মসলাজাতীয় কালোজিরা মাঝারি ধরনের নরম মৌসুমি ফসল। আজকের আয়োজন এর নানা দিক নিয়ে
জনপ্রিয় ও সুপরিচিত একটি ফসল কালোজিরা। এটি বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। এটি একটি মাঝারি আকৃতির মৌসুমি গাছ, একবার ফুল ও ফল হয়। স্ত্রী, পুরুষ দুই ধরনের ফুল হয়। পাঁচটি পাঁপড়ি-বিশিষ্ট ও কিনারায় একটা বাড়তি অংশ থাকে। তিন কোনা আকৃতির কালো রঙের বীজ কালোজিরা। একে আবার গোলাকারও বলা যায়। আরবি ভাষায় বলা হয়, হাব্বাত-আল-বারাকাহ অর্থাৎ আশীর্বাদপুষ্ট বীজ, যার ফল শুষ্ক বীজকোষ হিসেবে পরিচিত।
তিন হাজার বছর ধরে কালোজিরা মসলা ও ঔষধি গাছ হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়। বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সিনা তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ক্যানন অব মেডিসিন’-এ ‘কালোজিরা দেহের প্রাণশক্তি বাড়ায় ও ক্লান্তি দূর করে’ উল্লেখ করেন।
ফসলটির উৎপত্তি মূলত পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও মধ্যপ্রাচ্যে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মিসর, ইরাক, সিরিয়া, ইরান, জাপান, চীন, তুরস্ক প্রভৃতি দেশে এর চাষাবাদ হয়। এছাড়া আয়ুর্বেদীয়, ইউনানি, কবিরাজি ও লোকজ চিকিৎসায় ব্যবহƒত হয়। মসলা হিসেবে ব্যাপক ব্যবহার হয়। বীজ থেকে পাওয়া যায় তেল।
জমি তৈরি: যে কোনো মাটিতে জন্মায়। তবে বেলে-দোআঁশ মাটিতে ফলন ভালো হয়। অগ্রহায়ণের মাঝামাঝিতে জো এলে জমি তৈরি করা যায়। ভালো করে লাঙল দিয়ে জমি চাষ করতে হবে, পরে মই দিতে হবে। ১০ শতাংশ বা তার কম জমিতে চাষ করলে পাঁচ সেন্টিমিটার উঁচু বেড তৈরি করা ভালো। খেয়াল রাখতে হবে যাতে ১৫ সেন্টিমিটার মাটি আলগা থাকে। প্রচুর রোদ পড়ে এমন যে কোনো সমতল জমি প্রয়োজন।
বারি কালোজিরা-১: জাতটির জীবনকাল ১৩৫ থেকে ১৪৫ দিন। এর উচ্চতা ৫৫ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার। প্রতিটি গাছে পাঁচ থেকে সাতটি প্রাথমিক শাখায় ২০ থেকে ২৫টি ফল থাকে। প্রতিটি ফলের ভেতরে প্রায় ৭৫ থেকে ৮০টি বীজ থাকে। হেক্টরপ্রতি এর গড় ফলন দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে এক টন। স্থানীয় জাতের তুলনায় এর রোগবালাই কম।
বপন: এক ফুট বা ৩০ সেন্টিমিটার দূরত্বে এক থেকে চার ইঞ্চি গর্ত করে প্রতি গর্তে দুই থেকে তিনটি করে বীজ পুঁতে দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, বীজ যেন বেশি গভীরে না যায়। ১২ থেকে ১৬ দিন অর্থাৎ দুই সপ্তাহের মধ্যে গজাবে। ১০ শতাংশ জমিতে ৩৫০ থেকে ৪০০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন। তবে বোনার আগে ভালো করে ধুয়ে ধুলাবালি, চিটা বীজ প্রভৃতি সরিয়ে ফেলতে হবে। তবে ভেজা বীজ বপন করা ভালো।
পোকা আক্রমণের লক্ষণ
# পোকার কিড়া ফল ছিদ্র করে বীজ খেয়ে ফেলে আক্রমণের আগে করণীয়
# উন্নত জাতের চাষ করা
# মিশ্র ফসল হিসেবে ধনে পাতা বা তিষির চাষ করা
আক্রমণের পরে করণীয়
