উট পাখির বানিজ্যিক খামার

168

সিনান বার্ডস ব্রিডিং ফার্ম বাংলাদেশে সর্ব প্রথম সরকার কতৃক উট পাখির খামার ব্যবস্থাপনার অনুমোদন পায়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুরে আমাদের যা মনে হয়েছে বাংলাদেশে উট পাথি পালনে একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, দারিদ্র বিমোচনে এর খামার উন্নয়নে জেগে উঠবে আরও আর্থিক খাত ও কর্মসংস্থান,পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে যোগ করবে আরও বৈদেশিক মূদ্রা। বর্তমানে অনেকেই সরকার হতে উটপাখি পালনের পারমিশন নিচ্ছেন, আশা করা যায় আগামী ১০-১৫ বৎসরের মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় গড়ে ওঠবে অসংখ্য উট পাখির খামার। তাই আপনাদের সাথে আজ উট পাখির খামার ব্যাবস্থাপনা নিয়ে কিছুটা আলোচনা করছি।

বিশ্বে উট পাখি বানিজ্যিক ভাবে গুরূত্ব রাখে, উটপাখিকে বর্তমানে এর চামড়া, গোস্ত ডিম ও পালকের জন্য গৃহপালিত পাখি হিসাবে পালন করা হচ্ছে, দক্ষিন আফ্রিকা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়েতে, ইসরাইল, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বেড়ে চলছে উট পাথির থামার।১০ থেকে ১২ মাসের একটি উট পাখির ওজন হয় ৯০ কেজি পর্যন্ত, চামড়া পাওয়া যায় ১.২ থেকে ১.৪ স্কয়ার মিটার পর্যন্ত, পালক পাওয়া যায় ১-১.৭ কেজি পর্যন্ত।এবং এর থেকে ৫-৬ কেজি চর্বি পাওয়া যায় যা প্রসাধনী শিল্পে ব্যাবহার করা হয়।তুরস্কে উল্লেথ্যযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে উট পাখির খামার, গত ৫ বৎসরে সেখানে গড়ে উঠেছে ৩০০-র বেশি উট পাথির খামার এবং এদের ১০% এর মতন আছে যারা অচিরেই অন্যান্য দেশে রপ্তানী করবে।উট যে সকল পাথি থেকে উপাদান পাওয়া যায় অর্থাৎ গোস্ত, চামড়া, পালক, চর্বি, তার মধ্যে উট পাথি বিক্রেতারাই সবচেয়ে লাভ করে, তাই উট পাথির খামারের প্রতি আমাদের সবচেয়ে বেশি গুরূত্ব দেওয়া উচিৎ আর খামারিদের সাথে গোস্ত, চামড়া, পালক, প্রসাধনী কোম্পানীগুলোর বাৎসরিক চুক্তি থাকে।

খামারের স্থাপনের জন্য যে অত্যাবশ্যকীয় ব্যাপারগুলো বিবেচনায় রাখা দরকার তা হল: খামার শুরূ করতে হবে দক্ষিন আফ্রিকান কালো উট পাখি দিয়ে।যাদের বয়স হবে ৩-৪ এবং অতিতের ব্রিডিং রেকর্ড ভালো। খামারের স্থান অবশ্যই সমতল ও শুষ্ক হওয়া বান্ঞ্ছনীয় তাতে পাখি আঘাত পাবে কম এবং রোগের আশঙ্কা থাকবে অনেক কম। খামারটি অবশ্যই দীর্ঘ মেয়াদী হতে হবে কেননা সময়ের সাথে সাথে এর মুনাফাও বাড়তে থাকবে। খামারে কমপক্ষে ৫ সেট ট্রিয়স (১ টি পুরূষ + ২টি স্ত্রী) দিয়ে শুরূ করতে হবে। প্রতি সেট ট্রিয়স (১ টি পুরূষ + ২টি স্ত্রী) যেন পাখিগুলো কাছাকাছি থাকে অর্থাৎ ৩টি পাখিকে ৮০০2 মিটারের মধ্যে রাখতে হবে।আর প্রতিটি উট পাখির জন্য ৫2 মিটারের পরিমান জায়াগাগ সেড করে দিতে হবে।প্রত্যেকটি খামারে থাকতে হবে নিজস্ব হ্যাচরী ।

