সার ব্যবহারের ফলপ্রসূতা অনেকাংশে নির্ভর করে প্রয়োগের সময় ও প্রয়োগ পদ্ধতির উপর। বিশেষ করে নাইট্রোজেন সারের ক্ষেত্রে তা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ নাইট্রেজেন পানিতে দ্রবনীয় এবং সহজে বিভিন্ন উপায়ে মাটি হতে অপচয় হয়। কোন কোন পরিস্থিতিতে প্রয়োগকৃত নাইট্রোজেন সারের ৭০% মাটি থেকে অপচয় হয় যা ফসলের নাগালের বাইরে চলে যায়। সার ব্যয় বহুল একটা উপকরণ। এ কারেণে প্রয়োগকৃত সারের ফলপ্রসূতা বাড়ানোর জন্য প্রচেষ্টা চালানো উচিৎ।
সার প্রয়োগে নিম্ন বর্ণিত সাধারণ নীতি মালা অনুসরণ করা উচিতঃ
১। রাসায়নিক সার কোন বীজ, নতুন শিকড় ও গুল্ম- জাতীয় গাছের কান্ডের অতি সন্নিকটে বা কোন ভিজা কচি পাতার ওপর ব্যবহার করা উজিত নয়। ঘনীভুত লবন বিধায় এগুলো গাছের নাজুক সকল বাড়ন্ত অংশকে পুড়িয়ে দিতে পারে।
২। সার যতদূর সম্ভব ভালভাবে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে।
৩। ইউরিয়া সার দাড়ানো বেশী গভীর পানিতে প্রয়োগ করা উচিৎ নয়। এতে বেশির ভাগ নাইট্রোজেন অপচয় হতে পারে।
৪। জিংক ও ফসফেট সার একত্রে মিশিয়ে প্রয়োগ করা উচিৎ নয়। কেননা, এ উপাদান গুলো, একে অপরের সংগে আবদ্ধ হয়ে যায় এবং ফসলের জন্য তা গ্রহণোপযোগী হয় না।
৫। জৈব সার ফসল বপন/ রোপনের কমপক্ষে ৭-১০ দিন পূর্বে জমিতে প্রয়োগ করে মাটির সঙ্গে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। সবুজ সারের (ধৈঞ্চা) পর ধান চাষ করতে গেলে যতশীঘ্র সম্ভব ধানের চারা রোপণ করতে হবে। সবুজ সার মাটিতে মিশানোর ৭ দিন পর ধানের চারা রোপণ করতে হবে।
৬। গৌণ উপাদানের দ্রবণ পাতায় সিঞ্চন করা যেতে পারে ( বিশেষ করে উদ্যান ফসলের ক্ষেত্রে)।
৭। সাধারণ ইউরিয়ার পরিবর্তে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করলে শতকরা ১৫-২০ ভাগ বেশি ফসল পাওয়া যায়। গুটি ইউরিয়া পরিমানে শতকরা ৩০ ভাগ কম লাগে। মৌসুমে একবার ব্যবহার করতে হয়। যে জমিতে পানি কম চূষে যায়, কেবল সে জমিতেই ব্যবহার যোগ্য।
সারের ফলপ্রদ ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জমিতে তিন পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ করা হয়। হাতে ছিটানো, স্থানীয় প্রয়োগ এবং পাতায় বা পল্বব গুচ্ছে সিঞ্চন। হাতে ছিটানো, স্থানীয় প্রয়াগ সাধারণত ফল বাগান ও সব্জীতে করা হয়।
রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলপ্রসূতা বাড়ানোর জন্য ফসল ও মৌসুমের ওপর ভিত্তি করে, নিম্নে বর্ণিত সাধারণ নির্দেশাবলী অনুসরণ করা উচিত।
