মুরগির মাংস একটি পুষ্টিকর খাবার। আমরা রান্না, রোস্ট ও ফ্রাই করে মুরগির মাংস খেয়ে থাকি। আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মুরগির মাংস খুবই উপযোগী। কারণ মুরগির মাংসে প্রচুর প্রোটিন বিদ্যমান যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে থাকে। সারাবিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার সাথে সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব রটে যে মুরগির মাংস থেকে ভাইরাস মানব দেহে ছড়াতে পারে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে অনেক মানুষই মুরগির মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ খাওয়া ছেড়েই দিয়েছেন। অনেকে মনে করছেন করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মাংসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে শরীরে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কেউই মাংস খাওয়ায় বাধা নিষেধ দেননি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রাণিবিজ্ঞানীরাও বলছেন মাংস থেকে এই রোগের শিকার হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। মুরগির মাংস খেতে অভয় দিচ্ছেন ভারতের ভাইরাস বিশেষজ্ঞ সিদ্ধার্থ জোয়াদ্দার। তিনি বেশি পরিমাণে প্রোটিন খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। অধ্যাপক জোয়াদ্দারের বক্তব্য হলো আমাদের শরীরের প্রাণিজ প্রোটিন দরকার। সস্তায় প্রাণিজ প্রোটিন পাওয়া যায় মুরগির মাংস ও ডিম থেকে। মাংস না খেলে শরীরে প্রোটিনের ঘাটতি দেখা দিবে। তাতে করোনাভাইরাস শুধু নয়, মানবদেহে অন্য যেকোন ভাইরাসের আক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই পর্যাপ্ত প্রোটিনের জন্য আমাদের মুরগির মাংস খাওয়া একান্ত প্রয়োজন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO), ইউএস ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (FDA), ফুড স্টান্ডার্ডস ফর অস্ট্রেলিয়া এন্ড নিউজিল্যান্ড, ফুড সেইফটি অথোরিটি অব আয়ারল্যান্ড, ইউনিসেফ প্রভৃতি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান গুলোর মতে COVID-19 ফুডবর্ন ইলনেস বা খাবারের মাধ্যমে ছড়ায় এমন রোগ নয়। এটি খাবারের মাধ্যমে বা ফুড প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়ালস এর মাধ্যমে ছড়িয়েছে এমন কোনো কেইস এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। করোনাভাইরাস খাবারের মধ্যে সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে না। এর জন্য মানুষ বা এনিম্যাল বডির প্রয়োজন পড়ে। তবে অন্যান্য ভাইরাসের মতো এটি সারফেস বা অবজেক্টে বেশ কিছুসময় বেঁচে থাকতে পারে। সাম্প্রতিক গবেষণায় ল্যাবরেটরি কন্ডিশনে দেখা গেছে করোনাভাইরাস প্লাস্টিক ও স্টেইনলেস স্টিলে ৭২ ঘণ্টা, কপার সারফেসে ৪ ঘণ্টা, এবং কার্ডবোর্ডে সর্বোচ্চ ২৪ ঘণ্টা সক্রিয় থাকতে পারে।
ধারণা করা হচ্ছে কোন প্রাণির শরীরে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি হয়েছে। মাংস থেকে মানুষে ছড়িয়েছে এমন কোন কেইস এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। মাংস ভালভাবে ধুয়ে উপযুক্ত তাপমাত্রায় রান্না করে খেতে হবে। শুধু মাংসই নয় রান্না করে খেতে হয় এমন সব খাবারের জন্যই এটা প্রযোজ্য। যেহেতু এখনো এই রোগের কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি সেহেতু শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রোটিনের উৎস হিসেবে মাংস খাওয়া উচিৎ।
