খামারটিতে রয়েছে দেশি-বিদেশি জাতের ৮১টি গাভি। এসব গাভির দাম প্রায় কোটি টাকা। খামারের পাশেই রয়েছে সার ও কীটনাশকের বড় দোকান। এ ব্যবসায় রয়েছে প্রায় ৫০ লাখ টাকা মূলধন। এবার হিমাগারে রয়েছে ১৬ হাজার বস্তা আলু। এসব সম্পদের মালিকের নাম মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামের বাসিন্দা।
এই মোস্তাফিজুরই ছোটবেলায় অন্যের বাড়িতে কামলা দিতেন। নিজের শ্রম-ঘামের বিনিময়ে এসব গড়েছেন তিনি। এরই মধ্যে কেটেছে ২৪ বছর।তবে মোস্তাফিজুরের শুরুর গল্পটি অন্যরকম। ভালোবাসার মানুষকে পেতেই জীবনসংগ্রাম তাঁর।
মোস্তাফিজুরের বাবার নাম আব্দুর রাজ্জাক। মায়ের নাম মজিদা বিবি। তাঁর বাবা ছিলেন হতদরিদ্র। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় তিনি। ছোটবেলায় বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেন তিনি। মাও ঝিয়ের কাজ করতেন।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘অর্থের অভাবে ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে পারিনি। অন্যের বাড়িতে কাজ করেছি শৈশব থেকেই। কাজের ফাঁকে বাড়ির পাশে দাখিল মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেছি।’
১৯৯৯ সালে মোস্তাফিজুর দাখিল পাস করেন। এরপর ভর্তি হন আলিম শ্রেণিতে। সে সময় পরিচয় হয় একই গ্রামের বিত্তবান মতিয়র রহমানের মেয়ে মাদ্রাসার ছাত্রী মাহবুবার সঙ্গে। পরিচয় থেকে প্রেমের সম্পর্ক। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের প্রেমের কথা জেনে যায় মেয়ের পরিবার– বলছিলেন তিনি।
দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া মোস্তাফিজুরের সঙ্গে বিত্তবান ঘরের মেয়ের এমন সম্পর্ক যেন ‘জাত-কুল’ যায় অবস্থা। বেঁকে বসেন মেয়ের বাবা। এমন দরিদ্র ঘরের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে নয়। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র নন মোস্তাফিজুর। ভালোবাসার মানুষের সাহসেই তিনি মুখোমুখি হন মেয়ের মা-বাবার। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সময় চান তিনি। মেয়ের পরিবারের কথা– নিজেকে ‘যোগ্য’ করে গড়তে পারলে বিয়েতে কোনো বাধা থাকবে না। এর পরই নিজেকে প্রমাণ করতে জীবন-সংগ্রাম নতুন করে শুরু করেন তিনি।
বাবার মৃত্যুর পর অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতেন আগে থেকেই। সেই কাজ থেকে ২ হাজার ২৫০ টাকা জমিয়ে তা দিয়ে এলাকায় কৃষিপণ্য কেনাবেচা শুরু করেন মোস্তাফিজুর। এভাবে বাড়তে থাকে পুঁজি। ছোট ভাইকে দোকানে বসিয়ে তিনি স্থানীয় হিমাগারে আলুর বস্তা উঠানো ও নামানোর কাজ করেন। এ জন্য কর্মক্ষেত্রে তাঁকে অপমানিতও হতে হয়েছে। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে সেই টাকা ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। সেই ঋণ পরিশোধ করে প্রায় ৫ লাখ টাকা আয় করেন অল্প সময়ের মধ্যেই। এর মধ্যে আলিম পাসও করেন। তাঁর এমন সাফল্য দেখে পছন্দের মানুষের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হয় মেয়ের পরিবার।
পারিবারিক সম্মতিতে ২০০১ সালের শেষের দিকে পছন্দের মানুষের সঙ্গে ঘর বাঁধেন মোস্তাফিজুর। এখন তাঁর সংসারে যোগ হয়েছে তিন কন্যা। বিয়ের পর মোস্তাফিজুর শুরু করেন আলু কেনাবেচার ব্যবসা। ২০০৬ সালে ৮৪ কেজি ওজনের ১ হাজার ৫০০ বস্তা আলু কিনে রাখেন হিমাগারে। পাঁচ মাস পর সেই আলু বিক্রি করে তাঁর লাভ হয় প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ টাকা।
২০০৭ সালে ৯ শতক জায়গা কিনে নুনুজ বাজারে সার ও কীটনাশকের ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এভাবে কেটে গেছে বেশ কয়েক বছর। ২০১৯ সালে দোকানের পেছনে একটি শেড তৈরি করেন। সেই শেডে দুটি ফ্রিজিয়ান জাতের গাভি কিনে শুরু করেন ‘মায়া এন্ড মিশু’ ডেইরি এগ্রো ফার্ম। ফার্মটি তাঁর বড় দুই মেয়ে মায়া (৫) ও মিশুর (৩) নামে নামকরণ করেন। এরপর তিনি ওই ফার্মে ছোট আকারের দেশি-বিদেশি জাতের (বকনা বাছুর) গাভি ক্রয় করে লালন-পালন করতে থাকেন।
সম্প্রতি খামারে গিয়ে দেখা গেছে, কর্মচারীদের নিয়ে গরুর পরিচর্যা করছেন মোস্তাফিজুর। খামারের পাশাপাশি প্রায় ১০ বিঘা জমিতে হাইব্রিড জাতের ঘাস রয়েছে। খামারের চাহিদা মিটিয়ে ঘাসও বিক্রি করছেন তিনি।
স্থানীয় আব্দুল ওয়ারেছ বলেন, পরিশ্রম আর সততা দিয়ে স্বপ্ন বাস্তবায়নের পাশাপাশি দারিদ্র্যকে জয় করেছেন মোস্তাফিজুর।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা হাসান আলী বলেন, মোস্তাফিজুর একজন সফল খামারি। তাঁকে সবাই এখন অনুসরণ করছেন।