১। রবি মৌসুমে সেচের সুবিধা না থাকলে, জমি তৈরির শেষ পর্যায়ে ইউরিয়ার পূর্ণ মাত্রায় প্রয়োগ করে তা মাটির সংগে মিশিয়ে দিতে হবে।
২। পানি সেচের ব্যবস্থা থাকলে, ইউরিয়া ৩ অংশে ভাগ করে প্রয়োগ করা উচিত। প্রথম অংশ শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। ফসলের দ্রুত আংগিক বৃদ্ধির সময় দ্বিতীয় বার এবং কাঁইচ থোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে তৃতীয় ও শেষ বার ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে।
৩। বোনা আমন ছাড়া অন্যান্য ধান চাষের বেলায় ইউরিয়া সমান ৩ ভাগে ভাগ করে প্রয়োগ করতে হয়। রোপা ধানের বেলায় শেষ চাষে বা ধানের চারা মাটিতে লেগে যাওয়ার পরপরই ( আগাছা থাকলে তা পরিস্কার করে) প্রথমবার ইউরিয়া প্রযোগ করে মাটির সাথে ভাল ভাবে মিশিয়ে দিতে হয়। বোনা ধান চাষের বেলায় কুশি বের হওয়ার পূর্বে প্রথম দফার ইউরিয়া ছিটিয়ে তা ভালভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এ সময় মাটি উত্তম রুপে ভেজা থাকা দরকার। দ্রুত কুশি বের হবার পর্যায়ে অথবা দ্বিতীয়বার আগাছা বাছাইয়ের সময় উপরি প্রয়োগ হিসেবে দ্বিতীয় দফা ইউরিয়া প্রয়োগ করে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। কাঁইচ থোড় আসার ৫-৭ দিন পূর্বে, পুরোপুরি ভেজা মাটিতে বা সামান্য দাড়ানো পানিতে ইউরিয়া ৩য় বার ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হয়।
৪। শাক সব্জী চাষের বেলায় ফসলের বৃদ্ধির পর্যায়ের সংগে সমম্বয় করে ইউরিয়া ২-৩ ভাগে ভাগ করে প্রযোগ করা যায়। স্বল্প মেয়াদি ফসলের ক্ষেত্রে ইউরিয়া সারের পুরোমাত্রা শেষ চাষের সময়েই প্রয়োগ করা যায়।
৫। অধিকাংশ মশলার ক্ষেত্রে ইউরিয়া সার ২-৩ ভাগে ভাগ করে প্রয়োগ করুন।
৬। ভেজা মাটি অথবা জো আসা মাটিতে পড়ন্ত বিকেলে ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ করে উত্তমরুপে মিশিয়ে দিলে সর্বাধিক সুফল পাওয়া যায়। তবে তা ধানের শীষ বের হওয়ার পূর্বেই করতে হয়।
৭। ফসফেট সার জমি তৈরির সময় শেষ চাষের ২/১ দিন পূর্বে প্রয়োগ করা উচিত এবং দস্তা সারও শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে।
৮। জমি তৈরির শেষ চাষে পটাশ ও গন্ধক জাতীয় সার গুলো একবারে প্রয়োগ করা চলে। তবে, মোটা বুনটযুক্ত মাটিতে পটাশ সার দুভাগে ভাগ করে ব্যবহার করা যায় প্রথম ভাগ, জমি তৈরির শেষ সময় এবং দ্বিতীয় ভাগ দ্রুত কুশি বের হওয়ার সময় করতে হবে।
