ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের নানা উদ্যোগ

415

ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ রয়েছে। এসব উদ্যোগের কারণেই প্রতিবছর ইলিশের উৎপাদনে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে প্রতিবছর ৮ মাস জাটকা ও প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ, অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা, জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ পালন, সমুদ্রে ৬৫ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ, বিশেষ কম্বিং অপারেশনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে সরকারের।

প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশ আহরণ এবং জাটকা ধরা নিষিদ্ধ সময়ে উপকূলীয় এলাকার জেলেদের জীবন ধারণের জন্য ভিজিএফের (ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং) আওতায় খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়।

মৎস্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ১০ ইঞ্চি বা ২৫ সেন্টিমিটারের (ঠোঁট থেকে লেজের প্রান্ত পর্যন্ত) চেয়ে ছোট ইলিশ মাছকে জাটকা বলা হয়। প্রতিবছর নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত ৮ মাস জাটকা ধরা নিষিদ্ধ থাকে

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রওনক মাহমুদ বলেন, ‘ইলিশ রক্ষায় আইন শক্তভাবে বাস্তবায়ন করছি আমরা। যারা জাটকা ধরছে না কিংবা নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরা থেকে বিরত থাকছে তাদের সহায়তা দিচ্ছি। ভিজিএফের মাধ্যমে তাদের সহায়তা দিচ্ছি। ইলিশ রক্ষায় সরকার নানাভাবে কাজ করছে।’

মৎস্য অধিদফতরের ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. জিয়া হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘মা ইলিশ রক্ষায় ২২ দিন মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকে। আমাদের ইলিশের ৬টি অভয়াশ্রম আছে। সেগুলো ম্যানেজমেন্ট করা হয়। ১০ ইঞ্চির নিচে ইলিশ (জাটকা) ধরলে শাস্তির মুখে পড়তে হয়। নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত জাটকা ধরা বন্ধ থাকে।’

মাছ ধ্বংসকারী অবৈধ জাল নির্মূলে অভিযান চালানো হয়

জাটকা ধরা থেকে বিরত থাকা জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে জানিয়ে মৎস্য অধিদফতরের উপ-প্রধান (ইলিশ) মাসুদ আরা মমি বলেন, ‘এতে জেলেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। বিকল্প কর্মসংস্থানের উপকরণ যথা : রিকশা/ভ্যান, ছাগল পালন (২টি), সেলাই মেশিন, গরু মোটাতাজাকরণ, ক্ষুদ্র ব্যবসা, জাল সরবরাহ, হাঁস-মুরগি পালন, গাছের চারা তৈরি, সবজি বাগান এবং খাঁচায় মাছ চাষ উপকরণ দেয়ার ফলে জেলেরা জাটকা আহরণের নিষিদ্ধ সময়ে জীবিকা নির্বাহ করতে সক্ষম হচ্ছে।’

জাটকা ধরা বন্ধ থাকে ৮ মাস

ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে প্রতিবছর নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত ৮ মাস জাটকা ধরা নিষিদ্ধ থাকে। এই সময়ে জাটকা ধরলে ও বেচা-কেনা করলে শাস্তির মুখে পড়তে হয়।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব সুবোধ চন্দ্র ঢালী বলেন, ‘গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় জাটকা ধরা নিষিদ্ধ সময়ে দেশের ২০ জেলার ৯৬টি উপজেলায় জাটকা আহরণে বিরত মোট ৩ লাখ ১ হাজার ২৮৮ জন জেলে পরিবারকে সহায়তা দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক জেলে পরিবারকে ৪০ কেজি হারে ৪ মাসের জন্য প্রায় ৪৬ হাজার ৫৮০ টন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘চলতি বছর প্রথম কিস্তিতে ফেব্রুয়ারি ও মার্চের জন্য ৩ লাখ ২৮ হাজার ৮১৫ জন জেলের ৪০ কেজি হারে ২৬ হাজার ৩০৫ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।’

প্রজনন মৌসুমে ২২ দিন ইলিশ ধরা-বিক্রি নিষিদ্ধ

চান্দ্রমাসের ভিত্তিতে প্রধান প্রজনন মৌসুম ধরে প্রতিবছর আশ্বিন মাসে প্রথম চাঁদের পূর্ণিমার চার দিন আগে থেকে পূর্ণিমার দিনসহ পরের ১৭ দিন মিলিয়ে মোট ২২ দিন ইলিশ ধরা, মজুত, পরিবহন, সংরক্ষণ ও বিক্রি নিষিদ্ধ থাকে।

নিষিদ্ধ সময়ে সারাদেশের মাছের ঘাট, আড়ৎ ও হাট-বাজারে অভিযান চলে

২০১৫ সালের আগে প্রধান প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষায় ইলিশ ধরা নিষিদ্ধের সময় ছিল ১১ দিন। ২০১৫ সালে তা বাড়িয়ে ১৫ দিন করা হয়। ২০১৬ সালে ৭ দিন বাড়িয়ে করা হয় ২২ দিন।

গত বছর নিষিদ্ধের সময় ১৫ দিন থাকলেও এবার ১৯৮৫ সালের মাছ রক্ষা ও সংরক্ষণ বিধি (প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন ফিস রুলস, ১৯৮৫) সংশোধন করে এ সময় ৭ দিন বাড়ানো হয়েছে।

১৯৮৫ সালের মাছ রক্ষা ও সংরক্ষণ বিধি (প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন ফিস রুলস, ১৯৮৫) অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে কমপক্ষে এক বছর থেকে সর্বোচ্চ ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ড পেতে হবে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে শাস্তি দ্বিগুণ হবে।

