বাংলাদেশে উৎপাদিত অর্থকরী ফসলগুলোর মধ্যে পাটের স্থান শীর্ষে। পাটের ব্যবহারিক উপযোগিতা, অর্থনৈতিক গুরুত্ব ইত্যাদি বিবেচনা করে পাটকে সোনালি আঁশ বলে অভিহিত করা হয়। এক সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পাট রফতানি হতো, অর্জিত হতো মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা।
বর্তমান সরকার দেশের পরিবেশ বিপর্যয় ও জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে পরিবেশবান্ধব পাট ও পাটজাত দ্রব্য ব্যবহারে দেশবাসীকে উৎসাহিত করায় পরিবেশ দূষণ অনেকাংশে লাঘব হয়েছে। এ দেশে মূলত তোষা এবং দেশি এ দুই ধরনের পাট চাষ করা হয়ে থাকে। আট থেকে দশ মিলিয়ন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাট ও এ জাতীয় আঁশ ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
এছাড়াও হাজার হাজার লোক পাট গবেষণা, প্রক্রিয়াকরণ, পাটপণ্য উৎপাদন, পরিবহন ও ব্যবসার সাথে জড়িত। দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৫-৬% আসে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে।
বাংলাদেশে ৯০ দশকে ১২ লাখ হেক্টর জমিতে পাট হতো। মাঝে প্রায় ৩০-৪০ বছর পাটের এলাকা কমতে কমতে ৪.০-৪.৫ লাখ হেক্টরে নেমে যায়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে প্রাকৃতিক আঁশের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধির সাথে সাথে গত ২০১০-১৫ সাল পর্যন্ত এর বৃদ্ধি প্রায় ৭-৮ লাখ হেক্টরে পৌঁছে গেছে। শুধু তাই নয় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে পূর্বের ১২ লাখ হেক্টর এলাকা থেকে যে পরিমাণ পাট পাওয়া যেত এখন ৭-৮ লাখ হেক্টর জমি থেকেই তার চেয়ে বেশি ফলন পাওয়া যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, তখন ১২ লাখ হেক্টর থেকে প্রায় ৬৫-৭০ লাখ বেল পাট পাওয়া যেতো আর সম্প্রতিকালে মাত্র ৭-৮ লাখ হেক্টর জমি থেকে পাওয়া যাচ্ছে প্রায় ৮২ লাখ বেল।
পাটের পঁচন বা রেটিং পাট উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পাট আঁশের গুণাগুণ পাট পঁচনের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের সর্বত্র পাট পঁচন ব্যবস্থা ও সমস্যা এক রকম নয়। পাট পঁচন পানির প্রাপ্যতা ও অন্যান্য আনুসঙ্গিক ব্যবস্থা/সুযোগ-সুবিধার ওপর ভিত্তি করে এলাকাভিত্তিক পাট পঁচন ব্যবস্থারও তারতম্য হয়। অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ববাজারে পাটের মূল্য এর মানের ওপর নির্ভর করে।
মান বিবেচনায় বিশ্ববাজারে সমাদৃত বাংলাদেশের পাট এক সময় সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু নানাবিধ কারণে ক্রমাগত পাট আঁশের মান খারাপ হয়ে যাওয়ার ফলে বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, পাট আঁশের মান নিম্ন হওয়ার কারণে কৃষকরাও এর আশানুরূপ মূল্য পাচ্ছেন না। যেহেতু জমির শস্যপর্যায়িক চাহিদা, কৃষকদের আর্থসামাজিক অবস্থা ও নানাবিধ প্রয়োজনে বাংলাদেশে পাট চাষ অব্যাহত থাকবে, তাই কৃষক ও দেশের সার্বিক স্বার্থেই উন্নত পাট পঁচন প্রযুক্তির মাধ্যমে উন্নত মানের আঁশ উৎপাদন করে কৃষক তথা দেশের আয় ও সুনাম বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন।