আগেই বলা হয়েছে করোনাভাইরাস ডিজিজ কোনো ফুডবর্ন ইলনেস নয়। তবুও ফুডবর্ন ইলনেস থেকে নিরাপদ থাকতে সেইফ ফুড হ্যান্ডেলিং বিষয়ে FDA প্রদত্ত গাইডলাইন অনুসরণ করা যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার জীবাণু থেকে মুক্তির জন্য রান্না করা পর্যন্ত ৪ টি সহজ ধাপে বিভক্ত। ১) পরিস্কার করা বা ধোয়া, ২) পৃথক করে রাখা, ৩) রান্না করা এবং ৪) ঠান্ডা করে রেফ্রিজারেটরে/ফ্রিজে রাখা।
পরিস্কার করা বা ধোয়া:
খাবার ধরার আগে এবং পরে গরম পানি ও সাবান দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। মাংস গরম পানিতে ভলো ভাবে ধুয়ে নিতে হবে। সামান্য গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে সেই পানিতে মাংস ধৌত করলে মাংসের গায়ে লেগে থাকা রোগ জীবণু অনেকটাই ধুয়ে যায়। খাবার তৈরির পর কাটিং বোর্ড, হাড়িপাতিল, বটি, চাকু ইত্যাদি গরম সাবান-পানি দিয়ে ভালভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে। রান্নাঘর পরিস্কার করার জন্য পেপার টাওয়েল বা টিস্যু পেপার ব্যবহার করতে হবে। কাপড় ব্যবহার করতে চাইলে গরম কোন মাধ্যমে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
পৃথকীকরণ:
কাঁচা মাছ, মাংস, পোল্ট্রি, ডিম ইত্যাদি বাজারের ব্যাগে, শপিং কার্টে এবং রেফ্রিজারেটরে অন্যান্য খাবার থেকে আলাদা করে রাখতে হবে।
মাছের জন্য আলাদা কাটিং বোর্ড এবং কাচা মাংস ও সি ফুডের জন্য আলাদা কাটিং বোর্ড ব্যবহার করতে হবে। কাচা মাছ বা মাংস রাখা হয়েছিলো এমন কোনো পাত্রে রান্না করা খাবার কখনোই রাখা যাবে না। রাখতে হলে পাত্রটি গরম সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
রান্না করা:
রান্না করার সময় উপযুক্ত তাপমাত্রায় খাবার রান্না করতে হবে। এক্ষেত্রে একটি ফুড থার্মোমিটার ব্যবহার করা যেতে পারে। খাবারের ভেতরের তাপমাত্রা নিম্নোক্ত স্কেলে পৌঁছলে খাবারটি নিরাপদ বলে ধরে নেয়া যেতে পারে । গরু/ছাগল/ভেড়ার মাংস: ১৪৫ °ফা. (৬৩ °সে.), মুরগি/পোল্ট্রি: ১৬৫ °ফা. (৭৪ °সে.), ডিম: কুসুম ও সাদা অংশ শক্ত হওয়া না পর্যন্ত, ডিমের তরকারি: ১৬০ °ফা. (৭১ °সে.), মাছ: ১৪৫ °ফা. (৬৩ °সে.), চিংড়ি: মাংস মুক্তোর মতো অস্বচ্ছ না হওয়া পর্যন্ত।
ঠান্ডা করে রেফ্রিজারেটরে/ফ্রিজে রাখা:
ফ্রিজেও বেঁচে থাকতে পারে এই ভাইরাসটি। তাই ফ্রিজ সবসময় পরিস্কার রাখতে হবে। তাছাড়া মাংস ফ্রিজে সংরক্ষণের সময় সচেতন থাকলেও এড়ানো যায় কারোনা গ্রুপের এই কোভিড-১৯ এর আক্রমণ। রান্নার পর খাবার ঠান্ডা করে তাৎক্ষনিকভাবে রেফ্রিজারেটরে (৪-৫° সে.)/ফ্রিজে (-১৮ °সে.) রাখতে হবে । মাছ, মাংস, পোল্ট্রি, সি ফুড ও অন্যান্য পচনশীল খাবার রান্না করা বা কেনার ২ ঘণ্টার মাঝে রেফ্রিজারেটর/ফ্রিজে রাখতে হবে। বাইরের তাপমাত্রা ৩২°সে. এর বেশি হলে ১ ঘণ্টার মধ্যেই রেফ্রিজারেটর/ফ্রিজে রাখা উচিত। মাংস সহ যে কোন খাবার ফ্রিজে রাখার পর তা গরম করে খাওয়ার আগে ফ্রিজ থেকে বের করে কিছুক্ষণ বাহিরে রাখতে হবে। তার পর খাবারটি ভলো করে গরম করে খেতে হবে।
সাধারণ মানুষ বা পশুর দেহের মাধ্যমেই বিপজ্জনক আকার ধারণ করে করোনা ভাইরাস। মুরগির বা অন্য যে কোন মাংস বেশি তাপমাত্রায় রান্না করলে আর ভাইরাস থাকার আশঙ্কা থাকে না। তাই রান্না করার সময় মাংস ভালো করে সিদ্ধ করে রান্না করতে হবে। আমরা যে তাপমাত্রায় মাংস রান্না করে খাই তাতে সাধারণত ভাইরাস বেঁচে থাকতে পারে না। ফলে নির্ভয়ে খাওয়া যায় মুরগির মাংস ও ডিমের মতো সুস্বাদু খাবারগুলো।
লেখকঃ কৃষিবিদ ডক্টর মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন
ডীন, কৃষি এবং কৃষি অর্থনীতি অনুষদ
এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
সূত্র: আধুনিক কৃষি খামার
ফার্মসএন্ডফার্মার/ ২৮ এপ্রিল ২০২১