বাচ্চা বড় করার জায়গা বা ঘরটা এমন হওয়া দরকার যেন সেখানে ৮ সপ্তাহ পর্যন্ত বাচ্চা তার দরকারি জিনিস পর্যাপ্ত পরিমাণে পায়। এখানে বাচ্চার প্রাথমিক দরকার তাপ। ৮ সপ্তাহ পরে বাচ্চাকে নিয়ে যাওয়া হয় বাচ্চা পালন গ্রুইং পেন ঘরে। এখানে বাচ্চা থাকবে ৮ সপ্তাহ থেকে ২০ সপ্তাহ পর্যন্ত । এখন বাচ্চারা বেশ বড় হয়ে গেছে । ব্রয়লার মুরগি ৮ সপ্তাহ পরে যায় বিক্রির জায়গায়। আর বাচ্চা মুরগি বাচ্চা পালন ঘরে। ২০ সপ্তাহ পরে বাচ্চা মুরগি যায় পাকাপাকিভাবে ডিমপাড়া ঘরে। ২০ সপ্তাহ পরে মুরগি পালন করবার জন্য খাচাও অনেকে ব্যবহার করেন। এখানে ডিম দেওয়া মুরগি ৭৮-৮০ সপ্তাহ থাকে। এরপরেই মুরগি বাজারে মাংস হয়ে বিক্রি হতে চলে যায়।
একদিনের মুরগির বাচ্চাকে ২ ভাবে বড় করা যায়
(১) স্বাভাবিক ভাবে
(২) কৃত্রিম ভাবে।
বাচ্চা পালনে বিস্তৃত পরিসরে যাবার আগে এটা জানা দরকার যে কৃত্রিমভাবে ডিম ফুটিয়ে যেসব বাচ্চা তৈরি করা হয়েছে তাদের কৃত্রিমভাবে বড় করা উচিত।
মুরগির বাচ্চা স্বাভাবিকভাবে বা প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় করাঃ
৩০/৪০ বছর আগে আমাদের দেশের প্রায় সব জায়গায় প্রকৃতির পরিবেশে মুরগির বাচ্চা বড় করা হত। মানুষের ক্রমাগত খাবারের চাহিদা এবং দিন গুজরানের ব্যবসায়িক হাতিয়ার হিসেবে দিনে দিনে প্রায় সব ছোট বড় খামারে কৃত্রিমভাবে ডিম ফোটানো এবং কৃত্রিমভাবে পোটানো ডিম থেকে বেড় হওয়া বাচ্চা বড় করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে ডিম ফোটাবার কারণও ছিল অনেক। আগে খাবার ডিম হিসেবে মুরগি মোরগ পালন করা হত। উৎসব এলে, অতিথি অভ্যাগতের মনোরঞ্জনে দুই একটি মুরগি জবাই করা হত। তখন বছরে ১৫/১৬৯ টি ডিম বা দুটি মোড়গ মুরগি মাংস হিসেবে একটা পরিবারে খাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। আজ সেই পরিবারেই বছরে কয়েক হাজার ডিম এবং এক কুইন্টাল মুরগির মাংস খাওয়া হয়।
একদিনের শাবক বড় করার ব্যাপারে দেশি মুরগির আদর্শ। মাতৃ-স্নেহে ভরপুর, ছোট দেহ। বাচ্চাদের সহজে চাপা দিয়ে মারে না।
দেহের মাপ অনুসারে একটি বেশি মুরগি অনায়াসে ১৫ থেকে ২০ টি বাচ্চা বড় করতে পারে। বাচ্চাদের দেহে যতটা গরম দরকার পালিকা মা মুরগি সেটা দিতে পারবে। পালিকা মাকে বাচ্চাদের কাছে ছাড়বার আগে অবশ্য পালিকার স্বাস্থ্য, বিশেষ করে তার দেহে উকুন আছে কিনা দেখে নিতে হবে।
ঝুড়ি বা খাঁচা দিয়ে বাচ্চা বড় করা: এই ধরনের খাচা বা ঝুড়ি নানা ধরনের জিনিস দিয়ে হতে পারে। প্যাকিং বাক্স, কাঠের বাক্স, ফুটোওলা গামলা, বড়ো টব প্রভূতি। এই খাচা দুই ফিট উচু হলেই যথেষ্ট। তবে দেখতে হবে খাচা যেন খুকনো, টেকসই, সস্তা, জায়গাবহুল এবং নিরাপত্তাজনক হয় সস্তার কথা মনে রেখে। খাচার মোট জায়গা হবে ৪ বর্গ ফুটের মতো। উচ্চতায় সামনের দিকে ১৮”, মাথার দিকে ঢাকা কিন্তু ঢালু থাকবে।
