পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যবসায়ী তোষনণীতিই দায়ী, অবিলম্বে বাজার মনিটরিং জোরদার ও টিসিবিকে কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন দেশের ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থসংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগ ও নগর কমিটি।
রোববার চট্টগ্রামে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নেতারা এসব কথা বলেন।
নেতারা বলেন, জরুরিভাবে ভারত ছাড়াও পার্শ্ববতী দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা, সংকট নিরসনে বর্তমান মজুতগুলির সুষ্ঠু বন্টন নিশ্চিত, আমদানিকারক ও খুচরা পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের যথাযথ মনিটরিং নিশ্চিত করা, সংকটকালীন সময়ে টিসিবিকে দ্রুত কার্যকর করা, নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্যের বাজার তদারিকতে মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ নিয়ে সৃষ্ট জঠিলতা নিরসন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বাজার মনিটরিং জোরদার করার জন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে তৎপর করতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
পবিত্র রমজান, ঈদ, পুজা পার্বণকে সামনে রেখে একশ্রেণির মৌসুমী ব্যবসায়ীর আবির্ভাব ঘটে, তারা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দামবৃদ্ধির অশুভ তৎপরতায় লিপ্ত হয়উল্লেখ করে নেতারা বলেন, আর নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যবসায়ীদের ওপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার কারণে সাধারণ জনগণের স্বার্থ বারবার ভুলন্টিত হচ্ছে।
ক্যাব নেতারা জানান, দেশে বর্তমানে পেঁয়াজের চাহিদা মেটাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পুরোপুরি ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করে, আর ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন তালবাহনায় পেঁয়াজের সরবরাহ সংকট তৈরি করে জনগণের পকেট কাটলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। বিশেষ করে ভারতে পেঁয়াজর মূল্য বৃদ্ধি হলে পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল, মায়ানমার ও পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ আমদানির কোনো উদ্যোগ না নিয়ে ব্যবসায়ীদের পকেট কাটার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এছাড়াও সংকটকালীন সময়ে পেঁয়াজ সংকট মোকাবেলায় টিসিবিকে কাজে না লাগিয়ে টিসিবিকে অর্থব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে রেখেছেন।
অন্যদিকে মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ও বাজার মনিটরিং এ অচলাবস্থা সৃষ্টির সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেপরোয়া হয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে আগুন দিচ্ছে।
বিবৃতিতে নেতারা বলেন, ব্যবসা বাণিজ্যে মূল উপসর্গ উৎপাদক, বিক্রেতা, শ্রমিক ও ভোক্তা। আর দেশে ব্যবসা বাণিজ্যের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হলে এ পক্ষগুলির স্বার্থ রক্ষা করা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করে যাবতীয় নীতি প্রণয়ণ করার কারণে অন্যপক্ষগুলির স্বার্থ উপেক্ষিত হয়। ফলে দেশে ন্যায্য ব্যবসার পরিবেশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। সেকারণে ব্যবসায়ীরা নীতি নৈতিকতা বাদ দিয়ে যে যেভাবে পারে মজুত করে সরবরাহ সংকট তৈরি করে ১০০-১৫০ শতাংশ পর্যন্ত লাভে পণ্য বিক্রি করছে।
ভারতে পেঁয়াজের দামবৃদ্ধির অযুহাত তুললে বর্তমানে মুজত পেঁয়াজগুলি ৩-৬ মাসে পূর্বে আমদানি করা এবং পর্যাপ্ত মজুত থাকা সত্বেও দামবাড়িয়ে জনগণের পকেট কাটলেও সরকার আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের যথাযথ নজরদারি করেনি। অন্যদিকে পাইকারী ব্যবসায়ীদের দেখানো পথ অনুসরণ করে খুচরা ব্যবসায়ীরাও বেপরোয়া ভাবে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। দেখার জন্য বাজারেও কেউ নেই।
