শিং মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনা

1547

আবহমান কাল থেকেই আমাদের দেশে শিং মাছ অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি মাছ। খেতে খুবই সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর এই মাছের চাহিদা এবং বাজার মূল্যও অধিক। অতিরিক্ত শ্বসন অংগ থাকায় এরা জলজ পরিবেশের বাইরেও অনেকক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে। ফলে জীবন্ত বাজারজাত করা যায়। পূর্বে প্রাকৃতিক জলাভুমি বিশেষতঃ হাওড় বাওড়, বিল এবং পুরোনো পুকুরে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেলেও বর্তমানে এর প্রাপ্যতা খুবই কম। জলজ পরিবেশ বিভিন্ন কারণে বিপন্ন হওয়ায় এর প্রজনন এবং বিচরণ ক্ষেত্র সীমিত হয়ে পড়েছে। ফলে মাছটি বিলুপ্তপ্রায়। অত্যন্ত সুস্বাদু এই মাছটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা এবং চাষের জন্য প্রয়োজনীয় পোনা উৎপাদনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে গবেষণার মাধ্যমে কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন এবং চাষ ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। আমাদের দেশের অসংখ্য হাজা-মজা পুকুর ডোবা এবং নীচু জলাভূমি রয়েছে যেখানে শিং মাছ চাষকরা সম্ভব। আধুনিক চাষ প্রযুক্তির মাধ্যমে কার্পজাতীয় মাছের চেয়ে লাভজনক ভাবে শিং মাছ চাষকরা যেতে পারে।

শিং মাছের চাষ বৈশিষ্ট্য

 অধিক ঘনত্বে শিং মাছ চাষ করাযায়।

 কম গভীরতা সম্পন্ন পুকুরেও চাষকরা যায়

 জীবন্ত বাজারজাত করা যায়।

 তুলনামূলকভাবে বাজার মূল্যও অধিক।

প্রজনন ও চাষ ব্যবস্থাপনা

শিং মাছের চাষ লাভজনক এবং এই মাছ বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের উপযোগী হলেও পোনার অপ্রতুলতা হেতু এর চাষ তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত পোনা ব্যাপক চাষাবাদের জন্য যথেষ্ট নয়। এই জন্যই কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন একান্ত জরুরী। কৃত্রিম প্রজনন ও চাষ ব্যবস্থাপনার ধাপ গুলো নিম্নরূপঃ

প্রজননক্ষম মাছ সংগ্রহ ও পরিচর্যা

 কৃত্রিম প্রজননের জন্য ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারী মাসে প্রাকৃতিক উৎস থেকে সুস্থ সবল স্ত্রী ও পুরুষ মাছ সংগ্রহ করতে হবে।

 প্রতি হেক্টরে ১০,০০০টি মাছ মজুদ করতে হবে।

 মজুদকৃত মাছগুলোকে প্রতিদিন দেহের ওজনের শতকরা ৫-৬ ভাগ হারে সম্পুরক খাবার সরবরাহ করতে হবে।

 বাজারে প্রচলিত বাণিজ্যিক খাবার ব্যবহার করা যেতে পারে অথবা শতকরা ৪০ ভাগ ফিশমিল, ২০ ভাগ সরিষার খৈল, ২০ ভাগ চালের কুড়া, ১৫ ভাগ গমের ভূষি, ৪ ভাগ চিটাগুড় এবং ১ ভাগ ভিটামিন প্রিমিক্স সহযোগে এই খাবার তৈরী করা যেতে পারে। খাদ্যে প্রোটিন এর পরিমাণ ৩০ শতাংশ রাখতে হবে।

 মাঝে মাঝে জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।

কৃত্রিম প্রজনন

শিং মাছ এক বৎসর বয়সেই প্রজনন উপযোগী হয়। সাধারণতঃ মে থেকে সেপ্টেম্বর/অক্টোবর মাস র্পযন্ত এরা প্রজনন করে থাকে। কৃত্রিম প্রজননের জন্য সুস্থসবল স্ত্রীও পুরুষ মাছ বাছাই করতে হবে।

