শীতকালে মুরগির ঠান্ডাজনিত হাঁচি, কাশি, সর্দি, মাথা ফুলে যাওয়াসহ বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয়। মুরগির ঠান্ডা লাগা এসব একাধিক রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা জানা থাকলে পোল্ট্রি খামারি ভাইদের অনেকটাই সুবিধে হয়।
টার্কির মাইকোপ্লাজমোসিস রোগকে অনেক খামারি টার্কির ঠান্ডা লাগা রোগ বলে থাকেন। মুরগির ঠান্ডা লাগা একাধিক রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা নিয়ে লিখেছেন ডা. বলরাম কুমার রায়, পোল্ট্রি কনসালটেন্ট ও ভেটেরিনারি সার্জন, জেলা ভেটেরিনারি হাসপাতাল।
টার্কি ও মুরগির মাইকোপ্লাজমা/ঠান্ডাজনিত রোগ: মাইকোপ্লাজমা রোগের প্রায় ২০ টি সিরোটাইপ (serotype) আছে। যা এভিয়ান সোর্স থেকে গৃহীত। এর মধ্যে তিনটির প্রভাব পরিলিক্ষত হয়। যথা- মাইকোপ্লাজমা গ্যালিসেপ্টিকাম (Mycoplasma gallisepticum), মাইকোপ্লাজমা মেলিয়াগ্রেডিস (Mycoplasma meleagrides) ও মাইকোপ্লাজমা সাইনোভি (Mycoplasma synoviae)।
মাইকোপ্লাজমা স্পিসিস (Mycoplasma species) খুব সম্ভবত ১৯৩৩ এবং ১৯৩৯ সালে Nelson কর্তৃক সর্বপ্রথম মুরগিতে সনাক্ত করা হয়। যা পরবর্তীতে ১৯৪৩ সালে Delaplame ও Stuart কর্তৃক মুরগির মাইকোপ্লাজমা রোগকে ‘ক্রোনিক রেসপিরেটরি ডিজিজ ‘(Chronic Respiratory Diseases or CRD) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
এ মাইকোপ্লাজমা রোগ টার্কিতে ১৯০৫ সালে সনাক্ত করেন Dodd এবং ১৯৩৮ সালে Dikinson ও Hinshan এ রোগের নামকরণ করেন ‘ইনফেকশাস সাইনুসাইটিস ‘(Infectious sinusitis)। পরবর্তীতে পোলট্রি ও টার্কিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মাইকোপ্লাজমা গ্যালিসেপ্টিকাম (Mycoplasma gallisepticum) নামক জীবাণু সনাক্ত ও পৃথক করা হয়।
টার্কি ও পোলট্রি সেক্টরে মাইকোপ্লাজমা গ্যালিসেপ্টিকাম নামক জীবাণুর খারাপ প্রভাব: মাইকোপ্লাজমা গ্যালিসেপ্টিকাম মুরগিকে আক্রান্ত করলে ‘ক্রোনিক রেসপিরেটরি ডিজিজ ‘( Chronic Respiratory Diseases or CRD) এবং টার্কিকে আক্রান্ত করলে ‘ইনফেকশাস সাইনুসাইটিস’ (Infectious sinusitis) নামে অভিহিত করা হয়।
এ রোগের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো: শ্বাস নেওয়ার সময় গলায় গরগর শব্দ (Respiratory rales), কাশি, নাক দিয়ে শ্লেশ্মা নিঃস্বরণ এবং টার্কির প্রায়শই সাইনুসাইটিস (frequently sinusitis) আক্রান্ত হওয়া।
মাইকোপ্লাজমা গ্যালিসেপ্টিকাম জীবাণুর সাথে কিছু ভাইরাস বিশেষ করে নিউক্যাসল ডিজিজ ভাইরাস (NDV), ইনফেকশাস ব্রংকাইটিস ভাইরাস (Infectious bronchitis virus) ও এসকারেসিয়া কোলি একত্রে সংক্রামিত হলে খুবই জটিল (Very complicated) আকার ধারণ করে।
মুরগির ক্ষেত্রে এয়ার স্যাকুলাইটিস (air sacculitis) এবং টার্কির ক্ষেত্রে এয়ার স্যাকুলাইটিস (air sacculitis) ও সাইনুসাইটিস (sinusitis)এ রোগের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।
এ রোগের লক্ষণ: ক) টার্কির ক্ষেত্রে: টার্কির নাক দিয়ে শ্লেশ্মা নিঃস্বরণ সহ চোখে ফেনাযুক্ত শ্লেশ্মা নিঃস্বরণ (foamy lacrimation) ও প্যারান্যাজাল সাইনাস (paranasal sinus) ফুলে (swollen) যাওয়া এ রোগের অন্যতম লক্ষণ।
কোন কোন সময় চোখ আংশিক অথবা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে সাইনাস (sinus) মারাত্মক ভাবে ফুলে যাবে। আক্রান্ত টার্কি শুকিয়ে হাল্কা হবে। ট্রাকিয়ায় গরগর শব্দ হবে,কাশি সহ ব্যথা যুক্ত শ্বাস গ্রহণ করবে যদি এয়ার স্যাকুলাইটিস (air sacculitis) ও ট্রাকিআইটিস (Trachiitis) থাকে। ব্রিডার টার্কির ক্ষেত্রে ডিমের উৎপাদন কমে যাবে।
খ) মুরগির ক্ষেত্রে: মুরগির ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্খেযোগ্য লক্ষণ হলো, পূর্ণবয়স্ক মুরগির ট্রাকিয়ায় গরগর শব্দ (Tracheal rales ) হবে, নাক দিয়ে শ্লেশ্মা নিঃস্বরণ ও তীব্র কাশি থাকবে। খাদ্য গ্রহণে অনীহা ও দৈহিক ওজন হ্রাস পাবে। ডিম পাড়া মুরগির ডিম পাড়া কমে যাবে।
ব্রয়লার মুরগির ক্ষেত্রে: অধিকাংশ ব্রয়লার ফ্লকে সাধারণত ৪ থেকে ৮ সপ্তাহ বয়সের মধ্যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।
আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার: মাইকোপ্লাজমা গ্যালিসেপ্টিকাম সংক্রমণ সাধারণত শীতকালীন সময়ে বেশি দেখা দেয়। এছাড়াও খামারের টার্কি ও মুরগি ধকলে আক্রান্ত হলে যে কোন সময় এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে।
বয়স্ক মুরগি ও টার্কি থেকে কম বয়সের টার্কি ও মুরগি এ রোগের প্রতি অধিক সংবেদনশীল। এ রোগের সাথে নিউক্যাসল ডিজিজ ভাইরাস, ইনফেকশাস ব্রংকাইটিস ভাইরাস ও ই, কোলি একত্রে সংক্রমণ ঘটলে রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে ও জটিল আকার ধারণ করবে।
অধিকাংশ টার্কি এ রোগে আক্রান্ত হয়। যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে টার্কিতে সাইনুসাইটিস প্রকাশ পায় না। তবে ডিম পাড়া টার্কি আক্রান্ত হলে জটিলতা বেড়ে যায়।
প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা: এ রোগের জীবাণু সাধারণত ডিমের মাধ্যমে বাচ্চা মুরগি ও বাচ্চা টার্কিকে জন্মগত ভাবে আক্রান্ত করে। কারণ এ রোগের জীবাণু ডিমের মাধ্যমে (Vertical transmission) ছড়িয়ে পড়ে। তাই উন্নত ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন ব্রিডার ফার্ম থেকে বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে।
এছাড়াও বাণিজ্যক খামারের ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও জীবনিরাপত্তা (Biosecurity) ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। ব্রিডার মুরগি ও টার্কিকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হবে।
চিকিৎসা: এ রোগের চিকিৎসায় টার্কির ক্ষেত্রে টিয়ামুলিন (Tiamulin) ভালো কাজ করে। মুরগির ক্ষেত্রে টিয়ামুলিন (tiamulin), টাইলোসিন (Tylosin) ও ক্লোরটেট্রাসাইক্লিন (সিটিসি) ভালো কাজ করে।
তবে খাদ্যে যদি আয়োনোফোর জাতীয় কক্সিডিওস্ট্যাট মেশানো থাকে সেক্ষেত্রে কোন অবস্থাতেই টিয়ামুলিন ব্যবহার করা যাবে না। উল্লেখ্য, খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সমূহ তাদের উৎপাদিত খাদ্যের প্যাকেটে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন যে টিয়ামুলিন ব্যবহার করা যাবে কিনা।
ফার্মসএন্ডফার্মার/১৭জানুয়ারি২০২১