মুন্সীগঞ্জে মধু চাষে ব্যস্ত চাষিরা

390

মো. রুবেল ইসলাম তাহমিদ (মুন্সীগঞ্জ) থেকে: মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে সরিষার ক্ষেতে থেকে মধু চাষে ব্যস্ত চাষিরা। এখানে মাঠের পর মাঠ সরিষার ফুলের হলুদ রঙ আববাহিকার প্রকৃতি যেন হলুদ শাড়ি পরিধান করেছে। এসব সরিষা ক্ষেতে মৌমাছির ভন ভন শব্দে যেন প্রকৃতি কন্যার বিয়ের সানাইয়ের সুর তুলেছে। তিন কিলোমিটারের মধ্যে মধু সংগ্রহ করতে পারে নির্দেশ মতো এ মৌমাছিরা। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত রানীর নির্দেশে কাজ করেন।

শ্রীনগর মৌচাষি নজরুল ইসলাম বলেন, ১৬০টি মৌ বাক্সে ৭ দিনে ২৫ মণ মধু সংগ্রহ করা যাবে। যার বাজার মূল্য তিন লাখ টাকা। এ উপজেলায় প্রায় কয়েকটি মৌ চাষির দল প্রায় দুই কোটি টাকার মধু সংগ্রহ করলেও চাষির অভাবে শুধু এ উপজেলায় কোটি কোটি টাকা মধু শুকিয়ে যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আমার বাবা ১৯৬০ সনে হিমালয়ের উত্তর প্রদেশ নিখিল ভারত থেকে মৌমাছি চাষ বা পালনের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে বর্তমান ২ বছর ধরে বাংলাদেশে মধু চাষ আরম্ভ করে।

উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা কল্যণ কুমার সরকার জানান, সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌমাছির চাষ হলে সরিষার ফলন ১০% বৃদ্ধি পায়। তাই সরিষার ফলনও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

কৃষিবিদ জাহেদুল আলম রুবেল জানান, সরিষা ক্ষেত থেকে বিনা খরচে মধু সংগ্রহ লাভজনক ব্যবসা হয়ে দেখা দিয়েছে। এতে কৃষকের একদিকে মধু বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অন্যদিকে ক্ষেতে মধু চাষ করায় সরিষার ফলনও বৃব্ধি পাবে। কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও সহযোগিতায় চলতি বছরে উপজেলায় সরিষা ক্ষেতে মধু চাষের আটটি খামার গড়ে তোলা হয়েছে।

[metaslider id=”8263″]
তিনি আরো জানান, কোনো দুযোর্গ না এলে সরিষায় বাম্পার ফলনের পাশাপাশি কয়েক হাজার টন মধু সংগ্রহ করতে পারবে কৃষক। সরিষা ক্ষেতে মধু চাষে উজ্জল সম্ভাবনা রয়েছে, সরিষা ক্ষেতে মৌমাছি থাকলে তা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ফলন বাড়ে। এতে সরিষার ফুলে মৌমাছি যে পরাগায়ন ঘটায় তাতে সরিষার দানা ভালো হয় এবং ফলনও বাড়ে। যে সরিষা ক্ষেতে মৌমাছি নেই সেখানে সরিষার ফলন কম হয়। সরিষা ক্ষেতে মধুর খামার গড়ে তোলার জন্য আমরা সব সময় কৃষককে উৎসাহ দেই। এর ফলে কৃষক দুদিক থেকে লাভবান হয়। এ বছর উপজেলায় আটটি মধুর খামার গড়ে তুলেছে কৃষক।

ওই কর্মকর্তা আরো জানান, সরিষা ক্ষেতে মধুর খামার গড়ে তোলার প্রচলন ছিল না। গত বছর ফরহাত হোসেনের নামের এক কৃষক সরিষা ক্ষেতে মধু চাষ করে লাভবান হয়েছে। গত ওই খামার দেখে অনেকেই মধু চাষে আগ্রহ দেখায়। এর ফলে এ বছর আটটি খামার শুরু করা হয়েছে। সরিষা ক্ষেতে মধু চাষ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হলে সরকারিভাবে কৃষকদের মাঝে সতেনতা সৃষ্টি, পুঁজির যোগান, আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং মধু বিপননের ব্যবস্থা করতে হবে। মূলত পৃষ্ঠপোষকের অভাবে সরিষা ক্ষেতে মধুর খামার করতে পারছে না কৃষক। তাছাড়া ওই খামার যে ব্যাপক লাভজনক সেটাও জানে না অনেক স্থানের কৃষক।

