বছরের পর বছর ধরে রংপুরে ধানসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন হয়ে আসছে। তবে ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় দিন দিন বেড়েছে হতাশা। এখন সেই হতাশার ছাপ কেটে গেছে। স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় হাঁড়িভাঙ্গা আম বদলে দিয়েছে এখনকার চাষিদের পরিচয়। ধানচাষিরা এখন আমচাষি। প্রতি বছর আম চাষ করে লাখ লাখ টাকা আয় করে শুরু হয়েছে তাদের দিন বদলের গল্প। ভাগ্য বদলে গেছে হাজার হাজার আমচাষি ও কৃষকের। হাঁড়িভাঙ্গা আম যেন রংপুরের অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।
আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ বছর ২২০-২৫০ কোটি টাকার আম বিক্রির আশা স্থানীয় আমচাষিদের। তবে আবহাওয়া ভালো থাকলে হাঁড়িভাঙ্গাসহ বিভিন্ন জাতের আম দেশের চাহিদা মিটিয়ে এবারও বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
বিষমুক্ত ও অতি সুমিষ্ট আঁশহীন হাঁড়িভাঙ্গা আমের চাহিদা বাড়ছে দিন দিন। কয়েক বছর ধরে ফলন ভালো হওয়ায় বেড়ে চলেছে আম উৎপাদনের পরিধিও। রংপুর সদর, মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জ উপজেলার বিস্তৃত এলাকার ফসলি জমি, বাগানসহ উঁচু-নিচু ও পরিত্যক্ত জমিতে চাষ হচ্ছে এই আম।
রংপুর সদর এলাকা ছেড়ে মিঠাপুকুরের খোড়াগাছ ইউনিয়নের পদাগঞ্জে যেতে দেখা মিলবে সারি সারি গাছ। রাস্তার দুপাশে যেন হাঁড়িভাঙ্গা আম গাছের সবুজ বিপ্লব। ধানসহ বিভিন্ন ফসলি জমির আইলে আইলে লাগানো হয়েছে আমের গাছ। বাদ পড়েনি বসতবাড়ির পরিত্যক্ত জায়গা, পুকুরপাড়, বাড়ির উঠান। এখন গাছে গাছে দোল খাচ্ছে অপরিপক্ব হাঁড়িভাঙ্গা। একই চিত্র মিঠাপুকুরের আখিরাহাট, মাঠেরহাট, বদরগঞ্জের গোপালপুর, নাগেরহাট, সর্দারপাড়া, রংপুর সদরের সদ্যপুষ্করনী ইউনিয়নের কাঁটাবাড়ি, পালিচড়া এলাকাতেও।
গত কয়েক বছরের মতো এবারও হাঁড়িভাঙ্গার বাম্পার ফলন হয়েছে। যদিও হাঁড়িভাঙ্গার দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় চাষি এবং ব্যবসায়ীরা। প্রতি বছর কম বেশি শত কোটি টাকার ওপরে বিক্রি হয় হাঁড়িভাঙ্গা আম। কিন্তু আমের জন্য খ্যাত শ্যামপুরের পদাগঞ্জ হাটের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি না হওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছেন চাষিরা। সঠিক সময়ে আম বাজারজাত ও পরিবহন সুবিধা বাড়ানো না গেলে রয়েছে লোকসানের আশঙ্কা।
কৃষি বিভাগ বলছেন, জুনের শেষ সপ্তাহে বাজারে মিলবে পরিপক্ব হাঁড়িভাঙ্গা আম। এর আগে বাজারে হাঁড়িভাঙ্গা আম পাওয়া গেলেও তা অপরিপক্ব হবে। হাঁড়িভাঙ্গার প্রকৃত স্বাদ পেতে জুনের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে।
বর্তমানে বাগানগুলোতে আমের পরিচর্যা চলছে। নির্ধারিত সময়ে আম বাগান মালিক ও চাষিরা গাছ থেকে হাঁড়িভাঙ্গা আম পাড়তে পারবেন। এরপর থেকে শুরু হবে বাজারজাত। তবে চাষি ও ব্যবসায়ীদের দাবিÑআবহাওয়া প্রতিকূলে বা প্রচণ্ড গরম থাকলে জুনের শুরুতেই বাণিজ্যিকভাবে বাজারে হাঁড়িভাঙ্গা আম বিক্রি শুরু হবে।