বাংলাদেশে সাধারণত দুইভাবে পাট পঁচানো হয়। প্রচুর পানি অঞ্চল ও স্বল্প পানি অঞ্চলে পাট পঁচানো। প্রচুর পানি অঞ্চলে প্রচলিত পদ্ধতিতে পাট পঁচানো সম্ভব। কিন্তু যেখানে পানির স্বল্পতা আছে সেসব অঞ্চলে রিবন রেটিং বা পাটের ছালকরণ ও পচন পদ্ধতির মাধ্যমে পাট পচাতে হয়। পদ্ধতিগুলোর বিবরন নিম্নে দেয়া হলো।
ক. প্রচলিত পাট পঁচন ব্যবস্থাপনা
পাট গাছে যখন ফুলের কুঁড়ি আসে তার অগেই পাট কাটা উচিত। এ সময় পাট কাটলে আঁশের মান ও ফলন ভালো হয়, গোড়ায় তেমন কাটিংস বা শক্ত অংশ থাকে না। তবে আমাদের দেশের পাটের জাতগুলো মোটামুটি ১১০-১২০ দিন বয়সে কাটতে হবে। যেহেতু চিকন পাট পচতে সময় কম এবং মোটা পাট পচতে সময় বেশি লাগে, তাই চিকন ও মোটা পাট আলাদা ভাবে আঁটি বেঁধে আলাদাভাবে জাগ দিতে হবে। পাটের জমি শুকনো থাকলে জমিতেই অথবা জমিতে সামান্য পানি থাকলে পাট কেটে আঁটিগুলো নিকটস্থ শুকনো জায়গায় সম্ভব মতো ৩-৪ দিন স্তূপ করে রেখে পাতা ঝরাতে হবে এবং এরপর পাটের গোড়ার দেড় ফুট পরিমাণ অংশ ৩-৪ দিন পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। এতে পাতা পঁচে পঁচন পানি তাড়াতাড়ি নষ্ট হয় না এবং গোড়ায় কাটিংসের পরিমাণ কম হয়। তবে পাটের জমিতে প্রচুর পানি থাকলে পাটের পাতা ঝরানো বা গোড়া ডুবানোর প্রয়োজন নেই। সে ক্ষেত্রে পাট কেটে সরাসরি জমিতেই জাগ দিতে হবে। যথাসম্ভব পরিষ্কার এবং অল্প স্রোতযুক্ত পানিতে পাট পচানো উচিত।
পাটের আঁটিগুলো প্রথম সারিতে লম্বালম্বিভাবে, দ্বিতীয় সারিতে আড়াআড়িভাবে এবং পুনরায় লম্বালম্বিভাবে সাজাতে হবে। এতে জাগের মধ্যে পাট পচন জীবাণু সহজে চলাফেরা করতে পারে এবং পচন তাড়াতাড়ি সম্পন্ন হয়। পাটের জাগে সামান্য পরিমাণ ইউরিয়া সারগুলো পানিতে ছিটিয়ে দিলে পচন প্রক্রিয়া তাড়াতাড়ি হয়। জাগ ডুবানো/ঢাকার জন্য জলজ উদ্ভিদ, কংক্রিটের স্ল্যাব বা বাঁশ ব্যবহার করা উচিত। এ ক্ষেত্রে কখনও মাটি বা কলাগাছ ব্যবহার করা যাবে না। পচন সমাপ্তি নির্নয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাজেই জাগ দেয়ার ১০-১২ দিন পর থেকে ২-১টা পচা পাট গাছ বের করে ধুয়ে দেখতে হবে যে, আঁশগুলো পচে পরস্পর পৃথক হয়েছে কিনা। পৃথক হলে বুঝতে হবে, পঁচন শেষ হয়েছে এবং সাথে সাথে সব পাটের আঁশ ছাড়িয়ে ফেলতে হবে। পাট একটু বেশি পঁচানোর চেয়ে একটু কম পচানো ভালো।
আঁশ ছাড়ানোর পূর্বে পাটের গোড়ার অংশ হাত দিয়ে চিপে টেনে ফেলে দিয়ে বা বাঁশ-কাঠের হাতুড়ি দিয়ে থেতলে নিয়ে আঁশ ছাড়ালে আঁশের গোড়ায় শক্ত অংশ বা কাটিংসের পরিমাণ কম হয়। যথাসম্ভব পরিষ্কার পানিতে আঁশ ধোয়া উচিত। আঁশ মাটিতে না শুকিয়ে বাঁশের আড়ায় বা ঘরের চালে বা গাছের ডালে বা ব্রিজের রেলিংয়ে বিছিয়ে দিয়ে ভালোভাবে শুকানো উচিত। লক্ষ্য রাখতে হবে আঁশে যেন ময়লা বা ধুলাবালি লেগে না থাকে। এভাবে পচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে পাট আঁশ ভালোভাবে শুকিয়ে গুদামজাত করা হয়। ভিজা আঁশ কখনও গুদামজাত করা উচিত নয়। কারণ এতে আঁশের মান নষ্ট হয়ে যায়।
