এন্টিবায়োটিকমুক্ত খামারের দিকে ঝুঁকছেন খামারিরা

236

যত্রতত্র এন্টিবায়োটিকের ব্যবহারকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ পোল্ট্রির জন্য অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। তথাপি আমাদের খামারির কিছু অংশ এখনও সেকালের মত এন্টিবায়োটিক নির্ভর খামার গড়ে তোলার দিকেই ঝুঁকছেন। তারা মনে করছেন এন্টিবায়োটিক মানেই হলো খামার আর খামার মানেই হলো এন্টিবায়োটিক।

অথচ এই এন্টিবায়োটিক কেবল মুরগির জন্য ক্ষতিকর না। এটি মানুষের জন্যও মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনে। মানুষ শরীরের আমিষের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকির দিকে ধাবিত হচ্ছেন এই এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করার মাধ্যমে। এছাড়া খামারীরা অহেতুক এন্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে।

এতকিছুর পরও আমাদের খামারিরা মনে করছেন এন্টিবায়োটিকহীন খামার করতে বলা মানেই হলো তাদেরকে লসের দিলে ঠেলে দেয়া। অথচ এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করে খামার করাতেই যেন ক্ষতি আর লসের অংকটা খুব বেশি এটা মানতে নারাজ তারা।

তবে সুসংবাদ হলো ইতোমধ্যে বর্তমানের অনেক শিক্ষিত এবং দক্ষ আর যোগ্য খামারীরা এখন এন্টিবায়োটিকমুক্ত খামার করার দিকে ঝুঁকছেন। আর তারা আশে-পাশে অন্য আট-দশজনের তুলনায় লাভও করছেন বেশ।

এগ্রিভিউ২৪.কম এর একান্ত সাক্ষাৎকারে এন্টিবায়োটিকমুক্ত খামার করে সফল হওয়া কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া থানার মো. মাসুদ জানান, তিনি ২০১৮-১৯ সাল পর্যন্ত খামার করেছেন এন্টিবায়োটিক দিয়ে। আর ২০২০ সালে এসে তিনি এন্টিবায়োটিক মুক্ত খামার করার সাহসি কাজে হাত দেন। আর তাতে তিনি সফলও হয়েছেন। আগে মুরগির খাবারও লাগতো বেশি এবং ওজনও হতো কম। আর মারাও যেতো বেশি। আর এন্টিবায়োটিকমুক্ত খামার করার পর থেকে তার সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান শুরু হয়। তার খামারে এখন মুরগির মৃত্যুহার একেবারেই কম। হাজারে বিশটার মত মারা যায় সর্বোচ্চ। আর খাদ্যও লাগে কম। আবার ওজনও হয় বেশি। গড়ে ২কেজি করে মাসে ওজন হয় বলে তিনি জানিয়েছেন।

ঢাকার ডেমরা এলাকার পোল্ট্রি খামারি আব্দুর রাজ্জাক সাইফ একজন পোল্ট্রি খামারী। এগ্রিভিউ২৪.কম‘কে জানিয়েছেন তার এন্টিবায়োটিকমুক্ত খামার করে সফলতার কথা। তিনি টানা ৯ বছর ধরে এন্টিবায়োটিকমুক্ত খামার করছেন। তিনি খামার শুরুর প্রথম দু‘বছর নিয়ম করে এন্টিবায়োটিক দিয়েই খামার পরিচর্চা করতে থাকেন। আর তাতে তিনি দু‘দিকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। একদিকে অর্থ অন্যদিকে খামাররের মুরগীর মৃত্যু বৃদ্ধি। পরে বন্ধুর মাধ্যমে এন্টিবায়োটিকমুক্ত খামার করা যায় শুনে ইন্টারন্টে ঘেঁটে জানতে পারেন ইউরোপের দেশগুলো এন্টিবায়োটিকমুক্ত খামার করে লাভবান হচ্ছে। তারপর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার সহায়তায় এন্টিবায়োটিক মুক্ত খামার শুরু করেন তিনি।

আব্দুর রাজ্জাক জানান, তিনি এন্টিবায়োটিক ব্যবহার না করার পর থেকে মুরগির গ্রোথ ও মাংস উৎপাদন আগের থেকে অনেক ভালো পেয়েছেন। ৩০ দিনে গড়ে ১.৭ – ২.০ কেজি পর্যন্ত ওজন পাচ্ছেন এখন নিয়মিত। তাছাড়া অহেতুক এন্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ ব্যবহার না করায় এখন প্রতি হাজার মুরগিতে ৫ হাজার টাকার ওষুধ খরচ বেঁচে যাচ্ছে তার।

তিনি আরো জানান, প্রতি মাসে ৭০০০ মুরগির জন্য অনেক টাকার ওষুধ কিনতে হচ্ছে না , যার ফলে আমার উৎপাদন খরচ কমে এসেছে।আমাদের লাভ হচ্ছে, খরচও কমেছে, স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ মাংস ও উৎপাদন করতে পারছি।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, বরিশাল, ডা. মো. নূরুল আলম বলেন, এন্টিবায়োটিক ছাড়া ব্রয়লার উৎপাদন করা যাবে না এটা ভুল ধারণা। এন্টিবোয়োটিক শুধু সুনির্দিষ্ট কিছু রোগের জন্য ব্যবহার করা হয়। ব্রয়লারের শরীরে কোন রোগ না থাকলে এর অযাচিত ব্যবহার ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন মাইকোপ্লাজমা রোগ, করাইজা এবং ই কেলাই রোগের সংক্রমণ।

তিনি বলেন, এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের পূর্বে অবশ্যই একজন রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারি চিকিৎসক কর্তৃক রোগটি নির্ণয় হওয়া উচিৎ। আমাদের দেশে পোল্ট্রি ফিড বিক্রেতারা খামারীদের একদিনের বাচ্চা বিক্রির সময় অকারণে এক গাদা এন্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন শুধু ব্যবসার জন্য।এন্টিবায়োটিক অপ্রয়োজন এবং অতিমাত্রায় ব্যবহার করলে ব্রয়লার কিংবা লেয়ারের শরীরের উপকারী ব্যাকটেরিয়া মারা যায়। যার ফলে উৎপাদন ব্যহত হওয়ার পাশাপাশি ব্রয়লারের ওজন বৃদ্ধি কমে যায়।

তিনি আরো বলেন, এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে মানুষের ক্ষতি হয়ে থাকে। কারণ এই এন্টিবায়োটিক অনেক সময় মুরগির বিষ্টার সাথে পানিতে আর মাটিতে গেলে সেখান থেকে মানুষের দেহেও প্রবেশ করে। তাই এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা মুরগির ক্ষেত্রে অনুৎসাহিত।

আমাদের দেশের খামারিরা খামার শুরুতে এক গাদা এন্টিবায়োটিক নিয়ে তারপর খামার শুরু করে। যা তার খামার এবং মানুষের পুষ্টির জন্য বড়ই ক্ষতিকর। এই জন্য দরকার অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে খামার পরিচালন করা। যাতে করে লাভবান হয় খামারিরা এবং সুস্থ থাকে মানবজাতি।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২৫জুন ২০২২