আমনের বাম্পার ফলন হলেও ন্যায্য দামের শঙ্কায় কৃষক

338

ধান

এবারও আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। সারা দেশের তথ্য সংগ্রহ করে এমনটাই জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় ধান কাটা শুরু হয়েছে। কিন্তু কৃষকের মুখে হাসি নেই।

হাসি থাকবেই বা কেন! ধানের ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে তারা সংশয়ে রয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, প্রতি মণ ধান উৎপাদনে ৭৫০-৮০০ টাকা খরচ হয়। কিন্তু হাট-বাজারে প্রতি মণের বিক্রয় মূল্য ৬০০ থেকে ৬৭৫ টাকা। ফলে প্রতি মণে লোকসান হবে ১৫০-২০০ টাকা। এ হিসাবে প্রতিবিঘায় গড়ে ২৫ মণ ধান উৎপাদন হলে লোকসান গুনতে হবে ৪ হাজার টাকা।

জানা যায়, চলতি অর্থবছরে ৫৮ লাখ ৭৯ হাজার হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক কোটি ৫৩ লাখ ৫৭ হাজার টন। কিন্তু অধিদফতরের তথ্যমতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আরও বেশি হবে। সব জেলায় ধান কাটা শেষ হলে আসল চিত্র তুলে ধরা যাবে।

জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক কৃষিবিদ চন্ডী দাস কুন্ডু যুগান্তরকে বলেন, মাঠ পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী এবার আমনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি হবে। তবে এখন পর্যন্ত দেশের সব স্থানে ধান কাটা শুরু হয়নি। শেষ হতেও আরও কয়েক দিন লাগবে। এ কারণে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কত বেশি উৎপাদন হবে, এটা বলা মুশকিল। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন বেশি হবে এটা বলা যায়।

বুলবুলের প্রভাবে আমনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় কোনো প্রভাব ফেলবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উপকূলে ঝড়ের কারণে ফসলের ক্ষতি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তা সার্বিকভাবে চিন্তা করলে এক শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। যার কারণে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় কোনো প্রভাব ফেলবে না।’

দিনাজপুরের কৃষক রিগেন্দ্রনাথ রায় জানান, এক বিঘা জমিতে আমন ধান আবাদ করতে বীজতলা, চাষ, সার, কীটনাশক, কাটাই-মাড়াইসহ সব মিলিয়ে ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।

খরচসহ মোট খরচ হয়েছে ২০ হাজার থেকে ২১ হাজার টাকা। এক বিঘা জমিতে ২৫ মণ ধান উৎপাদন হয়। প্রতি মণ ধান উৎপাদনে ৭৫০-৮০০ টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বাজারে সেই ধান বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করা আছে ৬০০ থেকে ৬৭৫ টাকায়। এতে এক বিঘা জমির ধান বাজারে বিক্রি করলে উৎপাদন খরচ উঠবে না। বরং চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হবে।

তিনি বলেন, ‘ধানচাষ করে এখন লাভ হচ্ছে না। বাম্পার ফলনের পরও একরকম টানাটানির মধ্যেই থাকতে হচ্ছে। ধারদেনা বা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ধান উৎপাদন করে ঋণের টাকাও শোধ করতে পারছি না।’

একই গ্রামের প্রান্তিক কৃষক জয়ন্ত কুমার রায় বলেন, ‘আগাম ধান লাগাইছি লাভের আশায়। কিন্তু নতুন ধান বাজারে নিয়ে গিয়ে দেখি লাভ তো দূরের কথা আসলই ওঠে না। এবার আমন মৌসুমে বর্গা নেয়া ২ বিঘা জমিতে আগাম জাতের কটরা পারি ধান আবাদ করেছি। ২ বিঘা জমিতে আবাদ করতে হালচাষ, বীজতলা, নিড়ানি, সার, কীটনাশক, ধান কাটা ও মাড়াইসহ সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। ধান পেয়েছি প্রায় ৪০ মণ।

বাজারে প্রতিমণ ধান বিক্রি করেছি ৫১০ টাকা। এতে দুই বিঘা জমিতে আমন ধান আবাদ করে প্রায় ৫ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে।’ একই কথা জানান, পার্শ^বর্তী হাসিলা গ্রামের কৃষক মো. সোহরাব হোসেন।

দেশে আমন উৎপাদনের শীর্ষ জেলা হচ্ছে রাজশাহী, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও দিনাজপুর। উঁচু-নিচু লালমাটির এ পাঁচ জেলায় এবারও আমনের ভালো ফলন হয়েছে। বিস্তীর্ণ আমন খেতে এখন সোনালি ধানের সমারোহ।

আগামী সপ্তাহ থেকেই এই জেলাগুলোতে শুরু হবে আমন সংগ্রহের কাজ। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কৃষ্ণবাটি গ্রামের কৃষক এনামুল শেখ বলেন, ‘দুই বছর আগে প্রতিমণ ধানের দাম ছিল ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা। এতে কৃষক লাভবান হয়েছেন। কিন্তু গত বছর তারা মণপ্রতি দাম পেয়েছেন মাত্র ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকা। এ বছরও একই দাম আছে। তাই মনে হচ্ছে এবারও প্রতি বিঘায় ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা করে ক্ষতির শিকার হতে হবে।

এভাবে ক্ষতির মুখে পড়লে কীভাবে চলব ভেবে পাচ্ছি না।’ চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহাডাঙ্গা গ্রামের কৃষক মানিক শেখ জানান, আমন কাটাই-মাড়াই শুরুর পর অটো রাইস মিল মালিকরাই ধানের দাম নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা ধানের দাম কমানোর জন্য ধান ওঠার পর সিন্ডিকেট করে দুই সপ্তাহ কোনো ধান কেনেন না। ফলে এমনিতেই ধানের দাম পড়ে যায়। ঠিক দাম পড়ে যাওয়ার সময় তারা ধান কিনে গুদাম ভরে রাখেন।

এদিকে চলতি বছরের আমন মৌসুমে সরাসরি কৃষকের কাছে ২৬ টাকা কেজি দরে ৬ লাখ মেট্রিক টন ধান কিনবে সরকার। এ ছাড়া মিলারদের কাছ থেকে ৩৬ টাকা কেজি দরে তিন লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল এবং ৩৫ টাকা কেজি দরে ৫০ হাজার মেট্রিক টন আতপ চাল কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যা আগামী ২০ নভেম্বর থেকে ধান ও ১ ডিসেম্বর থেকে চাল সংগ্রহ শুরু হয়ে তা চলবে আগামী বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
ফার্মসএন্ডফার্মার২৪/জেডএইচ