে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (আষাঢ়-আশ্বিন) পর্যন্ত বীজ বপন করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
চাষ উপযোগী জমি :
বেলে, বেলে, দো-আঁশ ও এঁটেল দো-আঁশ মাটিতে এ জাতের অধিক ফলন পাওয়া যায়। শুষ্ক জমি ছোলা চাষের জন্য বেশ উপযোগী।
জমি তৈরি, বপন পদ্ধতি ও বীজের পরিমাণ :
তিন-চারটি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হয়। শেষ চাষের সময় নির্ধারিত পরিমাণ সার দিয়ে চাষ ও মই দিতে হবে। বীজ সারিতে বপন করতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ১২ ইঞ্চি (৩০ সেমি.) এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৬ ইঞ্চি (১৫ সেমি.) রাখতে হবে। বীজগুলো ১.০-১.৫ ইঞ্চি মাটির নিচে পুঁতে দিতে হবে। হেক্টরপ্রতি ১২৫-১৩০ কেজি (একরপ্রতি ১৭ কেজি) বীজের প্রয়োজন হয়।
সার প্রয়োগ :
জমির উর্বরতার ওপর নির্ভর করে সারের মাত্রার তারতম্য হতে পারে। তবে সাধারণভাবে হেক্টর প্রতি ৬০-৮০ কেজি ইউরিয়া (একরপ্রতি ৯-১০ কেজি), ১০০-১২০ কেজি টিএসপি, এমপি ও জিপসাম (একরপ্রতি ১৪-১৫ কেজি) এবং ৩-৪ কেজি (একরপ্রতি ৫০০ গ্রাম) দস্তা সার প্রয়োগ করতে হয়। তবে বেলেমাটির ক্ষেত্রে বোরন ও মলিবডেনাম ১-১.৫ কেজিপ্রতি হেক্টরে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। জমি উর্বর হলে ইউরিয়া অর্ধেক প্রয়োগ করতে হবে এবং দস্তা সার প্রয়োগের প্রয়োজন নেই। সব প্রকার সার শেষ চাষের পূর্বে জমিতে ছিটেয়ে প্রয়োগ করতে হবে। অন্যদিকে জীবাণুসার ব্যবহার করলে ইউরিয়া প্রয়োগের প্রয়োজন নেই (জীবাণুসার একরপ্রতি ৩০০ গ্রাম)।
জীবাণুসার ব্যবহারের নিয়মাবলি :
ক. সুস্থ সতেজ ও শুকনা বীজে পরিমাণমতো চিটাগুড় মিশিয়ে নিন যাতে বীজগুলো আঠালো মনে হয় (চিটগুড়ের অভাবে ঠাণ্ডাভাতের মাড় বা পানি ব্যবহার করুন)।
খ. আঠালো বীজগুলোর সংগে জীবাণুসার ভালোভাবে মিশিয়ে নিন যাতে প্রতিটি বীজে কালো প্রলেপ পড়ে যায়।
গ. কালো প্রলেপযুক্ত বীজ ছায়ায় সামান্য শুকিয়ে নিন যাতে বীজগুলো গায়ে গায়ে লেগে না থাকে।
ঘ. জীবাণুসার মিশ্রিত বীজ রৌদ্রহীন বা খুবই অল্প রৌদ্রে বপন করে বীজগুলো মাটি দিয়ে তাড়াতাড়ি ঢেকে দিতে হবে।
ঙ. ঠাণ্ডা, শুষ্ক, রোদমুক্ত জায়গায় জীবাণুসার এবং জীবাণুসার মিশ্রিত বীজ রাখতে হবে। জীবাণুসার উৎপাদনের ১৮০ দিনের মধ্যেই ব্যবহার করা উত্তম।
আগাছা দমন :
চারা গজানোর ২৫-৩০ দিন পর নিড়ানি দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে হালকাভাবে আগাছা উঠিয়া ফেলতে হবে। শিকড়ে যেন কোনো প্রকার আঘাত না লাগে সেদিকে লক্ষ রাখা দরকার।
পানি সেচ :
চীনাবাদাম চাষে স্বাভাবিক অবস্থায় সেচ দেয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে পানির অত্যধিক অভাব হলে একবার হালকা সেচ দেয়া যেতে পারে।
পোকামাকড় দমন :