# পোকার ডিম ও কিড়া সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে
# রিকর্ড বা ডেসিস ১০ মিলিমিটার ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর এক থেকে দুবার স্প্রে করতে হবে।
ফলন: ১০ শতাংশ জমিতে গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি কালোজিরা পাওয়া যায়।
সংগ্রহ ও সংরক্ষণ: গাছে সামান্য রস থাকতে ফল সংগ্রহ করতে হবে। তা না হলে বীজ জমিতে ঝরে পড়তে পারে। চটের বস্তা বা মাটির পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করতে হবে। এতে এক বছর পর্যন্ত বীজ সংরক্ষণ করা যায়। শুকনো ও অন্ধকার জায়গায় রাখতে হবে।
পরিচিতি
কালোজিরা মাঝারি জাতীয় নরম মৌসুমি গাছ। এ গাছ একবার ফুল ও ফল ধরে মরে যায়। এটি ২০ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার অর্থাৎ আট থেকে ১২ ইঞ্চি পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে।
কালোজিরার পাতা সরু ও চিকন। পাতা সবুজের মধ্যে ছাই রঙের। জোড়া ধরে সোজা হয়ে পাতা জš§ায়। স্ত্রী ও পুরুষ দুই ধরনের ফুল হয়। ফুল নীলচে সাদা রঙের হয়ে থাকে। আবার জাতভেদে হলুদাভও হয়। পাঁচটি পাঁপড়িযুক্ত হয়।
ফল গোলাকার। এর বীজ কালো রঙের ও প্রায় তিন কোণাকৃতির। বীজকোষ খাঁজ আকারে ফলের সঙ্গে লম্বালম্বিভাবে থাকে। প্রতিটি ফলে ২০ থেকে ২৫ বীজ থাকতে পারে।
কালোজিরা মূলত মসলা হিসেবে বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। পাঁচফোড়নের একটি উপাদানও বলা যায় একে। ইউনানি, কবিরাজি ও লোকজ চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। প্রসাধনীতেও এর ব্যবহার চোখে পড়ে।
অপার সম্ভাবনার কালোজিরা
কালোজিরা শুধু মসলা জাতীয় ফসল নয় মৃত্যু ছাড়া সব রোগের মহৌষধ। এমন কথার প্রচলন রয়েছে। এটি চাষ করে লাভবান হচ্ছেন কৃষক। বিশেষ করে নড়াইল, মাদারীপুর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও যশোরে এর চাষ করা হয়। কালোজিরা চাষে অনেক কৃষকের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। ফলে এসব জেলার কৃষকরা ধানের পরিবর্তে কালোজিরার চাষে বেশি ঝুঁকে পড়ছেন। কম খরচে বেশি মুনাফা লাভের আশায় কালোজিরার চাষ হচ্ছে। অনেক স্থানে একে ‘কালো সোনা’ বলে অভিহিত করা হয়। কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, এসব অঞ্চলের আবহাওয়া কালোজিরা চাষে খুবই উপযোগী। তাই ভবিষ্যতে কালোজিরা এসব জেলায় কালো সোনা নামেই খ্যাতি লাভ করবে।
কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায় যে, চলতি বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বাম্পার ফলনের স্বপ্ন দেখছেন কৃষকরা। বিঘাপ্রতি কালোজিরা উৎপাদন হয়ে থাকে প্রায় আট মণ। বর্তমান বাজারদর বিঘাপ্রতি এক থেকে দেড় লাখ টাকা। কালোজিরা চাষ করে লাভবান হয়েছেন মাদারীপুর সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের এওজ গ্রামের যদুনাথ মণ্ডলের ছেলে তপন মণ্ডল। তপন মণ্ডল বলেন, আমি ৫৪ শতাংশ জমিতে কালোজিরা চাষ করেছিলাম। ফলন খুব ভালো হয়েছে। খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। যদি