চাঁপাইয়ে আমচাষিদের প্রায় ৩শ কোটি টাকার ক্ষতি

363

চাঁপাই

দফায় দফায় শিলাবৃষ্টিতে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষিদের। চৈত্র ও বৈশাখ মাসের শিলাবৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে আমের। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। এ অবস্থায় এবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের উৎপাদনে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

চলতি আম মওসুমের শুরু থেকেই এবার প্রতিকূল আবহাওয়া বিরাজ করছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে মুকুল আসে বাগানগুলোতে। শেষ পর্যন্ত বাগানগুলোতে ভালো মুকুল এলেও মহা নামক এক প্রকার পোকার আক্রমণসহ নানা কারণে অনেক বাগানেই পর্যাপ্ত গুটি আসেনি। ফলে মওসুমের শুরুতেই এক দফা বিপর্যয়ের মুখে পড়েন আমচাষিরা।
এরপর চৈত্র মাসে হঠাৎ করে তিন দফা শিলাবৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে আমের। ভয়াবহ শিলাবৃষ্টি হয়েছে চৈত্র মাসের শেষ দিন বিকেলে। ওই দিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার দুই পৌর এলাকাসহ আরো আটটি ইউনিয়নে ভয়াবহ শিলাবৃষ্টি হয়। আমচাষিরা এই শিলাবৃষ্টিকে স্মরণকালের ভয়াবহ শিলাবৃষ্টি বলে অবিহিত করেছেন।

স্থানীয় কৃষি বিভাগের তথ্য মতে ওই দিনের শিলাবৃষ্টিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও শিবগঞ্জ পৌরসভাসহ সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা, ঝিলিম ও গোবরাতলা এবং শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট, চককীর্তি, ধাইনগর, নয়ালাভাঙ্গা ও শ্যামপুর ইউনিয়নের দুই হাজার ৮০০ হেক্টর জমির আমবাগান আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ২০৫ হেক্টর জমির আম পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এর আগের দুই দফা শিলাবৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতি হয় আমের। সর্বশেষ গত বুধবার রাতেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকাসহ বেশ কিছু এলাকায় মাঝারি ধরনের শিলাবৃষ্টি হয়েছে।

গত কয়েক দিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকাসহ বালিয়াডাঙ্গা ও গোবরাতলা ইউনিয়নের রামজীবনপুর, নওদাপাড়া, গোরক্ষনাথপুর, জামবাড়িয়া, চকঝগড়–, নসিপুর, বালিয়াডাঙ্গা, শ্রীরামপুর, পালসা, গুণির মোড়সহ বিভিন্ন এলাকার আমবাগান ঘুরে দেখা গেছে শিলাবৃষ্টির ধ্বংসযজ্ঞ। প্রতিটি বাগানে বিপুল পরিমাণ আম পড়ে থাকতে দেখা যায়। ভেঙে পড়েছে আমগাছের বিপুল পরিমাণ ডালপাতা। এ ছাড়া এখনো গাছে ঝুলে অনেক আমে রয়েছে শিলার আঘাতের দাগ। ক্ষতি কমাতে বাগানে বাগানে ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে দেখা গেছে আমচাষিদের।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার আরামবাগের প্রবীণ আম ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, ১৩ এপ্রিলের শিলাবৃষ্টি ছিল এই এলাকায় স্মরণকালের ভয়াবহ শিলাবৃষ্টি। তার ৬০ বছরের ব্যবসায়ী জীবনে এমন শিলাবৃষ্টি তিনি দেখেননি।

আজাইপুরের আমচাষি রাকিব জানান, ১৩ এপ্রিলের শিলাবৃষ্টিতে তার ১৫ লাখ টাকা আমের মধ্যে ১০ লাখ টাকার আম পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি বলেন, দীর্ঘ ব্যবসায়ী জীবনে শিলাবৃষ্টিতে এমন ক্ষতি এর আগে আর কখনো হয়নি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ ম্যাংগো প্রডিওসার মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ জানান, চার দফার শিলাবৃষ্টিতে এরই মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৩৫ শতাংশ আম পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। আর্থিক ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকার ওপরে। কোনো কোনো বাগান পুরোটায় আমশূন্য হয়ে পড়েছে। ফলে এবার জেলায় আমের উৎপাদন কমে যাবে বলে মনে করেন তিনি। এই অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত আমচাষিদের জন্য প্রণোদনা দেয়ার দাবি জানান তিনি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ফল বিজ্ঞানী ড. শরফ উদ্দিন জানান, শিলায় ক্ষতিগ্রস্ত আমবাগান রক্ষায় সতর্ক থাকতে হবে আমচাষিদের। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত বাগানগুলোই ছত্রাকনাশক স্প্রে করার পরামর্শ দিয়েছেন।

তবে আতঙ্কিত হওয়ার খুব এটা কারণ নেই জানিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মঞ্জুরুল হুদা জানান, শিলায় ক্ষতি হলেও আমের উৎপাদনে বিপর্যয় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এবার জেলায় পৌনে তিন লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হতে পারে।

এদিকে বিষমুক্ত আম উৎপাদনের জন্য এবারো আম বাজারজাতকরণের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। গত ১৫ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ২০ মে থেকে গুঠি, ২৫ মে থেকে গোপালভোগ, ২৮ মে থেকে ক্ষিরসাপাত, ১ জুন থেকে লক্ষণভোগ, ৫ জুন থেকে ল্যাংড়া ও বোম্বাই, ১৫ জুন থেকে আম্রপলি, ফজলি ও সুরমা ফজলি এবং ১ জুলাই থেকে আশ্বিনা আম বাজারজাত করতে পারবেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষিরা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হাসান জানান, বিষমুক্ত আম উৎপাদনের জন্য এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া আম পাকাতে কেউ যেন কেমিক্যাল ব্যবহার করতে না পারে, সেদিকেও দৃষ্টি রাখবে স্থানীয় প্রশাসন।

এ দিকে এত কিছুর পরও জেলায় আম চাষে জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থানীয় কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী চাঁপাইনবাবগঞ্জে এবার প্রায় ২৯ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছে। আমগাছের সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ। জেলায় প্রায় শতাধিক জাতের আম চাষ হয়। এর মধ্যে সুস্বাদু গোপালভোগ, ক্ষীরসাপাত, ল্যাংড়া, ফজলি, আম্রপলি, আশ্বিনা, ক্ষুদি খিরসা, বৃন্দাবনী, লক্ষণভোগ জাতের আমই বেশি চাষ হচ্ছে। দিন দিন আম চাষে জমির পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী ২০০৭ সালে জেলার পাঁচ উপজেলায় আম চাষ হতো ২১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে। ২০১৮ তে এসে তা দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৫১০ হেক্টরে। ১০ বছরে আম চাষে জমি বেড়েছে প্রায় আট হাজার হেক্টর।এনডি।

নিউজবাংলাদেশ.কম/এমএস