শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর থেকে: পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও উত্তরের শষ্যভান্ডার ধানের জেলা দিনাজপুরে চাল নিয়ে চালবাজি শুরু করেছে একটি সিন্ডিকেট। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে থেকে আমদানি ও মজুত সত্ত্বেও এ জেলায় বেড়েই চলেছে চালের দাম। এনিয়ে বিপাকে পড়েছে,খেটে খাওয়া দিন মজুর ও মধ্য আয়ের মানুষ। অব্যাহতভাবে চালের দাম বাড়ায় মিল মালিকদের কারসাজি ও সিন্ডিকেটকেই দায়ী করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।
আর মিল মালিকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি ও আমদানি নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে চালের দাম। তবে চালের বাজারে অস্থিরতা কেউ সৃষ্টি করছে কিনা তা খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে প্রশাসন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দিনাজপুরের অধিকাংশ মিলগুলোতে পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে চাল। এর পরও গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৭ থেকে ৯ টাকা। এখন ৫০ কেজির প্রতি বস্তা চালের দাম ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা বাড়িয়েছে মিল মালিকরা।
দিনাজপুর বাহাদুর বাজারের খুচরা চাল ব্যবসায়ীরা জানান, মিলগুলোতে চাল পাওয়া গেলেও তারা ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করছেন মিল মালিকরা। তারা জানান, এক সপ্তাহ আগে ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল মিল মালিকরা বিক্রি করেছিল ২ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা। এখন তা বিক্রি করছে ২ হাজার ৭৫০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৫০ কেজি বস্তার বিআর-২৮ চাল ২ হাজার ৩৫০ টাকার স্থলে ২ হাজার ৬০০ টাকা, বিআর-২৯ চাল ২ হাজার ৩০০ টাকার স্থলে ২ হাজার ৫৫০ টাকা, স্বর্ণা ২ হাজার ১০০ টাকার স্থলে ২ হাজার ৩৫০ টাকা এবং হাইব্রিড মোটা ১ হাজার ৮০০ টাকার স্থলে ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করছে মিল মালিকরা।
চাল ব্যবসায়ী মনসুর আলী জানান, মিলে চাল নেই, এমন কথা বলছেন না কোনো মিল মালিকই। তবে সব মিল মালিকই একসাথে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ জন্য তাদের বাধ্য হয়েই বেশি দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে। আর এ চাল দাম নিয়ে ক্রেতাদের সাথে প্রায়ই বাক-বিতন্ডা হচ্ছে তাদের।
এদিকে পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও এই মুহূর্তে চালের দাম বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিক কারণ নেই বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। যেসব ধান ব্যবসায়ী এবার বোরো মৌসুমে ধান কিনে মিল মালিকদের কাছে সরবরাহ করেছেন, তারা জানান, বোরো মৌসুমে পর্যাপ্ত ধান কিনে মজুদ করেছে মিল মালিকরা।
দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ধান ব্যবসায়ী রেজাউল ইসলাম জানায়, তাদের কাছে বোরো মৌসুমে এবার ৭৫ কেজির প্রতিবস্তা মিনিকেট ধান ১ হাজার ৭০০ টাকা, বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ ধান ১ হাজার ৬০০ টাকা এবং হাইব্রিড মোটা ধান ১ হাজার ৫০০ টাকা দরে কিনেছে মিল মালিকরা। এই হিসাবে মিলের উৎপাদন খরচসহ প্রতিকেজি মিনিকেট চাল ৩৬ টাকা, বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ চাল ৩৩ টাকা এবং প্রতিকেজি হাইব্রিড মোটা চাল ৩০ থেকে ৩২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।কিন্তু বর্তমানে মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল ব্যবসায়ীদের বস্তার হিসাব অনুযায়ী প্রতিকেজি মিনিকেট চাল ৫৫ টাকা, বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ চাল ৫১ টাকা এবং হাইব্রিড মোটা চাল কিনতে হচ্ছে ৪৫ টাকা কেজি দরে। মিল মালিকরা তাদের বাজার থেকে ধান কেনা ও উৎপাদন খরচ ধরে বস্তার হিসাব অনুযায়ী প্রতিকেজি চাল গড়ে প্রায় ২০ টাকা বেশি দরে বিক্রি করায় বাজারে অস্বাভাবিকহারে বেড়েছে চালের দাম।
খুচরা আনিসুর রহমান জানান, তারা মিলগুলোতে চাল কিনতে গিয়ে ব্যাপক মজুদ লক্ষ করেছেন। তারা জানান, মিলগুলোতে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করলে চালের বাজার অনেকটাই স্বাভাবিক হতে পারে।
দেশে সাম্প্রতিক বন্যা, রোহিঙ্গা ইস্যু এবং ভারত চাল রফতানি করবে না এমন গুজবে অধিক মুনাফার আশায় ইচ্ছমতো চালের দাম বৃদ্ধি করেছে মিল মালিকরা মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এর প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে।
সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বৃদ্ধির অভিযোগ অস্বীকার করে দিনাজপুর জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সভাপতি মোসাদ্দেক হুসেন জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেই বেড়েছে চালের দাম। এক্ষেত্রে মিল মালিকদের কোনো কারসাজি নেই। মিলে মজুদ থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ মিল মালিকরা প্রতিবস্তা চালের দাম ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা বৃদ্ধি করল কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, আমদানি মূল্য বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে চালের দাম।তিনি বলেন, মিলে যে পরিমাণ ধান রয়েছে- তা স্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে। একটি মিল চালাতে যেটুকু ধানের প্রয়োজন, সেটুকু ধানই রয়েছে মিলগুলোতে।
পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ বাজারে চালের দাম বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক উল্লেখ করে দিনাজপুর জেলা প্রশাসক মীর খায়রুল আলম জানান, চালের দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে আগামীকাল রোববার দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে একটি জরুরি সভা আহ্বান করা হয়েছে। সভায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে মিলগুলোতে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে বলে তিনি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, মিল মালিকরা অন্য কোথাও ধান মজুদ করে রেখেছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হবে।
দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর সিএন্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক শাহীন হোসেন জানিয়েছেন, সরকার চালের আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ নির্ধারণ করায় হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে চাল বাংলাদেশে আসছে। চালের বাজারের স্থিতিশীলতা আনার জন্য তাদের অ্যাসোসিয়েশন গত শুক্রবারেরও হিলি স্থলবন্দর দিয়ে প্রায় দেড়’শ ট্রাক চাল আমদানি করেছেন বলে তিনি জানান।
হিলি স্থলবন্দরের বেসরকারি অপারেটর পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপক অসিত কুমার জানান, হিলি স্থলবন্দর দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ভারত থেকে ১’শ ৩০ থেকে দেড়’শটি করে চাল বোঝাই ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। তাতে এই বন্দর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার মেট্রিকটন চাল ভারত থেকে বাংলাদেশে আসছে।
হিলি স্থলবন্দরের কাস্টমস সুপারিনটেনডেন্ট মো. ফখর উদ্দীন জানান, এই বন্দরের মাধ্যমে ভারত থেকে আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে। বরং ঈদের পর থেকে বেশি চাল আমদানি হচ্ছে। বন্দরে চাল বোঝাই ট্রাক আসার সাথে সাথে খালাস কার্যক্রমও সম্পন্ন করা হচ্ছে। যাতে ব্যবসায়ীরা দ্রুত চাল খালাস করে তাদের গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারেন।
এরপরও দিনাজপুরে এক সপ্তাহের ব্যবধানে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে চালের দাম। এক সপ্তাহ আগে প্রতিকেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হতো ৫২ টাকা দরে। এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকা কেজি দরে। এ ছাড়া বিআর-২৮ চাল প্রতিকেজি ৪৮ টাকার স্থলে ৫৫ টাকা, স্বর্ণা ৪২ টাকার স্থলে ৪৭ টাকা, হাইব্রিড মোটা ৩৭ টাকার স্থলে ৪৪ টাকা, বিআর-২৯ চাল প্রতিকেজি ৪৬ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকায়।
চালের সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার চালের আমদানি শুল্ক দু’দফায় কমালেও বাজারে কিছুতেই কমছে না চালের দাম। বরং ধানের জেলা দিনাজপুরে প্রতিদিন চালের দাম বেড়েই চলেছে। এই পরিস্থিতিতে শুল্ক কমানোর সুফল মিলছে না ভোক্তা পর্যায়ে। ফলে খেটে খাওয়া মানুষেরা চরম বিপাকে পড়েছেন। পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও ধানের জেলা দিনাজপুরে চাল নিয়ে চালবাজি শুরু করেছে একটি সিন্ডিকেট। এমনটাই ধারনা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বগুড়ায় বন্যা সহনশীল এজেড ৭০০৬ ধানের মাঠ দিবস
একজন স্বাপ্নিক মানুষ এরেনা এগ্রোর কর্ণধার ডা. খন্দকার মুহাম্মাদ মাহমুদ
টাঙ্গাইলে ফিরে এসেছে হাউসের আউশ ধান
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/এম