খ. স্বল্প পানি অঞ্চলে পাট পচন ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশের অনেক অঞ্চেলে অনেক পাট জন্মে, কিন্তু পাট পঁচনের প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত পানির অভাবে ওইসব এলাকায় উৎপাদিত পাট আঁশের অধিকাংশই অত্যন্ত নিম্নমানের হয়। আমরা জানি যে, আঁশের গুণাগুণের ওপর পাটের মূল্য নির্ভর করে। কি কারণে পাট আঁশের গুণাগুণ খারাপ হয়, এ ব্যাপারে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
দেখা গেছে, বিশেষ করে পাট পচন পদ্ধতির তারতম্যের কারণেই পাট আঁশের গুণাগুণের তারতম্য হয়। যেহেতু পাট পচন প্রক্রিয়া পানিতে সম্পন্ন হয়, তাই পাট পচন ও আঁশের গুণাগুণ মূলত পচন পানির ওপর নির্ভরশীল। দেশের বিভিন্ন পাট উৎপাদনকারী এলাকার পাট পচন সমস্যা বিভিন্ন। তাই সেসব এলাকায় প্রচুর পাট উৎপন্ন হয়, অথচ প্রয়োজনীয় পচন পানির অভাবে চাষি ভাইয়েরা পাট সঠিকভাবে পচাতে পারছেন না, ফলে উৎপাদিত আঁশের মান অত্যন্ত নিম্নমানের হচ্ছে- সেসব এলাকার পাট পচন সমস্যার সমাধানকল্পে দীর্ঘদিন গবেষণার পর বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে ওইসব এলাকার চাষি ভাইদের জন্য বাঁশের হুকের সাহায্যে ‘পাটের ছালকরণ (রিবনিং) ও ছাল পচন (রিবন রেটিং) পদ্ধতি’ উদ্ভাবন করেছে।
বিজেআরআই এ পাটের রিবনিং করার জন্য পরবর্তীকালে ১. ‘সিংগেল রোলার’, ২. ‘ডাবল রোলার রিবনার’ যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়েছে। কারিগরি দিক বিবেচনায় রিবনিংয়ের জন্য ‘ডাবল রোলার রিবনার’ অত্যন্ত সুবিধাজনক বলে প্রমাণিত হয়েছে।
এ পদ্ধতিতে পুরো পাট গাছ না পচিয়ে কাঁচা গাছ থেকে ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে ছাল পচাতে হয়, ফলে পচানোর জন্য পানি কম লাগে, পচনের জায়গা ও সময় কম লাগে, বহন খরচ কম লাগে, আঁশে কোনো কাটিংস থাকে না এবং আঁশের মান অত্যন্ত ভালো হয়, ফলে আঁশের মূল্য বেশি পাওয়া যায়।
বাঁশের হুকের সাহায্যে ছাল ছাড়ানোর পদ্ধতি
প্রথমে ৫ ফুট বা প্রায় ১৫২ সেমি. লম্বা এক খণ্ড বোরাক বাঁশ নিয়ে একপ্রান্ত আড়াআড়িভাবে কাটতে হবে, যাতে বাঁশের প্রান্তটির দুইদিক ইংরেজি ইউ অক্ষরের মতো দেখায়। এটাকে বাঁশের হুক বলা হয়। এবার বাঁশ খ-টির অপর প্রান্ত আনুমানিক ১ হতে ১.