প্রাকৃতিক কোনো ধরনের সমস্যা দেখা না দেয় ও মধ্যস্বত্বভোগী না থাকে, আর যদি বাজারে ন্যায্য দাম পাওয়া যায় তাহলে ৮০ থেকে এক লাখ টাকা লাভ হবে। আগেও কালোজিরা চাষ করে লাভবান হয়েছি। তাই এবারও চাষ করেছি। আমার দেখাদেখি এলাকার অনেকে আগ্রহী হয়েছেন। অনেক চাষি আমার কাছ থেকে পরামর্শও নিচ্ছেন। তবে সরকারিভাবে পরামর্শ, বীজ, সার দিয়ে সহযোগিতা করা হলে অসহায় চাষিরা আরও বেশি জমিতে কালোজিরা চাষ করতে আগ্রহী হবে।
একই কথা বলেছেন নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কালোজিরা চাষি ইসমাঈল শেখ। তিনি বলেন, বর্তমান বাজারে কালোজিরার যে দাম পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এ কালোজিরা আমাদের কাছে সোনা হয়ে দেখা দেবে। এ বছর আবহাওয়াও বেশ অনুকূলে থাকায় কালোজিরার বাম্পার ফলনের স্বপ্ন দেখছি। তিনি আরও বলেন, উপজেলা কৃষি অফিস থেকে সার-বীজ সরবরাহ করে তাদের পরামর্শ ও সহযোগিতায় দুই বিঘা জমিতে কালোজিরার চাষ করেছি। এতে খরচ হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার টাকা। বাজারদর যদি ঠিক থাকে তাহলে প্রায় লাখ টাকার কালোজিরা বিক্রি করা যাবে। ভবিষ্যতে দ্বিগুণ জমিতে কালোজিরা চাষ হবে বলে আশা করা যায়।
পদ্মা যমুনার চরের বেলে-দোআঁশ মাটির পতিত জমি কম টাকায় লিজ নিয়ে অনেকেই কালোজিরার চাষ করছেন। কেউ কেউ উৎপাদিত ফসলের সঙ্গেও চাষ করছেন। কালোজিরা চাষে প্রথমবার বীজ কিনলে চলে। পরে নিজের ক্ষেতের বীজ দিয়ে আবাদ করা যায়।
কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কম খরচে বেশি মুনাফা লাভের আশায় নানা সময়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে কৃষকদের মসলা জাতীয় ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ করা হয় বলেই চাষিরা অধিক হারে কালোজিরা চাষ করছেন।
পরিচর্যা
পরিচর্যা ছাড়া কোনো শস্যের আশাতীত উৎপাদন সম্ভব নয়। কালোজিরার বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। এর দরকার পরিচর্যা।
শুরুতে বীজ লাগানোর পর হালকা করে মাটি দিয়ে গর্ত ঢেকে দিতে হবে। পাখি যাতে বীজ খেতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। প্রয়োজনে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। জমি বেশি ভেজা থাকলে মাটি আলগা করে রস বের করে দিতে হবে।
সেচ
সেচের প্রয়োজন নেই। তবে নতুন চারা লাগানোর পর রোদ বেশি হলে ছিটিয়ে পানি দেওয়া যেতে পারে। সন্ধ্যার দিকে পানি ছিটিয়ে দেওয়া উত্তম।
সার ব্যবস্থাপনা
১০ শতাংশ জমি ১০ কেজি পচা গোবর ও দুই কেজি পচা খৈল অথবা পরিমাণমতো যে কোনো কম্পোস্ট মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে বেড তৈরি করা যেতে পারে। মিহি মাটি দিয়ে সামান্য উঁচু বেড তৈরি করলে বেশি সার লাগে না।
কার্তিক-অগ্রহায়ণের মাঝামাঝিতে মাটিতে জো এলে জমি তৈরি করতে পারেন। সার মেশানোর এক সপ্তাহ পরে প্রয়োজনে একবার নিড়ানি দিয়ে বেড তৈরি করুন। জমি তৈরির সময় একবার ও পরে আরও একবার সার ব্যবহার করতে হবে।