মা এবং বাচ্চাদের খাবারঃ প্রথম সপ্তাহে বাচ্চা প্রতি অল্প পরিমাণ খাবার বারে বারে দিতে হবে। দুই ঘন্টা অন্তর হলে ভালো হয়। খাবার থাকবে বাচ্চা মুরগির সুষম খাদ্য যেটা পানিতে বা দুধে মিশিয়ে কাদা কাদা করে নিতে হবে। প্রথমে খাবার দিতে হবে সমতল কোনো পাত্রে। পালিকা মুরগিকে দিতে হবে ভেজা অথবা শুকনো সুষম মুরগি খাদ্য। যে সুষম খাদ্যের মুরগিটির বাড় এনে দেবে। মুরগির খাবার এমনভাবে দিতে হবে যাতে বাচ্চা মুরগি সেখানে মুখ দিতে না পারে। বাচ্চা এবং ধাত্রী মায়ের জন্য প্রচুর পরিষ্কার ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা করতে হবে।
অন্যান্য পরিচর্যাঃ খাঁচা বা বাচ্চাদের আশ্রয় স্থান রীতিমত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং কীটনাশক ওষুধ দিয়ে উকুন, মাইট এবং টিক প্রভূতি রক্তচোষা পরজীবী কীটদের ধ্বংস করতে হবে। বাচ্চা যেখানে চরে বেড়াবে সে জায়গাটা জাল দিয়ে ঘেরা থাকবে। চরে বেড়াবার জায়গাটা যেন ইদুর বেড়ালে নষ্ট করে না দেয়। রাতের বেলায় বাদুড় এবং পেচায় উপদ্রব ঠেকাবার ব্যবস্থাও পাকাপাকি ভাবে করা উচিত। প্রথম সপ্তাহে মারবে রোগ ৰং রাণীঙ্তে রোগের জন্য টিকা দিতে হব প্রথম সপ্তাহেই ঠোট ছেটে দিতে হবে। বাচ্চাদের বয়স ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ হলে মুরগি বসন্ত(Fowl Pox)এবং রানীক্ষেত রোগের বিরুদ্ধে টিকা নেওয়াতে হবে।
মুরগির খাঁচা এবং ঘোরাফেরার জায়গা বদল করাঃ মুরগির বাচ্চাদের খাঁচা এবং বেড়াবার জায়গা মাঝে মাঝেই এক জায়গা থেকে অপর জায়গায় সিরয়ে নিয়ে যাওয়া ভালো। এর ফলে বাচ্চাদের রোগভোগ কম হবে এবং পরজীবী আক্রমণ কমে যাবে। দিনে একবার কি দুই বার পালিকা মা এবং বাচ্চাদের সুর্যস্নান করানো ভালো।
কৃত্রিমভাবে মুরগির বাচ্চাদের বড় করা: মানে অবশ্যই বুঝতে পারছেন। কৃত্রিমভাবে যথন বড় করার কথা বলা হছ্ছে তখন পালিকা মায়ের দরকার পড়বে না। এখানে বাচ্চাদের বড় করা হয় স্রেফ কৃত্রিমভাবে বাচ্চাদের তাপ জুগিয়ে। স্বাভাবিকভাবে মুরগির বাচ্চা বড় করার চেয়ে কৃত্রিম ভাবে বড় করার কতোগুলি সুবিধে আছে তারা হল,
(১) ঋতুর যে কোন সময়ে বাচ্চা বড় করা যায়,
(২) হাজারের ওপর বাচ্চা মাত্র একজনমানুষ বড় করতে পারে।
(৩) বাচ্চা বড় করার স্বাস্থ্য বিধানগুলি এই ব্যবস্থায় সহজেই জানা যায়,
(৪) বাচ্চার পক্ষে উপযুক্ত তাপের নিয়ন্ত্রণ সুষ্ঠুভাবে পালন করা যেতে পারে,
(৫) বাচ্চাদের খাওয়ানোর ব্যাপারটা পরিকল্পনা মোতাবেক করা যেতে পারে।
বাজারে বাচ্চাদের বড় করার শাবক ঘর নানা মাপোর আর ধাপের পাওয়া যায়। এবং তাপ দেবার ব্যবস্থাও বিভিন্ন। মাপ, নির্দেশনাবলী, মুরগির সংখ্যা এবং দাম নানা ধরনের হয়। একটি আদর্শ শাবক ঘরের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসটি হবে, তাপ নিয়ন্ত্রিত, নিয়মিত পরিশুদ্ধ বাতাস যোগানো, শুকনো ভাব, দরকার মতো আলো, বিচরণের খোলা জায়গা, বীজানুমুক্ত করার সহজ উপায়, বাচ্চাদের শুক্রদের থেকে রক্ষা, আগুন থেকে বাচানো, এবং সস্তায় নির্মাণ খরচ ইত্যাদি।