৫ ফুট সুবিধা অনুযায়ী মাটির মধ্যে শক্ত করে পুঁতে দিতে হবে। পাশাপাশি ৩-৪ ফুট দূরে দূরে প্রয়োজনমতো এমন কয়েকটি বাঁশের হুক সারিবদ্ধভাবে মাটিতে বসাতে হবে। এখন ওই বাঁশের হুকগুলোর সঙ্গে একটি মুরুলি বাঁশ দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে আড়া বাঁধতে হবে যার ওপর পাট গাছ দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে। পাট গাছগুলো আড়ার ওপর দাঁড় করানোর পূর্র্বে যথা সম্ভব গাছের পাতা হাত দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে গাছির গোড়ার ৩-৪ ইঞ্চি (৮-১০ সেমি.) একটি শক্ত কাঠের/বাঁশের হাতুড়ি দিয়ে থেঁতলে নিতে হবে। এবার গাছের থেঁতলানো গোড়া বাঁশের হুকের মধ্যে রেখে ছালগুলোকে হাত দিয়ে হুকের দুইদিকে দুই ভাগ করে দুই হাতে নিজের দিকে সজোরে টান দিতে হবে। দেখা যাবে পাটের ছালগুলো সহজেই পাট খড়ি হতে আলাদা হয়ে গেছে এবং পাট খড়িগুলো সামনের দিকে চলে গেছে। এভাবে ৪-৫টি পাট গাছের ছাল একসঙ্গে বের করা সম্ভব। প্রাথমিকভাবে বোরাক বাঁশের যে কোনো প্রান্ত ধারালো দায়ের সাহায্যে কোনাকোনিভাবে কেটে বাঁশের হুক তৈরি করে পাট ছাল পৃথককরণ করা হলে এ ছালগুলোকে স্বল্প পানিতে বা পৃথক করা বাকলগুলাকে দুইভাবে পঁচানো যায়-
১. বড় মাটির চারিতে বাকল জাগ গোলাকার মোড়া বেঁধে সাজিয়ে রেখে পরিষ্কার পানি দিয়ে চারিটি ভরে দিতে হয়। একটি বড় চারিতে প্রায় ৩০ কেজি ছাল বা বাকল পচনো যায়।
২. যদি আশপাশে ছোট ডোবা বা পুকুর বা খাল কম গভীরতা সম্পন্ন জলাশয় থাকে তবে ছালগুলো গোলাকার মোড়া বেঁধে একটি লম্বা বাঁশের সাথে ঝুলিয়ে পানির মধ্যে ডুবিয়ে পচানো যায়। এভাবে অল্প পানিতে খুব কম সময়ে পঁচন প্রক্রিয়াসম্পন্ন হয়। পঁচন সময় কমানের জন্য ১০০০ কেজি কাঁচা ছালে জন্য ১ সের বা প্রায় ১ কেজি ইউরিয়া সার পচন পানিতে মিশিয়ে দিয়ে অথবা একটি ছোট বালতি বা হাঁড়িতে দুই একটি পাট গাছ ছোট ছোট টুকরা করে আগেই পচিয়ে নিয়ে পরে ছাল পচানোর সময় ওই পানি মিশিয়ে দিতে হয়। বাঁশের হুকের পরিবর্তে সিংগেল-ডাবল রোলার রিবনারের সাহায্যে একই ভাবে পাটের রিবনিং করা যায়। পরে ছালগুলোকে পরিমাণ সাইজের গোলাকার মোড়া বাঁধতে হবে এবং পাট খড়িগুলো শুকিয়ে নিতে হবে। তবে ‘ডাবল রোলার রিবনারের’ সাহায্যে ছাল ছাড়ানো বেশি সুবিধাজনক।
দেশি পাটের বয়স ১০৫-১১০ দিন হলে পাট কাটতে হবে। তোষা পাটের বয়স ১০০-১০৫ দিন হলে পাট কাটতে হবে। পাট কাটার পরে পাতা ঝরায়ে পাট গাছের গোড়ার অংশে ৩-৪ ইঞ্চি পরিমাণ একটি কাঠ-বাঁশের হাতুড়ি বা মুগুর দিয়ে থেঁতলিয়ে নিতে হবে। থেঁতলানো কয়েকটি গাছ (৪-৫টি) রিবনারের ২ রোলারে মাঝখানে রেখে থেঁতলানো ছালগুলোকে ২ ভাগ করে রোলারেরর সামনের দিকে থেকে বাকিয়ে নিয়ে পেছনের দিক থেকে টান দিতে হবে। এত পাট কাঠি সামনের দিকে চলে যাবে এবং পাট গাছের ছালগুলো হাতে থেকে যাবে। ছালগুলোকে একত্রিত করে বান্ডিল/মোড়া বাঁধতে হবে যেন পাট ধোয়ার সময় সহজে খোলা যায়। বান্ডিল/মোড়াগুলোকে একত্রিত করে পূর্বে তৈরিকৃত গর্ত বা মাটির চাড়িতে জাগ দিতে হবে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের রিবন পদ্ধতির গবেষণাপ্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ১ একরে উৎপাদিত পাটের রিবন পচাতে ১৬,০০০ গ্যালনের মতো পানি প্রয়োজন হয়।
পাট ছালের মোড়া ভিজানোর জন্য গর্ত তৈরির পদ্ধতি