খেয়াল রাখতে হবে ব্রিডিং সিজনে ( ফেব্রূয়ারী থেকে সেপ্টেম্বর) প্রতিটি পাখিকে সঠিক মতন খাওয়ানো হচ্ছে কিনা, প্রতিটি পাখি দৈনিক ২ কেজি পিলেট খাদ্যে (১৮% সিপি, ২৪৫০কিলোক্যালরী এম ই)।এবং অন্যান্য সিজনে ১.৫ কেজি পিলেট খাদ্যে খাওয়াতে হবে।প্রজনন সিজনে উট পাখিকে খাদ্যের সাথে তাজা আলফালফা আর অফ সিজনে শুকনো আলফালফা মিসিয়ে খাওয়াতে হবে।নিরাপদ, জীবানুমুক্ত পানির ব্যাবস্থা রাখতে হবে সর্বদা।

প্রজনন রীতুতে স্ত্রী উট পাখি একটি নির্দিষ্ট সময় ডিম পাডে আর তখন তার কাছে লোক থাকতে হবে, ডিম পাড়ার সাথে সাথে তা সংগ্রহ করে পরিষ্কার করে রেজিস্ট্রি করতে হবে যেমন ডিমটির একটি আইডি নাম্বার, খামারের নাম, কোন স্ত্রী উট পাখির ডিম এটা, ওজন, দৈঘ্য, প্রস্থ্য, কবে ডিমটি পাড়া হয়েছে, ইত্যাদি তথ্য দিয়ে ডাটা বেস সংগ্রহ করে রাখতে হবে।

ডিমগুলোকে প্রথম ৭ দিন ১৬-১৮ ডিগ্রি সে: তাপে ও ৭০-৭৫ % আদ্রতায় রাখতে হবে, ৭ দিনে ডিমগুলোর খোলশ আরও শক্ত হবে এবং ওজন কিছুটা বৃদ্ধি পাবে, তারপর ডিমগুলোকে ইনকিউবেটর মেশিনের মধ্যে সাজিয়ে রাখতে হবে, এখানে ডিম গুলোকে ৩৬.৫° সে: তাপে ও ৩০% আদ্রতায় ৩৯ দিন রাখতে হবে, ডিম গুলোতে প্রতি ঘন্টায় ৪৫° এনেঙ্গে ঘুরিয়ে দিতে হবে।ইনকিউবেশনের ১৪ দিনের মাথায় ডিম কেন্ডেল টেস্ট অর্থাৎ বাল্বের সামনে ধরে দেখতে হবে ডিম নিষিক্ত হয়েছে কি না ? যদি ডিম নিষিক্ত না হয় তবে তার ভিতরে পরিষ্কার দেখা যাবে, আর নিষিক্ত হলে ভিতরে ঘোলা হয়ে যাবে।ডিম নিষিক্ত না হলে তাকে ইনকিউবেটর থেকে বের করে নতুন ডিম দিবে, খেয়াল রাখতে হবে যেন কোন নিষিক্ত ডিমই যেন ৩৯ দিনের আগে বের করা না হয়, ডিম, ৩৯ দিন ইনকিউবেটর মেশিন তা দেওয়ার পর হ্যাচিং মেশেনে(হেচার)-এর মধ্যে দিতে হবে, হ্যাচারের তাপমাত্রা ৩৬.৫° সে: এবং ৪০% আদ্রতায় সেই পর্যন্ত রাখতে হবে যেই পর্যন্ত ডিম ফুটে ছানা বের না হয়, তবে কম-বেশি মোট ৪৫ দিন পর্যন্ত দেথে ডিম থেকে ছানা বের করে আনতে হবে।