মুন্সিগঞ্জ জেলার ৬টি উপজেলায় যে পরিমাণ জমিতে সরিষার চাষ হয়ে থাকে তার অর্ধেক চাষ হয় লৌহজংও শ্রীনগড়ে। এ বছরও উপজেলার পূর্বাঞ্চল সীমান্ত এলাকাগুলোতে প্রায় ৩ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে ওই তথ্য।

সরেজমিনে সরিষা ক্ষেতে মধুর খামারে দেখা গেছে, সরিষা ক্ষেতের পাশেই সারিবদ্ধভাবে বসানো হয়েছে মৌমাছির বাক্স। হাজার হাজার মৌমাছি হলুদ রঙের সরিষার ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে বাক্সে জমা করছে। ৭/৮ দিন পর পর ওই সব বাক্স থেকে বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে মধু সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রতি বাক্সে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার মৌমাছি আর একটি মাত্র রানী মৌমাছি থাকে। রানী মৌমাছি ডিম দেয়। মৌমাছির নাম ‘এফিস মিলি ফেরা’ জাতের মাছি। সারাদিন মাছিগুলো সরিষার ফুলে পরাগায়ন ঘটায় এবং মধু সংগ্রহ করে। এতে প্রায় ৩ কিলোমিটার দুরের সরিষা ক্ষেত থেকে মধু সংগ্রহ করে মাছিগুলো।

আজিজ হোসেন নামের মধু চাষি জানান, আমার খামারে দেড়শর মতো বাক্স রয়েছে। প্রতিবাক্সে ৯/১০টি করে মোমের ফ্রেম রয়েছে। মোমের ফ্রেমে মাছি মধু জমা করে আর রানী মাছি ডিম দেয়। যখন ফ্রেমগুলো মধুতে ভরে যায় তখন বাক্স থেকে ফ্রেমগুলো খুলে বিশেষ প্রক্রিয়ায় মাছি মুক্ত করা হয় এবং ড্রামের মধ্যে ঘুরাইয়া (ঘুর্ণায়মান ড্রাম) মধু পৃথক করে নেয়া হয়। এতে প্রতি বাক্স থেকে ৬/৭ লিটার মধু বের করা যায়। খামার করতে খরচের মধ্যে একটা বাক্স ৬০০ টাকা, একটা মোমের ফ্রেম ৫০০ টাকা। বাক্সভর্তি মৌমাছি নারায়নগঞ্জ থেকে কিনে আনা হয়েছে। সরিষা ক্ষেত থেকে সংগ্রহ করা এসব মধু ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা লিটারে বিক্রি করা যায়। এ বছর তিনি ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা লাভের আশা করছেন। আজিজের মতো আরো ৭জন মধু চাষি খামার করেছেন শ্রীনগড়ে।

ফুলের ওপর নির্ভর করে মধুর ভিন্নতা। সরিষার ফুল থেকে যে মধু পাওয়া তার দাম একটু কম। সুন্দরবনের মধুর দাম একটু বেশি। প্রতিবছর যে পরিমাণ সরিষার আবাদ হয় তাতে অর্থনৈতিক দিক থেকে উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য কৃষককে সরকারি বা বেসরকারি ভাবে সহযোগিতা করতে হবে। মধু চাষে কৃষকের প্রধান সমস্যা পুঁজির অভাব আর বাজারজাত করনের।’মৌমাছির ভেঁ ভোঁ ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের শ্রীনগরের চৌধুরী রাস্থা ধরে পূর্ব দিকে আগাতেই রাস্তার দু’পাশের জমিগুলো এখন হলুদ রংয়ে ছেয়ে গেছে। যতদুর চোখ যায় শুধু হলুদ আর হলুদ। জেনো মন কেড়ে নেয় হলুদের এই সমারোহ।
রাস্তা ধরে প্রায় ১ কি.মি. আগালেই বীরতারা ইউনিয়নের সাতগাঁও গ্রাম। এ গ্রামের জমিগুলো এখন হলুদ বর্নে ছেয়ে গেছে। গ্রামের সরিষা জমিগুলো এখন হলুদ ফুলে প্রকৃতিকে বদলে দিয়েছে। যুগ যুগ ধরে প্রকৃতি বদলের সাথে সাথে বদলেছে দেশের জীব বৈচিত্র। আর তাই বহু বছর যে চোখে পড়ে না, এখানে গেলে তাই দেখা যায়। হলুদ সরিষা জমিতে তাকালেই চোখে পড়বে অসংখ্য মৌমাছি ভেঁ ভোঁ করে উড়ছে। এক সরিষা গাছ থেকে অন্য সরিষা গাছের হলুদ ফুলে উরে উরে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত মৌমাছি। অথচ গোটা মুন্সীগঞ্জ ঘুরে হাতে গোনা কয়েকটি মৌমাছির মৌচাক পাওয়া যাবে তা বলা মুশকিল। কিন্তু এতো মৌমাছি এখানে এলো কোথা থেকে? এর উৎস্য খুজতে কিছুটা এগিয়ে যেতেই বেড়িয়ে এলো আসল রহস্য।

সরিষা জমির এক কোন সারি সারি বাক্স নিয়ে বসে আছে মৌচাষী নজরুল ইসলাম প্রতিবারের মত এবারও তিনি তার পোষা মৌমাছিগুলো নিয়ে মধু সংগ্রহে চলে এসেছেন এই সাতগাঁও গ্রামে।

মধু আহরণে নজরুল ইসলামের পোষা মৌমাছির ব্যস্ততার জেনো শেষ নেই। তবে মৌমাছিকে এখন আর দূরের কোন বন-বাগানের খোঁজে দীর্ঘ পথ উড়ে যেতে হচ্ছে না। নজরুল ইসলাম এর মত এক শ্রেণির বাণিজ্যিক মৌমাছি পালনকারী মৌমাছিদের নিয়ে যাচ্ছে ফসলের ফুল ফোটা জমিতে। সেখানের মধু আহরণ করে বাক্সে মৌচাক তৈরি করছে। এতে এক দিকে যেমন মৌমাছি পালনকারী ব্যক্তি আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে পাশাপাশি কৃষকও বাড়তি উপার্জনসহ পরাগায়নের মাধমে জমিতে বাড়তি ফসল উৎপাদন করছে। মৌমাছির আহরিত মধুগুলো আবার নিয়ে আসা হচ্ছে নানা কৌশলে। সহজ এই পন্থায় কৃষকেরও হচ্ছে বাড়তি আয়।

সরিষা চাষের পাশাপাশি মৌ মাছির খামার বসিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছে এখন মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার সাতগাঁও গ্রামের কৃষক। সেখানেই মৌমাছির মধু কর্মযজ্ঞ। দিনভর মৌমাছি তিল তিল করে মধু এনে জমাচ্ছে মৌচাষী নজরুল ইসলাম পেতে রাখা বাক্সে। আর সুযোগতম সেই বাক্স থেকে সুকৌশলে মধু কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্য এখন এখনকার নিত্যদিনকার। হেমন্তের অগ্রায়হন থেকেই এই মধু সংগ্রহের মৌসুম শুরু করেছে বেলায়েত। আর শীতের পৌষে যেন মধু সংগ্রহের ভর মৌসুম। ভোরের শিশির বিন্দু ফুলে ফুলে ঝড়ছে। সেই ভোরের সূর্য উঠতেই মৌমাছির মধু আনার ব্যাস্ততা শুরু। তা চলে সূর্যের আলো নিভে যাওয়ার আগ মূহূর্ত পর্যন্ত। আর সকাল, দুপুর, বিকেল প্রতিটি সময় যেন প্রকৃতির নানা রূপ ভর করে সাতগাঁওয়ের এই মধু পল্লীতে।

ছোট-বড় মিলিয়ে তার ৪টি মৌমাছির ভ্রাম্যমান বাক্সবন্দী খামার রয়েছে। দেশের ৪টি অঞ্চল থেকে তিনি এখন ফসলি জমিতে এসব ভ্রাম্যমান বাক্সবন্দী মৌমাছিগুলোকে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে মধু সংগ্রহ করছেন। এবার ১০২টি বাক্সের এমনই একটি মৌমাছির খামার নিয়ে বসেছেন লৌহজংয়ের বেজগাঁও গ্রামের সরিষার জমিতে। মৌমাছিগুলি বাক্স থেকে নির্দিষ্ট পথে বের হয়ে সড়িষা জমির ফুলে ফুলে মধু সংগ্রহ করে ফিরে আসছে বাক্সে। বাক্সের ভিতরে থাকা বিশেষ ফ্রেমে মৌচাকে মধু জমা করছে। প্রতিটি বাক্সে রয়েছে ৭ থেকে ১০টি ফ্রেম।

ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন