রঙিন ফুলকপি চাষে কৃষকের মুখে হাসি

99

সবুজ পাতার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে বিভিন্ন রঙের ফুল। দূর থেকে মনে হতে পারে ফুল, কিন্তু এসব ফুল নয়। এক ধরনের ফুলকপি। উচ্চ মানের পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ সবজি হিসেবে রঙিন ফুলকপি পরিচিত। ফেরোমন ফাঁদ, হলুদ ফাঁদসহ জৈব বালাইনাশক বায়ো চমক ব্যবহার করা হয়েছে রঙিন ফুলকপি চাষে।

দৃষ্টিনন্দন রঙিন ফুলকপি দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি বাজারে ক্রেতার চাহিদাও বেশি। অধিক পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ সবজি হিসেবে নজর কাড়ছে কৃষি বিভাগ, চাষিসহ ভোক্তাদের। কৃষি বিপ্লবে সাড়া ফেলছে ‘রঙিন ফুলকপি’। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে বিভিন্ন রঙের এই ফুলকপি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এই প্রথম ব্যাপক সাড়া ফেলেছে কমলা ও বেগুনি রঙের ফুলকপির চাষ। অবাক লাগলেও সাদার বদলে নানা রঙের ফুলকপির দেখা মিলছে উত্তরের জেলা রংপুরের তারাগঞ্জে। স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শে এই প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে রঙিন ফুলকপি চাষ করে সফলতা পেয়েছেন চাষিরা।

জানা গেছে, রংপুর বিভাগ কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় রংপুরের তারাগঞ্জে কুর্শা ইউনিয়নের পলাশবাড়ী গ্রামের অবিনাশ চন্দ্র ও ইকরচালী ইউনিয়নের জগদীশপুর গ্রামের মাসুদ রানা পরীক্ষামূলকভাবে রঙিন ফুলকপির চাষ করেছেন।

কৃষক অবিনাশ চন্দ্র বলেন, কৃষি অফিসের সহযোগিতায় রঙিন ফুলকপির চারা, সার, কীটনাশকসহ সার্বিক সহায়তা পেয়েছি। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি ওই চারাগুলো রোপণ করেছি। রাসায়নিকের পাশাপাশি জৈব সার ব্যবহার করেছি। সাদা ফুলকপির চেয়ে রঙিন ফুলকপি উৎপাদন খরচ কম। প্রায় তিন মাসের মধ্যে ফলন আসে। বাজারে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। প্রতিটি রঙিন ফুলকপি ৫০-৬০ টাকায় জমিতে বিক্রি করেছি। এবারে জমিতে সাদা ফুলকপির চেয়ে চার-পাঁচগুণ লাভবান হয়েছে এ কপি চাষ করে। প্রতিবেশীসহ আশপাশের লোকজন প্রতিদিন ক্ষেতে দেখতে আসছেন।

অন্যদিকে মাসুদ রানা তারাগঞ্জের ইকরচালি ইউনিয়নে নিজের ৩০ শতক জমিতে বাণিজ্যিকভাবে এই রঙিন ফুলকপি চাষ করেছেন। ভালো ফলনের পাশাপাশি পাওয়া যাচ্ছে ভালো দামও। বাজারে নেয়া মাত্রই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে এসব রঙিন ফুলকপি। মাঝারি আকৃতির একেকটি ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে প্রথম রঙিন ফুলকপি চাষ শুরু করে। তবে রংপুরে এবারই প্রথম চাষ হচ্ছে। ‘নিরাপদ উচ্চ মূল্য ফসল চাষ’  প্রযুক্তি ব্যবহার করে রংপুর বিভাগের কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এসব রঙিন ফুলকপি চাষ করা হচ্ছে।

এদিকে প্রথমবারের মতো রঙিন ফুলকপি চাষে অবিনাশ চন্দ্র ও মাসুদ রানার সাফল্য স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। তাদের এই রঙিন ফুলকপির সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিনই ভিড় করছেন কৃষকসহ উৎসুক মানুষ। তাদের কেউ ফুলকপি কিনছেন, আবার কেউ চাষের বিষয়ে পরামর্শ নিচ্ছেন।

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালি ইউনিয়নের চরক ডাঙ্গা গ্রামের কৃষক মাসুদ রানা বলেন, বাড়ির পাশেই ৩০ শতক জমিতে প্রতি বছর নানা সবজি চাষ করি। এবার স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শে তিন হাজার চারা পরীক্ষামূলকভাবে কমলা ও বেগুনি রঙের ফুলকপি চাষ করে ভালো ফলন পেয়েছি।

উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. ওয়াজেদ আলী বলেন, চাষিরা এ ফুলকপি চাষে প্রথমে কেউ আগ্রহ দেখাননি। পরে কৃষক মাসুদ রানা আগ্রহ দেখালে তাকে কৃষি অফিস থেকে ফুলকপির চারা, জৈব সার, কীটনাশক ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ইউরোপ, চীনসহ অন্যান্য দেশে এ জাতের ফুলকপি সালাদ হিসেবে খাওয়া হয়। সাদা ফুলকপির চেয়ে রঙিন ফুলকপিতে পুষ্টিগুণ বেশি। দেখতেও সুন্দর। সাধারণ ফুলকপি চাষে যে পদ্ধতি ওই একই পদ্ধতিতে রঙিন ফুলকপি চাষ হয়। খরচ ও পরিশ্রম একই। শুধু জৈব সার ব্যবহার করেই এই ফুলকপি চাষ করা যায়।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঊর্মি তাবাসসুম বলেন, ফুলকপিতে সালফার, পটাশিয়াম ও ফসফরাস-জাতীয় খনিজ উপাদান রয়েছে। এ ছাড়া প্রতি ১০০ গ্রাম খাবারযোগ্য কপিতে ৯০ দশমিক ৮ গ্রাম পানি, ২ দশমিক ৬ গ্রাম আমিষ, শূন্য দশমিক ৪ গ্রাম চর্বি, শূন্য দশমিক ৪ গ্রাম শ্বেতসার এবং এক দশমিক ৯ গ্রাম খনিজ লবণ রয়েছে। পুষ্টিগুণে ভরপুর এই রঙিন ফুলকপি। সাদা ফুলকপির চেয়ে রঙিন ফুলকপির পুষ্টিগুণ বেশি। উপজেলায় দুটি প্রদর্শনী পরীক্ষামূলক করা হয়েছে। চাষিরা ভালো ফলন ও দাম পেয়ে বেশ খুশি।

তিনি আরও বলেন, বেগুনি ফুলকপি রান্নার পর বিবর্ণ হলেও কমলা ফুলকপি বিবর্ণ হয় না। তবে বেগুনি ফুলকপি সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর। অন্যান্য কিছু সবজি ও পণ্যে এমন উপাদান পাওয়া যায়। কমলা ফুলকপির মতো বেগুনি ফুলকপিতেও সাদা ফুলকপির তুলনায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অনেক বেশি থাকে। বেগুনি ফুলকপি প্রদাহ উপশম, কার্ডিওভাসকুল্যার সমস্যা ও ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে বেশ উপকারী।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন বলেন, রংপুর জেলার মধ্যে তারাগঞ্জে পরীক্ষামূলকভাবে ভ্যালেন্টিনা ও ক্যারোটিনা জাতের রঙিন ফুলকপি দুটি প্রদর্শন করা হয়েছে। ফলন ও দাম ভালো পেলে উচ্চ মূল্য নিরাপদ সবজি প্রদর্শনী আগামীতে রংপুর বিভাগে কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় করা হবে।