এই সময়ে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা জেলেদের জেল-জরিমানা করা হয়। আটক করা হয় অবৈধ জাল। নিষিদ্ধ সময়ে সারাদেশের মাছের ঘাট, মৎস্য আড়ৎ, হাট-বাজারে অভিযান চালানো হয়।

মৎস্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, চলতি বছর ইতোমধ্যে মা ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ সময়ের আগেই দেশের ইলিশ সমৃদ্ধ ৩৬ জেলার ১৫২ উপজেলায় মোট ৫ লাখ ২৮ হাজার ৩৪২টি জেলে পরিবারকে ২০ কেজি হারে মোট ১০ হাজার ৫৬৭ টন খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে।

ইলিশ রক্ষায় চালানো হয় বিশেষ কম্বিং অপারেশন

মৎস্য অধিদফতর থেকে জানা গেছে, গত বছর মা ইলিশ রক্ষা অভিযানে দেশের ৩৭ জেলার ১৭৩টি উপজেলায় মা ইলিশ রক্ষায় অভিযান পরিচালিত হয়েছে। মা ইলিশ রক্ষায় গত ৯ বছরে মোট ১৫ হাজার ৫৯০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং ৭৫ হাজার ১৮৩টি অভিযান চালিয়ে ৬৩৩ টন ইলিশ জব্দসহ ২৯ কোটি ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার মিটার জাল এবং ৪ কোটি ১৩ লাখ ৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।

সমুদ্রে বছরে ৬৫ দিন বন্ধ থাকে মাছ ধরা

সামুদ্রিক মাছের প্রজনন ও সংরক্ষণে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানায় প্রতিবছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন বাণিজ্যিক ট্রলার দিয়ে সব ধরনের মাছ ও চিংড়ি আহরণ নিষিদ্ধ থাকে। ২০১৫ সাল থেকে এই নিয়ম চালু করে সরকার।

সামুদ্রিক জলসীমায় ৬৫ দিনের মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ সময়ের জন্য উপকূলীয় সব জেলে পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়। গত বছর ৪ লাখ ১৯ হাজার ৫৮৯টি জেলে পরিবারকে ৪০ কেজি হারে মোট ৪২ হাজার ৮৫৩ টন চাল দেয়া হয়েছে। বিশেষ ভিজিএফের আওতায় এই সহায়তা কার্যক্রম ২০১৮-১৯ সালে শুরু হয়।

ইলিশ রক্ষায় জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ পালন

ইলিশ রক্ষায় প্রতি বছর জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ পালন করে সরকার। সাধারণত মার্চ বা এপ্রিল মাসে এই কর্মসূচি পালন করা হয়। গত বছর ৪ থেকে ১০ এপ্রিল জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ উদযাপন করা হয়। সপ্তাহ উদযাপনের অংশ হিসেবে এ সময় সচেতনতামূলক কার্যক্রম ছাড়াও অভিযান চালানো হয় হাট-বাজারে।

বিশেষ কম্বিং অপারেশন

মৎস্য সম্পদ ধ্বংসকারী বেহুন্দি ও অন্যান্য অবৈধ জাল নির্মূলে গত বছরের মতো এবারও দুই ধাপে বিশেষ কম্বিং অপারেশন পরিচালিত হয়েছে। প্রথম ধাপে গত ১০ থেকে ১৬ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয় ধাপে ২৫ জানুয়ারি থেকে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই অভিযান চালানো হয়।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মোট ১৫ দিন বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও মুন্সিগঞ্জ— এই ১৭টি জেলায় বিশেষ কম্বিং অপারেশন পরিচালনা করা হয়েছে।

প্রতি বছর জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ পালন করা হয়

বিশেষ কম্বিং অপারেশনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে মোট এক হাজার ৬৮১টি অভিযান এবং ৪৯২টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে প্রায় ৪৪ হাজার ২৮৬ টন জাটকা আটক করা হয়েছে। অন্যান্য মাছ আটক করা হয়েছে এক দশমিক ৬৮ টন।

ভ্রাম্যমাণ আদালত ও অভিযানের মাধ্যমে ২৭৪ দশমিক ১৮ লাখ মিটার কারেন্ট জাল, ২ হাজার ৪৪৮টি বেহুন্দি জাল এবং ২ হাজার ৩৫৫টি অন্যান্য জাল আটক করা হয়েছে। এছাড়া জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৯ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। ১১১ জন জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে জেল দেয়া হয়েছে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।

আরও যেসব পদক্ষেপ

জেলেদের জীবনমান উন্নয়ন এবং উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নে বিশ্ব ব্যাংকের সহযোগিতায় ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রকল্পটি মৎস্য অধিদফতর বাস্তবায়ন করছে।

পদ্মা, মেঘনার ঊর্ধ্বাঞ্চল ও নিম্ন অববাহিকায়, কালাবদর, আন্ধারমানিক ও তেঁতুলিয়াসহ অন্যান্য উপকূলীয় নদীতে মোট ৬টি ইলিশ অভয়াশ্রম স্থাপন ও অংশীদারত্বমূলক ব্যবস্থাপনা জোরদার করা হয়েছে।

ইলিশসহ অন্যান্য সকল উপকূলীয় জলজ মেঘাফনা রক্ষায় এবছরই নিঝুম দ্বীপ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় ৩ হাজার ১৮৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সামুদ্রিক সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে।

ইলিশের পোনা জাটকা যেন ইলিশ ধরার জালে আটকে না যায়, তাই সরকার ফাঁস জালের সাইজ ৬ দশমিক ৫ সেমি নির্ধারণ করা হয়েছে।

ফার্মসএন্ডফার্মার/১৯মার্চ২০২১