 পুকুর থেকে মাছ ধরে দ্রুত এবং সাবধানতার সাথে সিমেন্টের ট্যাংক বা হাপায় স্থানান্তর করতে

হবে এবং ক্রমাগত ৬-৮ ঘন্টা পানির প্রবাহ দিতে হবে।

হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগ

 শিং মাছের ক্ষেত্রে শুধু মাত্র স্ত্রী মাছটিকেই হরমোন ইনজেকশন দিতে হয়।

 মাছের পরিপক্কতা এবং প্রজনন সময়ের উপর ভিত্তি করে ৭০-৭৫ মি.গ্রা. পিজি (পিটুইটারীগন্ড) ব্যবহার করা হয়।

 ইনজেকশন দেয়ার পর স্ত্রী ও পুরুষ মাছ আলাদা ট্যাংকে রাখতে হবে।

 ইনজেকশন দেয়ার ৮-১০ ঘন্টার মধ্যে স্ত্রী মাছের পেটে চাপ দিয়ে ডিম বের করা হয়। এবং শুক্রানুর দ্রবণের সঙ্গে মিশিয়ে ডিম নিষিক্ত করা হয়।

 নিষিক্ত ডিম দ্রুততার সংগে ট্রেতে ছড়িয়ে দিতে হবে যাতে ডিমগুলো জমাট বেধে না যায়।

 নিষিক্ত ডিম ৮-১০ সে.মি. পানিতে রেখে ক্রমাগত পানির ঝরণা দিতে হবে।

 ২০ -২৪ ঘন্টার মধ্যে ডিম ফুটে রেনু পোনা বের হয়ে আসবে।

রেনু পোনা প্রতিপালন

 ডিম ফুটে রেণু পোনা বের হয়ে যাবার পর ডিমের খোসা সরিয়ে ফেলতে হবে।

 ডিম ফোটার ৩ দিন পর রেনু পোনাকে ডিমের কুসুম, টিউবিফেক্স ওয়ার্ম (ঞঁনরভবী ংঢ়ঢ়)। অথবা আর্টিমিয়া নপি-খেতে দেয়া হয়।

অঙ্গুলী পোনা উৎপাদন

 নার্সারী পুকুরে ৫-১০ দিন বয়সের ধানী পোনা মজুদ করে এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে অঙ্গুলী পোনা পাওয়া যায়।

 নার্সারী পুকুর সঠিকভাবে প্রস্তু‘ত করে ৫-১০ দিন বয়সের ধানী পোনা শতাংশ প্রতি ৮০০০-১০,০০০ টি পর্যন্ত মজুদ করা যেতে পারে।

 নার্সারী পুকুর ১ মিটার উচু জাল দিয়ে ঘিরে দিতে হবে যাতে ক্ষতিকর ব্যাঙ, সাপ পুকুরে প্রবেশ করতে না পারে।

 প্রাথমিকভাবে প্রতিদিন দেহের ওজনের ২ থেকে ৩ গুণ খাবার ২ বারে খাওয়াতে হবে।

 খাদ্য হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত চিংড়ি বা পাঙ্গাসের নার্সারী ফিড ব্যবহার করা যেতে পারে।

 পোনা ছাড়ার ৩০-৪৫ দিনের মধ্যে পোনার আকার গড়ে ৪-৫ সে.মি. হয়।

 পুকুর ছাড়াও স্টীলের ট্রে, সিমেন্টের ট্যাংক কিংবা জালের খাঁচায়ও অঙ্গুলী পোনা উৎপাদনকরা যেতে পারে।

 স্টীলের ট্রে, সিমেন্টের ট্যাংক কিংবা জালের খাঁচায় প্রতি বর্গমিটারে ১০০-২০০ টি ধানী পোনামজুদ করে ৩০-৪০ দিন পর অঙ্গুলী পোনা পাওয়া যায়।