খামারে ছানাদের পালন:
ডিম থেকে ছানা বের হবার পর ছানাকে ২/৩ মাশ পর্যন্ত ১২ ফিট লম্বা, ৪ ফিট চওড়া ও ২ ফিট উচু একটি প্যানের মধ্যে রাখতে হবে, সদ্য ভূমিষ্ঠ বাচ্চাদেরকে ২৮-৩০° সে: তাপমাত্রায় রাখতে হয় এবং প্রথম সপ্তাহে দিনে ৩-৪ বার খাদ্য পরিবেশন করতে হয়। পরবর্তী ৩ সপ্তাহ রাত্রে ন্যূনপক্ষে ৩০° সে: তাপমাত্রা থাকা প্রয়োজন। বাচ্চা প্রতিপালন কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়বহুল। উট পাখির ছানাগুলোকে ৭% আয়োডিন সলুসনে পরিস্কার করে ধুয়ে নিতে হবে যেন তাদের ব্যাকটেরিয়া আক্রমন না করে, কোন ছানার যদি হাটতে কষ্ট হয় তবে সেটাকে সংরক্ষনে রেখে ধীরে ধীরে প্রশিক্ষনের মাধ্যমে হাটা শিখাতে হবে।প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। ছানাগুলোকে ৬-৮ দিন খাদ্যে পানি গ্রহন থেকে বিরত রাখুন, উটপাখির ছানার কোষের অভ্যন্তরে যে তরল পুষ্টি নিয়ে এরা জন্মগ্রহন করে তা দিয়ে এরা কয়েক দিনের পুষ্টি ও বৃদ্ধি সাধন হয়ে থাকে। তবে কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ বলেছেন ২/৩ দিন পর থেকে খাদ্যেপ্রদান শুরু করা যেতে পারে।

বড় না হওয়া পর্যন্ত ছানাগুলোকে চ্যাপ্টা প্লেটে পিলেট অথবা নুড়ি/কংকর মিশ্রিত খাবার দৈনিক কয়েকবার দিন।বাচ্চাদেরকে খাদ্যের সাথে ইসেনসিয়াল এমাইনো এসিড, ভিটামিন, প্রোটিন, এনার্জি ও ট্রেস ইলিমেন্টস্ সরবরাহ করতে হয়।ছানাকে কান্ডবিহীন ভেজা আলফালফা এবং ক্লোভার কুচি খাওয়ান , এদের সাথে ছানাকে নুড়ি/কংকর দিন, তাতে এই ভেজিটেবল গুলো হজমে সাহায়্যে হবে। তবে কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ বলেছেন এই ভেজিটেবল এর সাথে চালের সাইজের সমান নুড়ি পাথর খাওয়াতে বলেছেন। রাতে ছানাদের খাবার দেবার দরকার নেই, রাতে শুধু পানি চলবে।ছানাগুলোর জন্য কিচুটা খাদওয়ালা পানির পাত্র এমন ভাবে উপরে ঝুলিয়ে দিথে হবে তারা সহজে পানি পান করতে পারে আবার যেন পানি পান করতে গিয়ে ছানা পানিতে পড়ে না যায়।প্রতি তিনটি ছানার জন্য একটি পাত্র দিতে হবে, ছানা যথন অনেক ছোট থাকে তখন তাকে সচ্ছ পাত্রে পানি দিয়ে পানির প্রতি আকৃষ্ট করে তোলতে হবে।

কিশোর পাখির বয়স ৩ থেকে ১০ মাশ পর্যন্ত, এ বয়সেও ছানাদের ষ্পেশাল কেয়ারে রাখতে হয়, এ বয়সে এদের ইনডোরের পাশাপাশি মাঠে চড়ানোর অভ্যাস গড়ে তোলতে হবে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে কিশোর পাখিদের উন্মুক্ত পরিবেশে অবস্ত্য করাতে হবে। এ সময়ে এদর জন্য ভিতরে এবং বাইরে খাদ্যের ব্যাবস্থা রাখতে হবে।