জমিতে বাদাম লাগানোর পরপর পিপিলিকা আক্রমণ করে রোপিত বাদামের দানা খেয়ে ফেলতে পারে। এজন্য বাদাম লাগানো শেষ হলেই ক্ষেতের চারদিকে সেভিন ডাস্ট ৬০ ডব্লিউপি ছিটিয়ি দিতে হবে। এছাড়া ক্ষেতের চারদিকে লাইন টেনে কেরোসিন তেল দিয়েও পিপিলিকা দমন করা য়ায়। অনুরূপভাবে, উঁইপোকা চীনাবাদাম গাছের এবং বাদামের যথেষ্ট ক্ষতি করে থাকে। এরা বাদাম গাছের প্রধান শিকড় কেটে দেয় অথবা শিকড়ের ভেতর গর্ত তৈরি করে। ফলে গাছ মারা যায়। উঁইপোকা মাটির নিচের বাদামের খোসা ছিদ্র করে বীজ খায়। পানির সঙ্গে কেরোসিন মিশিয়ে সেচ দিলে উঁইপোকা জমি ত্যাগ করে। অথবা উইপোকা দমনের জন্য ডায়াজিনন-১০ জি/বাসুডিন-১০ জি/ডারসবান-১০ জি যথাক্রমে হেক্টরপ্রতি ১৫, ১৪ ও ৭.৫ কেজি হারে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। বিছাপোকার আক্রমণের প্রথম অবস্থায় পাতার নিচে দলবদ্ধ বিছাগুলোকে হাত দিয়ে সংগ্রহ করে কোনো কিছু দিয়ে পিষে মেরে ফেলতে হবে।
রোগ দমন :
চীনাবাদাম-৪ জাতটি পাতার দাগ এবং মরিচা রোগ সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন। তবে ছত্রাকের আক্রমণ বেশি হলে ২ গ্রাম ব্যাভিস্টিন-৫০ ডব্লিউপি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে জমিতে বিকালে স্প্রে করতে হবে। বপনের পূর্বে ৩.০ গ্রাম ভিটাভেক্স-২০০/প্রোভ্যাক্স/বেভিস্টিন ৫০ ডব্লিউপি দ্বারা প্রতি কেজি বীজ শোধন করলে রোগের আত্রমণ কম হবে। মরিচা রোগ দেখা দিলে ফলিকুলার নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সঙ্গে ১ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে।
ফসল সংগ্রহ, মাড়াই ও সংরক্ষণ :
ভালো বীজ বা গুণগতমানের বীজ পেতে হলে ফসল যথাসময়ে উঠাতে হবে। ফসল সঠিক সময় তোলার জন্য ফসলের পরিপক্বতা সম্পর্কে যথাযথ ধারণা থাকা আবশ্যক। চীনাবাদাম বীজ খুবই স্পর্শকাতর বা সংবেদনশীল। যখন গাছের শতকরা ৮০-৯০ ভাগ বাদাম পরিপক্ব হবে তখনই চীনাবাদাম তোলার উপযুক্ত সময়। পরিপক্ব হলে বাদামের খোসার শিরা-উপশিরাগুলো স্পষ্টভাবে দেখা যায় এবং গাছের পাতাগুলো হলুদ রঙ ধারণ করে নিচের পাতা ঝড়ে পড়তে থাকে। বাদামের খোসা ভাঙার পর খোসার ভেতরে সাদা কালচে রঙ ধারণ করলেই বুঝতে হবে ফসল উঠানোর উপযুক্ত সময় হয়েছে। পরিপক্ব হওয়ার আগে বাদাম উঠালে তা ফল ও তেল কম হবে। আবার দেরিতে উঠালে বীজের সুপ্ততা না থাকার দরুন জমিতেই অংকুরিত হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে।
ক্ষেত থেকে তোলার পর বাদামের গায়ে লেগে থাকা মাটি বা বালু পরিষ্কার করতে হবে। তারপর আঁটিগুলো উপুর করে অর্থাৎ বাদামগুলো উপরের দিকে রেখে গাছের মাথা শুকনো মাটিতে বসিয়ে রৌদ্রে শুকাতে হবে। এতে করে বাদামের গায়ে লেগে থাকা পানি ঝড়ে যাবে। পরে গাছ থেকে বাদাম ছাড়িয়ে উজ্জ্বল রোদে দৈনিক ৭-৮ ঘণ্টা করে ৫-৬ দিন শুকাতে হবে। এ অবস্থায় বীজের আর্দ্রতা ৮-১০% হয়ে থাকে। এভাবে শুকানোর পর খোসাসহ বাদাম ঠাণ্ডা করে পলিথিন আচ্ছাদিত চটের বস্তায় মাচার ওপর সংরক্ষণ করতে হবে।
পরামর্শ/সতর্কতা : ১. এলাকায় উপযোগী জাত বাছাই করা। ২. বপনের আগেই বীজের গজানোর হার পরীক্ষা করা। ৩. একই জমিতে বার বার চীনাবাদাম চাষ না করা। প্রয়োজনে এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তার সাথে যোগযোগ করা।
ড. এম. মনজুরুল আলম মণ্ডল
প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার,
বিনা, ময়মনসিংহ।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৪ডিসেম্বর২০২০