বাচ্চা ঘর গরম করার নানা ব্যবস্থা থাকতে পারে, কয়লা, কেরোসিন তেল, গ্যাস, বিদু্যৎ অর্থাৎ যে কোন জিনিসি যেটা স্থানীয় জায়গায় পাওয়া যাবে এবং মুরগি পালকের ধরা ছোয়ার মধ্যে হবে। তাপ নিয়ন্ত্রণের কথা যদি তোলা হয় তবে বিদু্যৎ হচ্ছে সবচেয়ে ভালো। ঝুড়ি শাবক ঘর(Basket Brooder)এবং প্যাকিং বাক্স থেকে তৈরী শাবক ঘর বাজারে খুবই চালু। অবশ্য ব্যবস্থাটা তখনই খাটবে যদি বাচ্চার সংখ্যা কম হয়। যদি বাচ্চার সংখ্যা খুবই বেশি হয় তবে ব্যাটারি শাবক ঘর খুবই কাজের। এই ব্যাটারি শাবক ঘরে বহুতল ব্যবস্থা আছে এবং খাবার দেয়ারও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আছে। সমস্ত ব্যাটারি শাবক ঘর স্বয়ংক্রিয় ভাবে গরম থাকবে। খুব বড় বড় খামারে আজকাল এই ধরনের শাবক ঘরে বাচ্চা বড় করা হয়।
শাবক ঘরে বাচ্চা মুরগির পরিচর্যা
(১) বাচ্চা ঘরে ঠিকমতো তাপ দিতে হবে যেটা ওপরে বলা হয়েছে। যদি স্টোভে গরম করার ব্যবস্থা থাকে তবে দেখতে হবে স্টোভে বা ল্যাম্পে কোন গন্ডগোল আছে কিনা। কোন কারনেই যেন বাচ্চারা উত্তপ্ত আলোর কাছে না পৌছাতে পারে-সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
(২) ঘরে অবশ্যই স্যাতসেতে ভাব যেন না থাকে। এটা এড়ানো যাবে বাচ্চা ঘরে পুরুস্তরের বিছানা(Deep litter) বিছিয়ে।
(৩) বাচ্চারা যেন বিছানার বিচুলি (খড়) খাবার অভ্যাস না করে। বাচ্চাদের খাবার দিতে হবে বাচ্চারা ১ দিনের হলে শক্ত পিচবোর্ডের ওপর। কিছুটা বড় মুরগিদের জন্য খাবারের জায়গা (Chick hoppers)সবসময় যেন খাবারে ভর্তি থাকে। পরীক্ষিত এবং শাবকদের সুষম খাবার দিতে হবে।
(৪) টাটকা বাতাস আসবার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
(৫) বাচ্চাদের বয়স ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ হলে ওদের দাড়ে বসানো অভ্যাস করতে হবে। বাচ্চাদের খুব তাড়াতাড়ি দাড়ে বসা অভ্যাস করালে মেঝেতে ভিড় কমবে। সেই সাথে বিছানা থেকে তৈরি রোগ ব্যাধির হাত থেকেও মুক্ত থাকবে ওরা।
(৬) বাচ্চাদের সামনে পরিষ্কার মোটামুটি ঠান্ডা পানি দিনে অন্তত দুই বার রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
(৭) বাচ্চা তিন সপ্তাহের বেশি বয়স হয়ে গেলে ওদের কুচানে ঘাস দেবার ব্যবস্থা করুন।
(৮) প্রতিদিন বাচ্চা ঘর খাবার এবং পানির পাত্র সহ পরিষ্কার করতে হবে।
(৯) নিয়মিত বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় টিকা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
(১০) সবসময় বাচ্চ ঘর যেন বাচ্চাদের ভীড়ে ভরাট না থাকে। বীড় হলে বাচ্চা বাড়বে কম এবং মারাত্নক ব্যাধির সম্ভাবনা বাড়বে।
(১১) বাচ্চা ঘর এমন জায়গায় করতে হবে যেন ঠান্ডা বাসাত এবং বৃষ্টি বাচ্চাদের ব্যতিব্যস্ত করে না তোলো।
(১২) প্রতিদিন বাচ্চাদের পরিদর্শন করুন। দিনে যতবার বেশি পারেন তত ভাল। লক্ষ্য করতে হবে কোন অস্বভাবিকতা নজরে পড়ে কিনা। সবসময়ে পশু চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে।
(১৩) বাচ্চাদের শাবক ঘরে আনবার আগে একবার ঘরের আসবাব, তাপমান যন্ত্র, পানি এবং খাবারের জায়গাগুলি ভালভাবে পরীক্ষা করে নিতে হবে। কোন অসামঞ্জস্য বা ক্রুটি থাকলে সেটা অবশ্যই ঠিক করে নিতে হবে। লেখক: আবদুল্লাহ আল মামুন, উপ-পরিচালক, বংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট।
ফার্মসএন্ডফার্মার/ ১২অক্টোবর ২০২২