এ ক্ষেত্রে খাদ্য হিসেবে নার্সারী ফিড বা জু-প্লাংকটন দেয়া যেতে পারে।

চাষ পদ্ধতি

শিং মাছ চাষের জন্য ১-১.৫ মিটার গভীরতা বিশিষ্ট পুকুর উপযুক্ত।

পুকুরের পাড় মেরামত করে পুকুর থেকে রাক্ষুসে মাছ সরিয়ে ফেলতে হবে।

পুকুর শুকিয়ে ফেলতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়।

প্রতি শতাংশে ১ কেজি চুন, ১০ কেজি গোবর, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ১০০ গ্রাম টিএসপিসার প্রয়োগ করে পুকুর তৈরী করতে হবে।

সার প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর পুকুরের পানি সবুজ বা হালকা বাদামী হলে পুকুরে শতাংশ প্রতি৭৫০-১০০০টি পোনা মজুদ করতে হবে।

খাদ্য প্রয়োগ

খাবার হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ক্যাটফিশ ফিড কিংবা নি¤েœ উল্লেখিত ফর্মুলা অনুযায়ী খাবার তৈরী করে দেয়া যেতে পারে।

খাদ্য উপাদান ফর্মূলা- ১ ফর্মূলা- ২

ফিশ মিল ৪০% ২৫%

বোন এন্ড মিট মিল ০% ১৫%

সরিষার খৈল ২০% ২০%

চালের কুড়া ২০% ২০%

গমের ভূষি ১৫% ১৫%

চিটা গুড় ৪% ৪%

ভিটামিন ও খনিজ লবন ১% ১%

 মাছের দেহের ওজনের ৪-৫% হারে দিনে ২ বার খাবার দিতে হবে।

রোগ ব্যবস্থাপনা

 শিং মাছ একটু শক্ত প্রকৃতির মাছ হওয়ায় রোগ ব্যাধি খুব একটা দেখা যায় না।

 পোণা মজুদকরণের সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে পোনা আঘাত প্রাপ্ত না হয়।

 পুকুরের পানি নষ্ট হলে পরির্বতন করতে হবে।

 পানির গুণাগুণ নষ্ট হলে মাছে ঘা দেখা দিতে পারে। এই রোগে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারেচুন এবং ১ কেজি লবণ দুই বারে তিন দিন অন্তর প্রয়োগ করতে হবে।

 এছাড়াও প্রতি মাসে পুকুরে ১/২ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করলে পানির গুণাগুণ ভালো থাকে।

মাছ আহরণ ও উৎপাদন

 জাল টানার র্পূবে পানি কমিয়ে নিতে হবে।

 পুকুরে জাল টেনে বেশীর ভাগ মাছ ধরতে হবে।

 সম্পূর্ণ মাছ আহরণ করতে হলে পুকুর শুকিয়ে ফেলতে হবে।

 সুষ্ঠুভাবে পরিচর্যা করলে ৮-১০ মাসে হেক্টর প্রতি ৮০০০-৯৫০০ কেজি পর্যন্ত উৎপাদন হতেপারে।

আয়/ব্যয়

 হেক্টর প্রতি উৎপাদন ৮০০০-৯৫০০ কেজি।

 হেক্টর প্রতি উৎপাদন খরচ ১০,২৫,০০০ -১৩,০০,০০০ টাকা।

 হেক্টর প্রতি মুনাফা ১৪,০০,০০০-১৭,০০,০০০ টাকা।

 ব্রুড ও মজুদকৃত মাছকে নিয়মিত সুষম খাবার সরবরাহ করতে হবে।

 নার্সারী পুকুরে ধানী পোনা ছাড়ার পূর্বে ক্ষতিকর হাঁস পোকা ব্যাঙাচি ইত্যাদি অপসারণকরতে হবে।

 নার্সারী পুকুর জাল দিয়ে ঘিরে দিতে হবে।

 চাষের পুকুরের পাড় উঁচু রাখতে হবে যাতে বর্ষায় মাছ বের হয়ে যেতে না পারে।

 সুস্থ সবল পোনা মজুদ করতে হবে।

 নিয়মিত জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।

 পানির গুনাগুনের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।

ড. অনুরাধা ভদ্র
লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট।

ফার্মসএন্ডফার্মার/৮মার্চ২০২১