রংপুর সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর রংপুর জেলায় ১ হাজার ৯০৫ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় বেশি। তাছাড়া ঝড় কিংবা বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় আমের তেমন ক্ষতি হয়নি। তবে ১ মাসের অধিক দাবদাহ থাকায় কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। তারপরও গত বছরের তুলনায় এবার বেশি আমের ফলন হয়েছে।
খোড়াগাছ ইউনিয়নের তেকানি গ্রামের আমচাষি শাহ্জাহান মিয়া। বছর দশেক আগেও তিনি শুধু ধান, ভুট্টা আর পাট চাষ করতেন। কিন্তু গ্রামে হাঁড়িভাঙ্গা আম গাছের বাগানের পর বাগান দেখে তিনিও আমের বাগান গড়ে তোলেন।
অর্থনৈতিকভাবে লাভবান এই আমচাষি বলেন,‘ আল্লায় দেচে এবার আম ভালো হইচে। গাছোত আম দেকে মনে শান্তি পাই। আল্লাহ রহম করলে আম ব্যাচে ঋণ পরিশোধ করমো। হাঁড়িভাঙ্গা আম খুব সুস্বাদু মিষ্টি। চাহিদাও অনেক বেশি। এবার আশা করি ভালোয় বেচা বিক্রি হইবে।’
হাঁড়িভাঙ্গা আমকে ঘিরে বেকারের সংখ্যাও কমেছে রংপুরসহ আশপাশের কয়েকটি উপজেলায়। বিশেষত মিঠাপুকুরের লালপুর, পদাগঞ্জ, তেকানিসহ আশপাশের গ্রামের বেকার যুবকরা এখন আম ব্যবসায় জড়িয়ে বেকারত্ব দূর করেছেন। অনেকে আবার উদ্যোক্তা হিসেবে হাঁড়িভাঙ্গার বাজার সম্প্রসারণ ও চাষাবাদ বাড়ানোর জন্য কাজ করছেন।
তরুণ উদ্যোক্তা ও আমচাষি মেহেদী হাসান পলাশ বলেন, প্রথমে পরীক্ষণমূলকভাবে আম চাষ শুরু করেছিলাম। লাভবান হওয়ার পর থেকে এখন বাণিজ্যিকভাবে হাঁড়িভাঙ্গা আমের চাষাবাদ ও ব্যবসা করছি। নিজের পাশাপাশি এলাকার অন্যদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে চেষ্টাও করছি।
টেকসই অর্থনীতির জন্য হিমাগার স্থাপন, আধুনিক আমচাষ পদ্ধতি বাস্তবায়ন, গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনসহ হাঁড়িভাঙ্গাকে জিআই পণ্য হিসেবে ঘোষণার দাবি জানান জানান হাঁড়িভাঙ্গা আমের সম্প্রসারক আব্দুস সালাম সরকার।
তিনি বলেন, সরকার প্রধানের উদ্যোগে দেশ-বিদেশে হাঁড়িভাঙ্গা আম রপ্তানি শুরু হয়েছে। আমরা এতে খুশি। তবে আর একটু দৃষ্টি দিলেই হাঁড়িভাঙ্গাকে ঘিরেই এই অঞ্চলের অর্থনীতি আরও সচল হবে। এজন্য সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষি বিপণন ও পরিবহন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা জরুরি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান বলেন, গত বছর ১ হাজার ৮৬৫ হেক্টর জমিতে হাঁড়িভাঙ্গা আমের চাষ হয়। এবার তা বেড়ে ১ হাজার ৯০৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। দেশের অন্যান্য স্থানের আম শেষ হয়ে যাওয়ার পর হাঁড়িভাঙ্গা আম বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসে। জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে এ আম বাজারে আসবে। শুধু হাঁড়িভাঙ্গা আমই দেরি করে বাজারে আসে না, গৌরমুখী ও বারি-৪ জাতের আম আরও পরে পেকে থাকে। তবে হাঁড়িভাঙ্গা আমের মতো সেগুলোর বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি নেই।
রংপুরের জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীন বলেন, হাঁড়িভাঙ্গা আমের বাজারজাত করতে যাতে কোনো ধরনের অসুবিধা না হয়, সেটি মনিটরিং করা হবে। বিশেষ করে পরিবহনে ব্যবসায়ীদের কোনো হয়রানির শিকার হতে না হয়, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশাপাশি সরকারি পরিবহন সুবিধার বিষয়টিও দেখা হবে।