৯। তামাক ও রসুন ফসলে KCL ( MoP) এর পরিবর্তে K2So4 ব্যবহার করতে হবে।
১০। সালফার এবং জিংক সারের সুপারিশকৃত মাত্রা শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করা না হলে প্রয়োজন বোধে এ গুলি উপরি প্রয়োগ করে ব্যবহার করা যেতে পারে। সময়মত ইউরিয়া প্রয়োগের পরেও পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করলে তা সালফারের ঘাটতি বলে ধরে নিতে হবে।
সারের সহজলভ্যতা ও অবশিষ্ট পুষ্টিঃ
ফসল উৎপাদনের জন্য মাটিতে প্রয়োগকৃত সার, মাটি- পানি- উদ্ভিদ প্রণালীতে, ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে। কোন কোন রাসায়নিক সারের, (যেমন ফসফরাস, গন্ধক এবং জিংক) এর উল্লেখযোগ্য পরিমানের অবশিষ্ট পুষ্টি প্রভাব মাটিতে থেকে যায় এবং প্রয়োগকৃত সারের খুব সামান্য অংশ-ই এক মৌসুমে ফসল গ্রহণ করতে পারে। তাই এসব ক্ষেত্রে, প্রতি ফসলে পূর্ণ মাত্রায় এসকল সারের প্রয়োগ সাশ্রয়ী হবে না।
এই সব বিবেচনা এবং মাটির বৈশিষ্ট্যের তারতম্যের প্রেক্ষিতে শস্য বিন্যাস ভিত্তিক সার সুপারিশে নিম্ন বর্ণিত বিষয় সমূহ বিবেচনা করতে হবেঃ
১। নাইট্রোজেনের উৎস হিসেবে ইউরিয়া মাটিতে অত্যন্ত ক্ষনস্থায়ী এবং মৌসুম শেষে মাটিতে তা একবারেই অবশিষ্ট থাকে না বা সামান্যই অবশিষ্ট থাকে। কাজেই উপাদানটি প্রতি ফসলের চাহিদা মাফিক গাছের আংগিক বৃদ্ধির ধাপে ধাপে ভাগ করে প্রয়োগ করতে হয়। সবুজ সার প্রয়োগের পর ( হেক্টর প্রতি ১২-১৫ টন সবুজ ধৈঞ্চা) ধান ফসলে নাইট্রোজেন সারের মাত্রা ২৫-৩০ কেজি/ হেক্টর কমানো যায়। শুঁটী জাতীয় দানা ফসলের পর যদি ফসলের পরিত্যক্ত অংশ মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়, তাহলে নাইট্রেজেন সারের প্রয়োগ মাত্রা ৮-১০ কেজি/ হেঃ কমানো যায়।
২। মাটির অম্লমান বা পিএইচ কম বা বেশি উভয় ক্ষেত্রেই ফসফরাসের সহজলভ্যতা কম। সাধারণত ফসফরাসের লভ্যতার হার খুব কম ( ১৫-২০ %) এবং ফসফরাস সারের অবশিষ্ট পুষ্টি যথেষ্ট পরিমান মাটিতে থেকে যায়। এমতাবস্থায় ফসল বিন্যাসের ২য় ও ৩য় ফসলের জন্য ফসফরাসের প্রয়োগ মাত্রা নিম্নরূপঃ
ফসল বিন্যাসের ২য় ও ৩য় ফসলের ব্যবহারের জন্য সারের সুপারিশকৃত মাত্রার শতকরা অংশ
মৃদু অমস্ন থেকে মৃদু ক্ষার মাটির জন্য (%) অধিক অমস্ন এবং চুনযুক্ত মাটির জন্য (%)
ধান (উন্নত জাত) ধান (স্থানীয় উন্নত) , পাট ৫০-৬০ ৬০-৭০
গ্রীষ্মকালীন শাক- সব্জী ৬০-৭০ ১০০