প্রতি বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে উৎপাদিত পাট ছালের পরিমাণ প্রায় ৩০০০-৩৫০০ কেজি। প্রতি বিঘা জমিতে উৎপাদিত পাটের ছাল পচানোর জন্য ৬ মি.২মি.১মি.-দৈর্ঘ্য প্রস্থ উচ্চতা মাপের ১টি গর্ত করতে হবে। গর্তটির নিচে ও চারিপাশে ১টি পলিথিন কাগজ বিছিয়ে দিতে হবে, যেন পানি চলে না য়ায়। এ গর্তটিতে খাল বা বিলের ৮০০০-৮৫০০ লিটার পানি দিয়ে ভরে দিতে হবে। পাট ছালে বান্ডিল-মোড়াগুলো গর্তের পানিতে ডুবিয়ে জাগ দিতে হবে। কচুরিপানা বা খড় বা চট দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিতে হবে, যেন রৌদ্র ছালগুলো শুকিয়ে না যায়। প্রতি বিঘার পাট ছালের (৩০০০-৩৫০০ কেজি) জন্য ৩০০-৩৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার পানিতে মিশিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে কিছু বাছ পাট নিয়ে মাটির চাড়ি বা গামলায় পানিতে পচিয়ে, সেই পচা পানি তৈরি করা গর্তে দেয়া যেতে পারে। জাগ সম্পন্ন হলে আঁশগুলো পরিষ্কার পানিতে বা মাটির চাড়িতে ধুয়ে বাঁশের আড়ায় ভালোভাবে শুকিয়ে গুদামজাত করতে হবে। প্রতি কেজি ছালের জন্য ২.৫০-৩.৩০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনে অতিরিক্ত পানি দেয়া যেতে পারে।
এ প্রযুক্তি শুধুমাত্র যে এলাকায় পাট পচনের পানির অভাব রয়েছে সেই এলাকার জন্য প্রযোজ্য। পানির অভাবজনিত কারণে পাট পচনের জন্য বহু দূরে পাট গাছ বহনের চেয়ে জমির আইলের পাশে গর্ত করে এ পদ্ধতিতে পাট পচানো লাভজনক। পাট কাটার সঙ্গে সঙ্গে ‘ছালকরণ’ করতে হবে। রৌদ্রে পাট গাছ শুকিয়ে গেলে ‘ছালকরণ’ সমস্যা হবে। সম্ভব হলে মেঘলা বা বৃষ্টির দিনে এ কাজ করতে হবে। পাট কাটার ১২-১৫ দিন পূর্বে গর্ত করে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করা যেতে পারে। গর্তের চারপাশে মাটি দিয়ে উঁচু করতে হবে যাতে বাহিরের ময়লা পানি যেন গর্তে প্রবেশ না করে। অতি বৃষ্টিতে গর্তের পানি যাতে উপচে না যায় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
ছালকরণের জন্য পাট কাটার সময় : ছালকরণের জন্য সাধারণভাবে পাট জাগ দেয়ার কয়েক দিন পূর্বে পাট কাটতে হবে। এ পদ্ধতিতে দেশী পাটের বয়স ১০৫ থেকে ১১০ দিন এবং তোষা বা বগী পাটের বয়স ১০০ থেকে ১০৫ দিন হলেই পাট কাটতে হবে।
পচন সময় নির্ধারণ : মনে রাখতে হবে যে, ছাল পচতে খুব কম সময় লাগে। কাজেই ছাল পানিতে ডুবানোর ৭-৮ দিন পর থেকে পচন প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করা উচিত। এ উদ্দেশ্যে দু-একটা ছাল পানি থেকে তুলে ভালো করে ধুয়ে দেখা উচিত এবং পচন সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছালগুলো পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে আঁশ সংগ্রহ করতে হবে।
