গরু উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনের সুফল দিকসমূহ

195

এই চিত্র স্বস্তিকর না হইয়া পারে না যে, দেশ বর্তমানে গরু উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। চতুষ্পদী এই গৃহপালিত প্রাণীর জন্য একদা বহুলাংশে প্রতিবেশী দেশটির উপর নির্ভর করিতে হইলেও এখন দেশের অভ্যন্তরেই গড়িয়া উঠিয়াছে অনেক খামার। কিন্তু সীমান্তে চোরাচালান বন্ধ না হইবার কারণে এখনও সম্পূর্ণ স্বনির্ভর হইয়া উঠিতে পারি নাই আমরা। এই প্রেক্ষাপটে ভারত হইতে গরু আসিবার পথ বন্ধ করিবার বিকল্প না থাকিবার যেই প্রয়োজনীয়তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ব্যক্ত করিয়াছেন, উহা প্রণিধানযোগ্য।

বলিবার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের গরুর চাহিদা তুঙ্গে উঠিয়া যায় ঈদুল আজহার সময়। অর্ধযুগ পূর্বেও ভারতীয় গরু ব্যতীত দেশে কোরবানির পশুর হাট কল্পনাই করা যাইত না। বর্তমানে কোরবানির পশুর হাটে ভারতীয় গরুর উপস্থিতি ক্রমশ হ্রাস পাইয়া প্রায় শূন্যের নিকটবর্তী। ২০১৩ সালে করিডোরের মাধ্যমে প্রায় ২৩ লক্ষ ভারতীয় গরু বাংলাদেশে আসিলেও পরের বৎসর বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হইবার পর বাংলাদেশে ভারতীয় গরুর ‘আমদানি’ বন্ধ হইয়া যায়। বস্তুত উহাই বাংলাদেশের জন্য শাপে বর হইয়াছে। বর্তমানে বাংলাদেশ গবাদি পশুতে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হইয়া গরুর মাংস রপ্তানিও করিতেছে। গোসম্পদের জন্য সীমান্ত বন্ধ হইবার ইহা প্রথম ইতিবাচক দিক।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ কৃষিশুমারির প্রতিবেদন হইতে জানা যাইতেছে, বাংলাদেশ এখন ছাগ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এতদ্ভিন্ন গত এক দশকে দেশে মৎস্যসম্পদ উৎপাদনেও ধারাবাহিক অগ্রগতি সাধিত হইয়াছে। পরিসংখ্যান অনুসারে, মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম, যাহার বৈশ্বিক স্বীকৃতিও ইতোমধ্যে মিলিয়াছে। ছাগ ও মৎস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হইতে পারিলে গোসম্পদে উহা অর্জন অসম্ভব হইতে পারে না।

দ্বিতীয় ইতিবাচক দিক হইতেছে, ইতোমধ্যে বর্ধিত গরু উৎপাদন অভ্যন্তরীণ মাংসের চাহিদা মিটাইয়া বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে ভূমিকা পালন করিয়াছে। তৎসহিত গবাদি পশুপালনের মাধ্যমে অনেক পরিবারেরই দারিদ্র্য বিমোচন হইয়াছে। ইহা সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি, বিশেষত গ্রামীণ অর্থনীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখিয়াছে। এমনকি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, গত বৎসর কোরবানির ঈদে গবাদি পশুর যে চাহিদা ছিল, তাহার অপেক্ষা অধিক পশু প্রস্তুত ছিল। কারণ কোরবানির জন্য খামারিরা গরু পালন করিতেছেন এবং ব্যক্তি পর্যায়েও বসতবাড়িতে অনেকে গরু উৎপাদনে আগ্রহী হইয়াছেন।

তৃতীয়ত, ভারতীয় গরু আমদানি হ্রাস পাওয়ায় খুরা রোগ, অ্যানথ্রাক্সসহ রোগ-বালাইও দূর হইয়াছে বহুলাংশে। অন্যদিকে খাদ্য নিরাপত্তাও জোরদার হইয়াছে। গরুর উৎপাদন এবং তৎসঙ্গে দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন বাড়িয়াছে। করোনাসহ বৈশ্বিক সংকটে দেশের খাদ্যপণ্য উৎপাদনে কৃষক যেমন খাদ্য নিরাপত্তায় অসাধারণ ভূমিকা রাখিতেছে; তদ্রূপ গরু উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও তাহাদের অবদান অনস্বীকার্য। সম্পূর্ণ স্বনির্ভর হইবার জন্য গরু পালনকারীদের সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা, অল্প ব্যয়ে গোখাদ্যের জোগান নিশ্চিতকরণ জরুরি।

ভারতীয় গরু আমদানি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হইলে চতুর্থ ইতিবাচক প্রভাব পড়িতে পারে সীমান্তের ফৌজদারি পরিস্থিতিতেও। স্বীকার করিতেই হইবে- সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর গুলিতে যে সকল বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হইয়া থাকে, তাহাদের একটি বৃহৎ অংশ গরু চোরাচালানের সহিত সম্পৃক্ত। যদিও মনে রাখিতে হইবে, চোরাচালানি হইলেও এই প্রকারে কোনো দেশের নাগরিককে হত্যা করা উচিত নহে; কিন্তু সীমান্তে গরুর কারবার দূর করিলে সেই ঠুনকো অজুহাতের অবকাশও নিঃসন্দেহে থাকিবে না।

ইহাও ভুলিয়া যাওয়া চলিবে না, গরু উৎপাদনে আমাদের স্বনির্ভরতা আসিলেও বাজারে গরুর মাংস এখনও উচ্চমূল্য। তাহা অনেক ক্ষেত্রে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তেরও নাগালের বাহিরে। চলমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে গোমাংস যাহাতে মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে এবং নাগরিকের আমিষের চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখিতে পারে, সেই লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। গরু উৎপাদনের বিষয়টি বাৎসরিক পরিকল্পনায় রাখিলে আমিষের দিক হইতে বৃহত্তর সমাজ উপকৃত হইবে বলিয়া আমাদের বিশ্বাস। তবে সর্বাগ্রে নজর দিতে হইবে ভারতীয় গরুর উপর নির্ভরতা হ্রাসের প্রতি। এই উদ্দেশ্যে যেইরূপ সীমান্তে, সেইরূপ অভ্যন্তরেও প্রেরণা ও প্রণোদনা জরুরি।