৩। সাধারণত হালকা বুনটযুক্ত এবং পিডমন্ড মাটির পটাশ সরবরাহ ক্ষমতা কম। আবার, ধান, কন্দাল ফসল, পাট, আখ, বিভিন্ন ফল, সব্জী এবং মশলা জাতীয় ফসলে পটাশের চাহিদা বেশি। অন্যদিকে ফসলের অবশিষ্টাংশ জমিতে না রাখায় নিবিড় চাষ এলাকায় পটাশের ঘাটতি বেশি হয়। গোলআলু, ভুট্টা, তামাক, আখ, সব্জী ও মশলা ফসলে উচ্চ মাত্রায় পটাশ সার প্রোয়োগ করায় পরবর্তী ফসলের মাত্রায় তা ৩০-৪০% কমানো যায়। হেক্টর প্রতি ২-৪ টন ফসলের অবশিষ্টাংশ / ধানের খড় যথাযথভাবে মাটিতে ব্যবহার করা হলে পরবর্তী ফসলের মাত্রায় ২০-৪০% পটাশ কমানো যায়। যেহেতু খরিফ মৌসুমে সুপারিশকৃত মাত্রার চেয়ে তা ১০-১৫% কমানো যায়।
৪। শুষ্ক চাষাবাদে গন্ধকের সহজলভ্যতা কাদাময় ধান চাষের তুলনায় বেশী এবং যথেষ্ট অবশিষ্ট পুষ্টি মাটিতে থেকে যায়। কাদাময় চাষের ফসলে পূর্ণমাত্রায় সালফার প্রয়োগ করতে হবে। খরিফ-২ মৌসুমে কাদাময় ফসলের পর তৈল জাতীয় ফসল ,ভুট্টা, সব্জী ও মশলা ব্যতীত অন্যান্য শুস্ক চাষের ফসলের বেলায় সুপারিশকৃত মাত্রার ৫০% প্রয়োগ করতে হবে। তৈল জাতীয় ফসল, ভুট্টা, সব্জী এবং মশলা ফসলের বেলায় পূর্ণ মাত্রায় সালফার প্রয়োগের সুপারিশ করা হয়।
৫। দস্তার প্রাপ্যতা চুনাময় এবং কাদাময় মাটিতে কম। চুনাময় মাটিতে ( এইজেড, ১০,১১,১২ ও ১৩) রবি ও খরিফ উভয় মৌসুমে দস্তা প্রয়োগ করতে হবে। ২ অথবা ৩টি ধান- ধান ফসল বিন্যাসের ১ম ফসলে পূর্ণ মাত্রায় এবং ২য় ও ৩য় ফসলে ৫০% মাত্রায় দস্তা প্রয়োগ করতে হবে। ভুট্টা, আলু, শাকসব্জী এবং মশলা ব্যতীত ধান- ধান ছাড়া অন্য ফসলের শস্য বিন্যাসের বেলায় শুধুমাত্র ধান ফসলেই দস্তা প্রয়োগ করতে হবে। ভুট্টা, আলু, সব্জী এবং মশলা ফসলে পূর্ণ মাত্রায় দস্তা প্রয়োগ করতে হবে।
৬। শস্য বিন্যাসের রবি মৌসুমে কোন জমি পতিত থাকলে খরিফ-১ মৌসুমে ফসলের সুপারিশকৃত সারের পুরো মাত্রা প্রয়োগ করতে হবে।
৭। সবুজ সার/ শুটী জাতীয় দানা ফসল ব্যতিত মাঠ ফসলে জৈব উৎসের পুষ্টির যথাঃ গোবর, খামারজাত সার, মুরগির বিষ্ঠা, কম্পোষ্ট ইত্যাদি প্রয়োগ করলে রাসায়নিক সারের সুপারিশ মাত্রার কিছু পরিমাণ সার কমানো যায়।
৮। শীম জাতীয় ফসলে জীবানু সার ব্যবহার করলে নাইট্রেজেন সার প্রয়োগের প্রয়োজন নাই।
৯। বোরো ধানের জমিতে যদি পুরো দুই স্তরে এ্যাজোলা মিশানো হয় তবে ২৫-৩০ % নাইট্রেজেন সার কমানো যায়।
১০। বৃষ্টি নির্ভর ফসলের জন্য সেচ নির্ভর ফসলের সুপারিশকৃত মাত্রার চেয়ে ২৫-৩০% পুষ্টি উপাদানের (N P K S ইত্যাদি) পরিমাণ কমানো যেতে পারে।