খাদ্যে :
উটপাখি প্রধানত তৃণলতা, ঘাস, দানাদার খাদ্য, ফল ও ফুল ভক্ষণ করে। অবশ্য এরা মাঝে-মধ্যে পোকা-মাকড়ও ভক্ষণ করে থাকে।বাণিজ্যিকভাবে উটপাখি প্রতিপালনের ক্ষেত্রে পিলেটেড পোল্ট্রি খাদ্য খাওয়ানো হয়। দৈহিক বৃদ্ধি ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য খাদ্য ব্যবস্থাপনা হচ্ছে নিুরূপঃ ২০-২৪% ক্রুড প্রোটিন , ১২-১৯% ক্রুড ফাইবার , ১.২-২% ক্যালসিয়াম , ০.৬-১.১% ফসফরাস ১০,০০০-১৫,০০০ আই ইউ/ কেজি ভিটামিন এ , ১,৫০০-২,৫০০ আই ইউ/কেজি ভিটামিন ডি (ড্রাই ম্যাটারের ভিত্তিতে) প্রজননের জন্য উটপাখির খাদ্যের ফর্মূলা একই তবে এই সাথে ক্যালসিয়াম ২.৮% হারে প্রদান করতে হয়। পিলেটেড ফিডের সাথে সবুজ কচি শাক-সবজি সরবরাহ করতে হবে। এছাড়াও এদের খাদ্যের সাথে অতিরিক্ত ট্রেস ইলিমেন্টস্ সংযোজন করতে হয়।

রোগ ও চিকিৎসা:
উটপাখির জীবনীশক্তি প্রখর, এরা যে কোন পরিবেশে টিকে থাকতে পারে,তবে পরিস্কার পরিচ্চন্নতার ব্যাপারে সর্বদা সচেতন থাকা প্রয়োজন।আমাদের দেশে উট পাখির চাষ নতুন করে শুরূ হয়েছে, তাই এ পরযায়ে পাখি নিয়ে বড় কোন সমস্যায় পড়লে পাখি চিকিৎসকের কাছে যাওয়া দরকার তথাপি উটপাখির রোগ ও চিকিৎসা সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারনা থাকা দরকার, উট পাখির যে কমন রোগ রয়েছে সেগুলো হল: এঁটেল, উকুন, ফিতাক্রিমি, ওয়্যার কীট: , হেমোরেজিক অস্ত্রপ্রদাহ ইনফ্লুয়েন্জা, বসন্ত এভিয়ান পক্স , নিউকাস্ল ইত্যাদি।

বর্তমানে অনেকেই সরকার হতে উটপাখি পালনের পারমিশন নিচ্ছেন, আশা করা যায় আগামী ১০-১৫ বৎসরের মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় গড়ে ওঠবে অসংখ্য উট পাখির খামার। বর্তমান বিশ্বে যেই হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সাথে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে শিল্প কারখানা, একদিকে জমির সল্পতা অন্যদিকে বিশাল জনগোষ্টির খাদ্যে চাহিদা, এই বিশাল খাদ্যে চাহিদা পূরন করা এখন এক বিশাল চ্যালেন্জ হয়ে দাড়িযেছে,চিনের মতন উন্নত দেশ বর্তমানে অন্যান্য শিল্পের তুলনায় এগ্রোতে বেশি মনোনিবেশ করছে তাই নি:সন্দেহে বলা যায়, উট পাখির বহুল ব্যাবহারের মাধ্যমে গড়ে উঠবে নানান শিল্প, হবে আরও কর্মসংস্থান, দুর হবে অনেক ব্যকারত্ব, দারিদ্রতা, উন্নত হবে দেশের অর্থনীতি।