কিছুদিন পূর্বে একটা পোস্টে (লিংক সংযুক্ত) লিখেছিলাম, বাংলাদেশে ব্যবহৃত সরিষার তেলে অধিক মাত্রায় Erucic Acid থাকার কারণে দীর্ঘদিন ব্যবহারে এর স্বাস্থ্য ঝুকি আছে। আবার বাজারজাতকরণের জটিলতার জন্য দেশের বাজারে প্রাপ্ত কোনো তেলই ১০০% ভালো না। তাই আজ সরিষার এমন এক জাতের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো যা হতে পারে রান্নায় ব্যবহারের জন্য আপনার প্রথম পছন্দ। মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে বলে রাখা ভালো বাজারে প্রাপ্ত তেলে সমস্যা কি? এটা জানতে হলে আপনাকে সর্বপ্রথম তেল আহরণ (Extraction) পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু ধারণা থাকতে হবে। সাধারণত তেল দুইভাবে আহরণ করা হয়। দুই পদ্ধতিতেই কিছু সুবিধা-অসুবিধা আছে।
.
• কোল্ড প্রেসিং- সহজ ভাষায় আমরা ঘানি ভাঙ্গা বলতে যা বুঝি কোল্ড প্রেসিং তাই। এটা কাঠের এবং মেটাল দুইভাবেই হয়ে থাকে। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এই এক্সট্রাকশন করা হয় এবং আহরিত তেলের পুষ্টিমান অক্ষুন্ন থাকে। এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত তেলের পরিমাণ এবং তেলের স্থায়িত্ব (shelf life) কম হয়। যে কারনে এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত তেলের (বোতলজাত) দাম বেশি। এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত তেলকে ভার্জিন গ্রেড বলে।
.
• হট প্রেসিং- সাধারণত বাণিজ্যিকভাবে এই পদ্ধতিতে তেল উৎপাদন করা হয়। কারণ যে সব তৈল বীজে তেলের পরিমাণ কম থাকে (যেমন- সয়াবিন বীজে তেলের পরিমাণ ১৭-২০%) তাদের হট প্রেসিং এর মাধ্যমে প্রসেস করা হয়। এই প্রদ্ধতিতে তৈলবীজকে উচ্চ তাপমাত্রায় রোস্ট করে দ্রাবক (সয়াবিনের ক্ষেত্রে হেক্সেন) মিশ্রিত করে তেল আহরণ করা হয়। সেই তেলের স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য হাইড্রজেন অণু যুক্ত করা হয়। একে হাইড্রজিনেশন বলে। এই পদ্ধতিতে তেলের তুলনামুলকভাবে পরিমাণ ও স্থায়িত্ব বাড়লেও hot pressing এর প্রতিটার ধাপে তেলের পুষ্টিমান কমতে থাকে এবং ফ্রি র্যাডিকেল, ট্রান্সফ্যাট ইত্যাদির পরিমাণ বাড়তে থাকে। যার কারণে এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত তেলের দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারে শরীরে inflammation, cancer ইত্যাদির ঝুঁকি বাড়তে পারে। বাংলাদেশের বাজারে বোতলজাত তেলের বেশিরভাগই হট প্রেসড।
.
এখন পুষ্টিমান বিবেচনায় কোল্ড প্রেসড তেলের বিকল্প নেই। কিন্তু চাইলেই আপনি সব তেল বীজ ঘানিতে ভাঙতে পারবেন না বিশেষ করে যেসব বীজে তেলের পরিমাণ কম থাকে। প্রচলিত পদ্ধতিতে বাংলাদেশে কেবল সরিষা ঘানিতে ভাঙা হয় তবে সেখানে ক্ষতিকর ইরুসিক এসিড আছে। তবে সম্প্রতি (২০১৮) সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) কতৃক সরিষার একটি জাত উদ্ভাবিত হয়েছে যার নামকরণ করা হয়েছে বারি সরিষা-১৮। এই জাতটিতে ইরুসিক এসিডের পরিমাণ নাই বললেই চলে। এই জাতটি ক্যানোলা গুণাগুণ সম্পন্ন। ক্যানোলা একটি উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদ থেকে তেল উৎপাদনের জন্য জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। সরিষার তেলের বিকল্প হিসেবে উন্নত বিশ্বে এই ক্যানোলার তেল সরিষার বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের সুপারশপে এই তেল পাওয়া গেলেও এর মূল্য অধিকাংশের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। ক্যানোলার গুণাগুণ সম্পন্ন বারি সরিষা-১৮ বাংলাদেশে চাষের জন্য অভিযোজিত এবং এর বীজে তেলের পরিমাণ ৪০-৪২%। দেশীয় পদ্ধতিতে এর তেল আহরণ করা যায় বলে এই ভোজ্য তেল হিসেবে এই তেল একদম নিরাপদ। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (SAU) কতৃক উদ্ভাবিত আরেকটি তৈল ফসল সাউ পেরিলা-১ নামে উদ্ভাবিত হয়েছে যাতে প্রচুর ওমেগা-৩ (৬০%+) ফ্যাটি এসিড রয়েছে এবং এর বীজ থেকেও দেশীয় পদ্ধতিতে তেল আহরণ সম্ভব। অন্য একদিন এই নতুন তৈল বীজ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
.
কোথায় পাবেন বারি সরিষা-১৮ এর বীজ?
.
বারি সরিষা-১৮ এখনও বাণিজ্যিকভাবে বিস্তারলাভ করেনি। তাই বাজারে এর বীজ পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মাঠ পর্যায়ে এই তেল ফসলটির প্রদর্শনী স্থাপনের মাধ্যমে ফসলটির বিস্তার ও জনপ্রিয় করার লক্ষে এগিয়ে যাচ্ছে। আপনি নিকটস্থ কৃষি অফিসে যোগাযোগ করে উক্ত প্রদর্শনীর কৃষকের নিকট থেকে এর বীজ সংগ্রহ করতে পারবেন। এর মাধ্যমে কৃষক বীজের নায্যদাম পাবে এবং মিডলম্যানদের দৌরাত্ম্য কমে যাবে। প্রতি মণ বীজ থেকে প্রায় ১৪-১৬ লিটার তেল পাবেন।
.
আপনার যদি আবাদী জমি থাকে তাহলে সরাসরি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে বারি সরিষা-১৮ এর বীজ সংগ্রহ করে নিজেই আবাদ করতে/করাতে পারবেন। এর জীবন কাল ৯০-৯৫ দিন এবং বিঘা (৩৩ শতাংশ) প্রতি ৮-৮.৫ মণ ফলন হয়। বিস্তারিত চাষাবাদ পদ্ধতি কৃষি তথ্য সার্ভিসের ওয়েবসাইটে পেয়ে যাবেন।
ফার্মসএন্ডফার্মার/ ১৭ আগস্ট ২০২১