সেখ জিয়াউর রহমান, রংপুর প্রতিনিধি : মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন পূরণে কৃষি ও সমাজ উন্নয়নে এক পথিকৃৎ মর্জিনা বেগম। বাড়ি রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের চুহড় গ্রামে। বিবাহ হয় ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে। স্বামী মো. হামিদুর রহমান সেই সময়ে স্বল্প বেতনভূক্ত একজন সরকারি চাকরিজীবি হিসেবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্ব পালন করেন। বিবাহিত জীবনে যৌথ পরিবারে বসবাস করা অবস্থায় তাদের সংসারের অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে আসতে থাকে। এমতাবস্থায় সংসারের অভাব অনাটন দেখা দেয়। মর্জিনা বেগম বেশ বুদ্ধিমতি নারী। তিনি সংসারের খরচের টাকা জমিয়ে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে নিজ এলাকায় ৪ একর জমি বন্ধক নিয়ে সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন ও পরিবেশ বান্ধব ফসল উৎপাদনের কাজ শুরু করেন। সেইসাথে সমাজ উন্নয়ন কাজসহ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর এসব কার্যক্রম প্রতি বছরই প্রসার লাভ করে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য এনে এর গতি আরও বেগবান হয়। মর্জিনা বেগমের ৫ সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে মো. মাসুদুর রহমান ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভর্সিটি থেকে বিবিএ পাস করেছে, পরেরজন মো. মশিউর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স এ ফাস্টক্লাস পেয়েছে, তৃতীয ছেলে মো. হাসিবুল হাসান রংপুর’র বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ম সেমিস্টারে অধ্যয়নরত, চতুর্থ ছেলে মো. মিনহাজুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায়, এবং সর্বকনিষ্ঠ ছেলে মো. মেহেদী হাসান এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের অপেক্ষায়। ছেলেদের লেখাপড়া এবং স্বামীর অসুস্থতার ব্যয়ভার গ্রহণে প্রচুর অর্থ খরচ হচ্ছে। এতেও মর্জিনা বেগম থেমে নেই। তার প্রচেষ্টায় আর্থসামাজিক উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে পায়রাবন্দ এলাকার অনেক নারী ও পুরুষের জীবন। তিনি পরিবেশ বান্ধব শাকসবজি ও অন্যান্য ফসল উৎপাদন, সমাজ উন্নয়নসহ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কার্যক্রম আরো বেগবান করছেন। এলাকায় গিয়ে এসব কাজের প্রমাণও পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রথমে তাঁর স্বামীর সহায়তা নিয়ে এলাকায় ভার্মিকম্পোস্ট খামার স্থাপন করে পরিবেশ বান্ধব ফসল উৎপাদনে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন। এসব কাজে স্বামী এবং ছেলেরা তাঁকে সহযোগিতা করছেন। এছাড়াও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও প্রযুক্তিগত পরামর্শ দিয়ে আসছেন। বর্তমানে পায়রাবন্দ এলাকায় বহু নারী ও পুরুষ তাঁর পরামর্শ ও অভিজ্ঞতা নিয়ে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ জন্য মর্জিনা বেগমকে পায়রাবন্দ এলাকার নারী উন্ন্য়নের ‘রোল মডেল’ বলা হয়। তিনি অত্যন্ত পরিশ্রমী নারী। অনেক নারী পুরুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করছেন তিনি। এতে এলাকায় উন্নয়নের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। মর্জিনা এ বছর ডিএই’র সহায়তায় ৫০ শতাংশ জমিতে রাজস্ব খাতের ভুট্টা প্রদর্শনী এবং নিজের আরো ৫০ শতক জমিতে পরিবেশ বান্ধব ভুট্টা চাষ করে উত্তরাঞ্চলে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। ভুট্টার জাত হলো সুপার-৭০২। ইতিমধ্যেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মো. মনজুরুল হান্নান, রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ মো. শাহ আলম, রংপুরের উপপরিচালক কৃষিবিদ স.ম. আশরাফ আলী, আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার মো. আবু সায়েম, উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. খোরশেদ আলমসহ অন্যান্য উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা ভুট্টাক্ষেত সরেজমিনে পরিদর্শন করে অভির্ভূত হন এবং মর্জিনা বেগমকে কৃষি ও দেশ উন্নয়নে অধিক পরিশ্রমি নারীচাষি খেতব দিয়ে তাঁর কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এরপর ভুট্টার মাঠদিবস অনুষ্ঠানে মহাপরিচালক বলেন, ভুট্টাক্ষেত খুবই ভালো হওয়ার কারণে ফলন ১০-১২ মে.টন হতে পারে । মর্জিনা বেগমের ভুট্টাক্ষেত দেখার জন্য তিনি উপস্থিত সকল চাষিদের আহ্বান জানান। মর্জিনা বেগম বর্তমানে তাঁর কর্মপরিধি বাড়ানোর জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন এবং প্রতি বৎসরই তার কাজের সম্প্রসারণ হচ্ছে। নারীজাতি যে পুরুষের কোনো অংশে কম নন তা তিনি প্রমাণ করেছেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য চাষি তাঁর চাষকৃত ভুট্টাক্ষেত, বাংলামতি ধানক্ষেত, আলুক্ষেত, ভার্মিকম্পোস্টসহ অন্যান্য কার্যক্রমগুলো সরেজমিনে দেখে অভিজ্ঞতা নিয়ে যাচ্ছেন। মর্জিনা বেগমের অনুকরণীয় কার্যক্রম আরো সম্প্রসারিত হলে দেশে ভবিষ্যত উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। উপজেলা কৃষি অফিসার বলেন, মর্জিনা বেগম কৃষিতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এবং তিনি কৃষি প্রযুক্তি গ্রহণ করে চাষাবাদের মাধ্যমে সফল নারীকৃষকে ভূষিত হয়েছেন। পায়রাবন্দ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. ফয়জার রহমান খাঁন জানান, মর্জিনা বেগম পায়রাবন্দ এলাকায় কৃষিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। সত্যিই তাঁর জমির ফসল দেখার মতো।
মর্জিনা বেগম জানান, আমার কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করে এলাকার অনেক নারী ও পুরুষ কর্মসংস্থানের পথ খুঁজে পেয়েছে। অসাধ্য বলতে কিছু নেই। এলাকায় উন্নয়ন হচ্ছে। অনেকের মুখে মুখে হাসি । এটাই আমার বড় আনন্দ।