এ অবস্থার জন্য সরকারের মাঠ পর্যায়ে নজরদারির দুর্বলতা দায়ী বলে উল্লেখ করে তারা বলেন, ১৭-১৮% পর্যন্ত চালের শুল্ক হ্রাস করে চাল আমাদানির পরেও চালের বাজারে তার প্রতিফলন ঘটেনি, পুরো টাকা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে, সেভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারও অস্থিরতা তৈরি করে পুরো টাকা হাতিয়ে নেবার পাঁয়তারা করছে একটি মহল।
বিবৃতিতে নেতারা আরো বলেন, ক্যাব দীর্ঘদিন ধরে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্যের বিকল্প বাজার হিসাবে টিসিবিকে কার্যকর করার জন্য দাবি করলেও ব্যবসায়ী নেতারা টিসিবিকে সক্রিয় করতে সরকারকে বিভ্রান্ত করে বাধা প্রদান করছে। তাদের যুক্তিহলো টিসিবি অথর্ব প্রতিষ্ঠান এবং লোকসানি। যার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজার পুরোটাই সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দখলে, ফলে বাজারে প্রতিযোগিতা তৈরির পরিবর্তে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজার পুরোটাই ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া দখলে রয়েছে।
নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ক্যাব বছরব্যাপী বাজার মনিটরিংয়ের দাবি করে আসলেও মোবাইল কোর্ট আইন’০৯ নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলার কারণে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা মোবাবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে না পারায় একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া হয়ে মজুতদারি, সিন্ডেকেট করে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজারে আগুন দিচ্ছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনের কোনো প্রকার নজরদারি ও হস্তক্ষেপ না থাকায়, বাজার নিয়ন্ত্রণহীন ও অস্থির হয়ে আছে। আর ব্যবসায়ীরা এটাকে স্বাবাভিক বললেও প্রকৃতপক্ষে মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের জনগোষ্ঠির জন্য এটা বাড়তি বোঝা যা সরকারের অনেকগুলি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে ম্লান করে দিচ্ছে।
বিবৃতিতে নেতারা আরো বলেন, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বার্ষিক ২০-২২ লাখ মে. টন আর দেশে উৎপাদিত হয় ১৭-১৮ লাখ মে. টন। তবে কোরবানির ঈদে চাহিদা একটু বাড়লেও সরবরাহ জঠিলতায় ও মজুতদারির কারণে দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের পকেট কাটে কিছু ব্যবসায়ী। আর দেশীয় কৃষকদের প্রণোদনা প্রদান করা সম্ভব হলে এবং ভোক্তা হিসাবে সচেতন হলেই এই সংকট সহজেই মোকাবেলা সম্ভব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গর্ভনর ড. আতিউর রহমান পেয়াঁজ, মসলা ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য স্বল্প সুদে কৃষিঋণ বিতরণের উদ্যোগ নিলেও ঋণগুলি প্রকৃত কৃষকের কাছে না পৌঁছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের নিজেদের চলতি ঋণগ্রহীতাদের মাঝে এসমস্ত তা বিতরণ করে। ফলে পেঁয়াজ ও মসলা উৎপাদান খাতে সরকারের প্রণোদনা গুলির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত না হওয়ায় কৃষকরা উপকৃত হয়নি। ফলে দেশীয় কৃষকের স্বার্থ রক্ষা হয়নি, দেশীয় উৎপাদকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যার খেসারত পুরো দেশবাসীকে দিতে হচ্ছে। তাই দেশীয় উৎপাদক ও কৃষক পর্যায়ে সরকারের প্রণোদনা ও ঋণের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়।
বিবৃতিতে যারা স্বাক্ষর করেছেন তারা হলেন-ক্যাব কেন্দ্রিয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন, সাধারণ সম্পাদক কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরী, মহানগর সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু, সহ-সভাপতি হাজি ইকবাল আলী আকবর ও সাধারণ সম্পাদক অজয় মিত্র শংকু, যুগ্ম সম্পাদক এএম তৌহিদুল ইসলাম, দক্ষিণ জেলা সভাপতি আলহাজ আবদুল মান্নান, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শাহনেওয়াজ আলী মির্জা প্রমুখ।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম