দেশে ভেষজ উদ্ভিদের বড় অংশ চাষ হয় নাটোর সদর উপজেলার খোলাবাড়িয়াসহ অন্তত ৩০টি গ্রামে। প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ কোটি টাকার ভেষজপণ্য উৎপাদিত হয় এই ‘ঔষধি গ্রাম’ গুলোয়। কিন্তু দেশীয় বাজার সৃষ্টি না হওয়ায় এর সুফল পাচ্ছে না চাষিরা; তারা সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। অথচ প্রতিবছর ৪০০ কোটি টাকার ভেষজসামগ্রী আমদানি করে দেশীয় হারবাল ও ইউনানি কম্পানিগুলো। এই খাতে উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজার দখল করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
নাটোর সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০০৪ সালে নাটোরে সর্বপ্রথম ঔষধি গাছের চাষ শুরু করেন (লক্ষ্মীপুরে) আফাজ পাগলা নামের এক ব্যক্তি। বর্তমানে খোলাবাড়িয়া ছাড়াও লক্ষ্মীপুর, নতুনবাজার, পিগজিপাড়া, টুলটুলিয়া, খামার, বালুঘাট, কাঁঠালবাড়িয়া খামারপাড়া, আমিরগঞ্জ, হিসুলী, এতিম মোড়, চৌরী, দক্ষিণপুর, মোল্লার মোড়, ইব্রাহীমপুরসহ অন্তত ৩০টি গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে ঔষধি গাছের চাষ হচ্ছে। এসব গ্রামের ৩২ থেকে ৩৫ হাজার লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই পেশায় জড়িত। ঔষধি গাছ চাষ করেই চলছে তাদের সংসার।
কৃষি বিভাগ আরো জানায়, বর্তমানে ৩০টি গ্রামে ঘৃতকুমারী (অ্যালোভেরা), ঘৃতকমল, স্বর্ণলতা, পাথরকুচি, উলট কম্বল, শতমূল, মিছরীদানা, তুলসী, থানকুচি, জার্মানিলতা, হরীতকী, বহেরা, আমলকী, চিরতা, তালমাখনা, তেলাকুচি বাসক, তাল মাখনা অশ্বগন্ধা, শিমুল মূল, লজ্জাবতী (সাদা, লাল), হস্তিগন্ধা, তেজবল, দুধরাজ, নাগেশ্বর, আমরুল, ঘোড়া চাণ্ডাল, কাল ধুতরা, ঘিয়া বাবলা, লতা কস্তুরী, আলকুচি অপরিচিতা, ভুই কুমরা, হস্তীপলাশ, বিজ্জিমূলসহ ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ প্রজাতির ঔষধি গাছ চাষ হচ্ছে। নাটোরে ২০১৪ সালে ঘৃতকুমারী চাষ হতো ২৫ হেক্টর জমিতে, এখন হয় ৫০ হেক্টরে। আর প্রায় ৩৫০ হেক্টর জমিতে হচ্ছে ঔষধি গাছের চাষ। এ ছাড়া অর্শগন্ধা, শিমুল মূল, কালো মেঘসহ অন্যান্য গাছের চাষও বাড়ছে দিন দিন। এক বিঘা জমিতে ঔষধি গাছ চাষ করতে চাষিদের খরচ হয় লাখ টাকার ওপরে। কিন্তু অনেক সময় পুঁজি সংকটে ভুগতে হয় চাষিদের।
ভেষজ চাষিদের অভিযোগ, ব্যবসায়ীদের ফাঁদে পড়ে উৎপাদিত ঘৃতকুমারীসহ বিভিন্ন ভেজষ কম মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে চাষিরা। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন কম্পানির প্রতিনিধিরা এই সিন্ডিকেট করে চাষিদের দাদন দিয়ে কম দামে ঔষধি পণ্য কিনছে।
লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া গ্রামের কৃষক শাজাহান আলী, আমিরগঞ্জ বাজারের আব্দুল খালেক, জয়নাল আবেদীন জানান, ঘৃতকুমারী প্রতি কেজি ১৫ থেকে ১৭ টাকায় বিক্রি হলেও কম্পানির প্রতিনিধিরা দাম দেয় ৯ টাকা। এ ছাড়া ক্রেতা বা কম্পানির একটি গাড়িতে মজুদ ঘৃতকুমারী ৩০০ কেজির বেশি হলে ৬০ কেজি ঢলন (অতিরিক্ত) দিতে হয়। এতে প্রতি কেজির দাম আরো কম হয়। নষ্ট পাতা দিলে তারা দাম আরো কম হাঁকে।
লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নের আমিরগঞ্জ বাজারে ভেষজের বাজার বসে। একমাত্র তাইওয়ান ফুড প্রডাক্ট নামে একটি কম্পানির প্রতিনিধিরা এখান থেকে ঘৃতকুমারী ভেষজ কিনে ঢাকায় পাঠায়। এ ছাড়া কৃষকদের দাদন (ঋণ) দেয় বেশ কয়েকজন। তারা পরে কম দামে ভেষজ বিক্রি করতে বাধ্য করে।
আমিরগঞ্জ বাজারের ভেষজ ব্যবসায়ী ও কৃষক আব্দুস সালাম শিকদার জানান, কম্পানির লোক ও স্থানীয় কিছু অর্থশালী চাষের আগেই কৃষককে দাদন দেয়। তারা ওই টাকার কমিশনের পাশাপাশি কম দামে ঘৃতকুমারী কিনে ঢাকার মহাজন বা কম্পানিতে বেশি দামে বেচে।
এক কৃষক জানান, তিনি এ বছর ১৫ কাঠা জমিতে ঘৃতকুমারী চাষ করেন। অনেকেই তাঁকে দাদন দেওয়ার জন্য ঘোরাঘুরি করে। টাকা না নেওয়ায় ভয় দেখিয়ে বলেছে, কে তাঁর ঘৃতকুমারী (ঘৃতকাঞ্চন) কিনতে আসে তারা দেখে নেবে। স্থানীয়দের অভিযোগ, লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া, আমিরগঞ্জ বাজারসহ ভেষজ গ্রামগুলোতে সিন্ডিকেট গড়ে ওঠায় স্থানীয় চাষিরা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।
তাইওয়ান ফুড প্রডাক্টের স্থানীয় প্রতিনিধি রব ভুঁইয়া সিন্ডিকেট গড়ার অভিযোগকে ভিত্তিহীন দাবি করে বলেন, কম্পানি ছাড়া কোনো মহাজন রিজেক্ট (ক্ষতিগ্রস্ত) মাল নেয় না। কম্পানি যে দামে মাল কেনে তাতে কৃষক লাভবান হচ্ছে। ভালোমানের ঘৃতকুমারীর প্রতি কেজির দাম দেওয়া হয় ১৫ টাকা। আর রিজেক্ট মালের দাম দেওয়া হয় প্রতি কেজি পাঁচ টাকা। অতিরিক্ত মালে কোনো ঢলন নেওয়া হয় না। তিনি নিজেও ঘৃতকুমারী চাষ করে থাকেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব বলছে, পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশ লোক রোগের নিরাময়ক হিসেবে ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহার করে থাকে। ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, অ্যালোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক, কবিরাজিসহ বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ভেষজ উদ্ভিদ দিয়ে ওষুধ তৈরি করে থাকে। বিশ্বব্যাপী ভেষজ ওষুধের বাজার দ্রুতগতিতে প্রসার লাভ করলেও বাংলাদেশে উল্টো পথে চলছে এই খাত। ২০০৪ থেকে নাটোরে বাণিজ্যিকভাবে ভেষজ উদ্ভিদ চাষ হলেও এখনো সৃষ্টি হয়নি এর বাজার। ফলে বিভিন্ন ফুটপাত ও হকারের মাধ্যমে ঔষধি পণ্য বিক্রি করে আসছে নাটোরের চাষিরা। তার পরও রয়েছে পুলিশি হয়রানির অভিযোগ।
সূত্র জানায়, বর্তমানে বিশ্বে ভেষজ উদ্ভিদের বাজার রয়েছে ৬২ বিলিয়ন ডলার। বিশাল এই বাজারের বেশির ভাগই ভারত ও চীনের দখলে। ২০৫০ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে ভেষজের বাণিজ্য বাজার হবে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের। বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় এই খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিবছর বাংলাদেশ (হারবাল ও ইউনানি কম্পানিগুলো) বহির্বিশ্ব থেকে অন্তত ৪০০ কোটি টাকার ভেষজপণ্য ও কাঁচামাল কিনছে। অথচ দেশে উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে চাষিরা। সঠিক মূল্য পেলে চাষিরা ভেষজ চাষে আগ্রহী হবে। আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে বহির্বিশ্বে ভেষজ রপ্তানি করা সম্ভব।
ফার্মসঅ্যান্ডফার্মার২৪ডটকম/মোমিন