রিবন রেটিং পদ্ধিতির সুবিধা হলো: অল্প পানিতে অধিক পাট পচানো যায়; পাট পচানের জন্য পরিমিত পানির অভাব হলে এ পদ্ধতি সহজে ব্যবহার করা যায় ও পচানোর জন্য কম পানি লাগে; পচানোর জন্য জায়গা ও সময় কম লাগে; পাট পচানের জন্য পরিবহন খরচ কম লাগে; এ পচন পদ্ধতি স্বাস্থ্যকর ও পরিবেশেবান্ধব; কাটিংসমুক্ত উন্নতমানের আঁশ পাওয়া যায়; ভালো আঁশে বেশি মূল্য পাওয়া যায় ও পাটখড়িগুলো শক্ত থাকে, জ্বালানি হিসেবে বিভিন্ন কাজের ব্যবহারে সুবিধাজনক ও টেকসই হয়।
স্বল্প পানি অঞ্চলগুলো পাট পচন সমস্যা ও সমাধান
বাংলাদেশের শুষ্ক অঞ্চলগুলো বিশেষ করে বৃহত্তর যশোর, কুষ্টিয়া, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহের কিছু অংশে উন্নতমানের পাট গাছ উৎপন্ন হয় কিন্তু উৎপাদিত আঁশের মান খুবই খারাপ। সমীক্ষা ও বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পাট পচন পানির অপর্যাপ্ততা ও প্রয়োজনীয় পানির অভাবেই পাট-চাষি ভাইরা খাল/ডোবায়/পুকুরে অতি অল্প পানিতেই কাদা মাটি ঢাকা দিয়ে পাট পচনের কাজটি সমাধান করেন। ফলে স্বভাবতই উৎপাদিত আঁশের মান অতিনি¤œ মানের হয়। গবেষণার ফলাফলে প্রমাণিত হয়, সেসব এলাকায় অল্প পানিতে পাট পচানের কলাকৌশল উদ্ভাবন এবং স্থান বিশেষে পাট পচনের প্রয়োজনীয় পানি প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে উল্লিখিত এলাকার উৎপাদিত পাটের আঁশের মান উন্নত করা সম্ভব।
পাটের আঁশ থাকে পাট গাছের বাকলে বা ছালে। কাজেই পুরো পাট গাছ পাট কাঠিসহ না পচিয়ে কাঁচা অবস্থায় গাছের ছাল উঠিয়ে নিয়ে শুধুমাত্র ছাল পচালে পচন পানির প্রয়োজনীয়তা বহুলাংশে কমানো সম্ভব। পাটের ছাল পচালে শুধু যে কম পানিতে পাট পচানো সম্ভব তাই নয় বরং আরও অনেক বিশেষ সুবিধা রয়েছে, যেমন- কম পানিতে অনেক পাট পচানো যায়; কাটিংসবিহীন উন্নতমানের আঁশ উৎপাদিত হয়; গোটা পাট পচাতে যত সময়ের প্রয়োজন তার অর্ধেক সময়ে পাট পচানো সম্ভব হয়; পচন স্থানে নেয়ার জন্য পরিবহন খরচ কম লাগে। অল্প পরিমাণ স্থানে বেশি পাট পচানো সম্ভব; যেহেতু কাঁচা অবস্থায় পাট কাঠি আলাদা করা এবং এসব পাট কাঠি পচনকালে পানির সংস্পর্শে আসে না ফলে স্বভাবতই এ পাট কাঠি অপেক্ষাকৃত শক্ত থাকে। বাংলাদেশে পাট কাঠির ব্যবহারিক মূল্য অনেক।
বর্তমানে চাষি পর্যায়ে উৎপাদিত প্রায় ৩০-৪০ লাখ বেল (এক বেল= প্রায় ৫ মণ= ১৮০ কেজি) অতি নিম্নমানের ছাল ও অত্যাধিক কাটিংযুক্ত আঁশ বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন পাটকলে ও গুদামে অব্যবহৃত অবস্থায় মজুদ আছে। এসব আঁশের অভ্যন্তরীণ ও বিদেশের বাজারে কোনোই চাহিদা নেই এবং কলে ব্যবহার করাও সম্ভব নয়। এসব আঁশগুলোকে বিভিন্ন জীবাণু তাত্ত্বিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় মানোন্নয়ন করে কলকারখানায় ব্যবহার উপযোগী করে তোলার জন্য বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে বহুমুখী গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে এবং যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া গেছে।
লেখক: কৃষিবিদ ড. মো. মাহবুবুল ইসলাম। মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রধান, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম