দেশের দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘মিল্কভিটা’ দেশে দুধের বাজার হারাতে বসেছে। বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো মিল্কভিটার ব্যবসা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ‘ষড়যন্ত্রে’ লাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘মিল্কভিটা’র মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রতিবেদনে ১৪ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।
এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে মিল্কভিটা রক্ষায় জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন, গুঁড়াদুধ আমদানির ওপর সর্বোচ্চ করারোপ, দুগ্ধসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সহজশর্তে ব্যাংক ঋণ ও বেদখল হওয়া গো-চারণ উদ্ধারসহ ১৪ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।
বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব মাফরুহা সুলতানা বৃহস্পতিবার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদন পাওয়ার পর মিল্কভিটা থেকেও এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিবেদন দুটি নিয়ে ইতিমধ্যে আমরা বৈঠক করেছি। জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়নে কমিটি গঠনসহ এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সুপারিশগুলোর উল্লেখযোগ্য হলো- দেশীয় উৎপাদিত গুঁড়াদুধের ব্যবসা বাড়াতে আমদানি করা (শিশুদের জন্য প্রযোজ্য গুঁড়াদুধ ছাড়া) গুঁড়াদুধের ওপর ক্রমান্বয়ে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ হারে করারোপ; যাতে আমদানি নির্ভরতা কমে আসে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় কোনো ষড়যন্ত্রের মুখে যেন মিল্কভিটা মুখ থাবড়ে না পড়ে সে ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া। মিল্কভিটায় কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কেউ যেন নিজের হীনস্বার্থে প্রতিষ্ঠানবিরোধী কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে প্রতিষ্ঠানটির ক্ষতি না করতে পারে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া।
জাল দলিলের মাধ্যমে যারা সরকারি গো-চারণভূমি দখলে রেখেছেন তাদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে খাসজমি ফিরিয়ে আনা। দুগ্ধ শিল্পকে অগ্রাধিকার (বিশেষ) খাত হিসেবে ঘোষণা করা। প্রান্তিক, ভূমিহীন ও দরিদ্র খামারিসহ দুধ শিল্পের সঙ্গে জড়িত নারী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সহজশর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা। বিশেষ কিছু জমিতে সাধারণ ফসলের বদলে গরুর মানসম্মত ঘাষ চাষ ও গরুর প্রজনন প্রক্রিয়াসংক্রান্ত প্রকল্প গ্রহণ করা। দুগ্ধ শিল্পসমূহ বিদ্যুৎ ব্যবহারে ক্ষুদ্র শিল্পের আওতায় বাণিজ্যিক বিল থেকে রেহাই দেয়া এবং এ খাতের পদ্ধতিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে নারী ও খামারিবান্ধব করে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া ইত্যাদি।
জাতীয় পর্যায়ে মিল্কভিটা কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে নেই মন্তব্য করে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়- বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আধুনিক ও কৃষিবান্ধব পদ্ধতির মাধ্যমে দ্রুত ব্যবসা প্রসারিত করছে। এর বিপরীতে মিল্কভিটাকে খুবই নিরুত্তাপ দেখা যায়। বেসরকারি টেলিফোন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সরকারি টেলিফোন কোম্পানির যে অকল্পনীয় পার্থক্য- এ ক্ষেত্রেও অদ্ভুত সামঞ্জস্যতা দেখা যায়। যারা মিল্কভিটায় চাকরি করছেন তারা এই প্রতিষ্ঠানের লাভ-ক্ষতি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো গুরুত্ব না দেয়ায় বর্তমানে লাভজনক হলেও মিল্কভিটার যে অবস্থানে থাকার কথা জাতীয় পর্যায়ে সে অবস্থানে নেই। অথচ প্রতিষ্ঠানটি যে পরিমাণে সরকারি সহায়তা পেয়ে থাকে সে অনুযায়ী জাতীয় চাহিদা পূরণে যথাযত ভূমিকা রাখতে পারছে না।
মিল্কভিটার সার্বিক চিত্র তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়- দেশের একমাত্র সরকারি দুগ্ধ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটা। যা রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুধের চাহিদা পূরণ করে আসছে। মিল্কভিটার পাশাপাশি বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানিও দুগ্ধশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। এ ছাড়া ছোট ছোট আরও অনেক প্রতিষ্ঠানও এ খাতে যুক্ত রয়েছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় ১১১টি ডিজিটাল ফ্যাট টেস্টিং মেশিন স্থাপন করেছে। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে তাদের আরও বেশি পরিমাণে মেশিনগুলো চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। দুধ পাওয়ার ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুভ সংবাদ হলেও মিল্কভিটার ব্যবসা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এসব বহুজাতিক কোম্পানি বড় ধরনের হুমকি হতে পারে। কারণ, তাদের দুধ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি মিল্কভিটার চেয়ে সুবিধাজনক ও অত্যাধুনিক। তারা সরাসরি দুধ সংগ্রহ করায় খামারিরা দুধের সঠিক দাম পায় এবং ভেজালমুক্ত মানসম্মত দুধ পাওয়া যায়। পাশাপাশি এসব কোম্পানির কর্মকর্তারা গরিব কৃষক ও খামারিদের ঘাস সংরক্ষণ, গরু-মহিষ লালন-পালনের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য ও পরামর্শ দেন। এ ছাড়া প্রতি লিটার দুধে দুই টাকা বোনাস দেয়া হয়। এই বাড়তি টাকা রোজার ঈদের আগে দেয়া হয়। এসব কারণে দিন দিন খামারিরা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর দিকে ঝুঁকছে।
মিল্কভিটা লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়ালেও বাথানিদের তেমন উন্নতি হচ্ছে না উল্লেখ করে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়- প্রতি লিটার দুধে প্রায় ৪৭ টাকা লাভ করছে মিল্কভিটা। অথচ খামারিরা প্রতিলিটার দুধে পাঁচ থেকে সাত টাকা বৃদ্ধির দাবি করলেও তা মানা হচ্ছে না। মিল্কভিটাসহ বেসরকারি দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদিন দুধ সংগ্রহ না করলে খামারি চাষীদের উৎপাদিত দুধ লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হয়। ফলে নানা কারণে দুধের ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত হন খামারিরা। অব্যাহত লোকসানের মুখে কৃষক ও খামারিরা এ পেশাকে অলাভজনক মনে করতে শুরু করেছে।
সরকারি গো-চারণভূমি স্থানীয় প্রভাবশালীরা আত্মসাৎ করছে বলে উল্লেখ করে বলা হয়- স্বাধীনতার আগে চলন বিল অঞ্চলের বেড়া, সাথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুরা, চাটমোহর, উল্লাপাড়া ও শাহজাদপুর উপজেলার ৪০০টি বাথান এবং প্রায় পাঁচ হাজার একর গো-চারণভূমি ছিল। জাল দলিল ও ভুয়া পত্তনি নিয়ে এলাকার একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি এসব গো-চারণভূমি আত্মসাৎ করায় বর্তমানে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র এক হাজার ৩০ একরে। এ নিয়ে ছয়টি মামলা হয়েছে।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন