জলপাই চাষ অধিক ফলন যেভাবে পাবেন

324

স্বাদে-গুণে অনন্য জিবে জল আনা ফল জলপাই। আজ এর বিস্তারিত তুলে ধরা হলো

টক-জাতীয় ফল জলপাই। একে জয়তুনও বলা হয়। আদি বাসস্থান ছিল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল। পরে এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এ ফলটি। আমাদের কাছে জলপাই মুখরোচক একটি ফল। কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থায় ফলটি খাওয়া যায়। আচার, চাটনি, জ্যাম, জেলি প্রভৃতি তৈরিতে ব্যবহার হয়। দেশের আবহাওয়া জলপাই চাষের উপযোগী। তাই এর চাষাবাদ সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন

জাত

জলপাইয়ের দুটি জাত রয়েছেÑএকটি আরবীয় জলপাই বা জয়তুন, যা আরব অঞ্চলে ভালো জন্মে। এ জাতটি তেল তৈরিতে বেশি ব্যবহার হয়। দ্বিতীয়টি ভারতীয় জাত, যা সাধারণত কাঁচা খাওয়া হয়। আচার ও চাটনি তৈরিতে ব্যবহার হয়। বাংলাদেশে ভারতীয় জাতটাই ভালো জন্মে।

জমি নির্বাচন ও তৈরি

জলপাই চাষের জন্য প্রথমে জমি নির্বাচন করতে হবে। বন্যার পানি দাঁড়ায় নাÑএমন উঁচু বা মাঝারি উঁচু জমি বাছাই করে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। এরপর ভালোভাবে চাষ দিতে হবে। জমি ছাড়াও এর চারা বাড়ির উঠোন কিংবা ফেলে রাখা স্থানে রোপণ করেও আবাদ করা যায়।

রোপণের সময়

মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে পানি সেচের সুব্যবস্থা থাকলে সারা বছরই রোপণ করা যেতে পারে।

রোপণের নিয়ম

রোপণের অন্তত ১৫ থেকে ২০ দিন আগে গর্ত করে উম্মুক্ত অবস্থায় রাখতে হবে। গর্ত হতে হবে ২৩ী২৩ ফুট দূরত্বে, ৩ী৩ ফুট আকারের। গর্ত করার পর পরিমাণমতো পচা গোবর, টিএসপি সার, পটাশ, জিপসাম ও দস্তা সার মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে গর্তে দিয়ে বন্ধ করতে হবে। মাটিতে রসের ঘাটতি থাকলে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। গর্ত ভর্তির ১০ থেকে ১৫ দিন পর চারা গর্তের ঠিক মাঝখানে রোপণ করা উচিত। রোপণের সময় চারার গোড়া যাতে ঠিক খাড়া থাকে ও কোনোভাবে আঘাত না পায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। চারা রোপণের পর পানি দিতে হবে। পাশাপাশি খুঁটি ও বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এরপর দুদিন অন্তর পানি দিতে হবে।

রোগবালাই ও প্রতিকার

যে কোনো ফসল রোগাক্রান্ত হওয়াসহ পোকার আক্রমণের শিকার হতে পারে। জলপাইও নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। পোকার আক্রমণও দেখা দিতে পারে। এর রোগ ও প্রতিকার সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন

খোসা

লক্ষণ: ছোট আকৃতির খোসা পোকা গাছের পাতা, পাতার বোঁটা, কচি ডগা ও ফলের রস খায়। এরা দুইভাবে ক্ষতি করে থাকে। প্রথমত, রস চুষে খাওয়ার ফলে গাছের জীবনীশক্তি হ্রাস পায়। দ্বিতীয়ত, খাওয়ার সময় এরা গাছের রসের মধ্যে এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থ ছাড়ে। ফলে পাতা, ডগা ও ফলের ওপর হলদে দাগের সৃষ্টি হয়। মারাত্মক আক্রান্ত হলে গাছের ফলসহ পুরো গাছ মরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

প্রতিকার: এ পোকার আক্রমণ দেখা দিলে আক্রান্ত গাছে ডায়াজিনন বা ক্লোরপাইরিফস পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে পোকা দমন করতে হবে।

জাব

লক্ষণ: এ পোকা গাছের পাতা ও আগার রস খেয়ে এক ধরনের মিষ্টি রস নিঃসরণ করে। এর আক্রমণ বেশি হলে শুটি মোল্ড ছত্রাকের আক্রমণ ঘটে ও পাতায় কালো আবরণ দেখা যায়।

প্রতিকার: সামান্য আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে হাত দিয়ে পিশে পোকা মেরে ফেলা যায়। আক্রান্ত পাতা ও ডাল দ্রুত অপসারণ করতে হবে। ডিটারজেন্ট পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করলে পোকা চলে যায়। পোকার আক্রমণ বেশি হলে কৃষি অধিদপ্তরের পরামর্শ অনুযায়ী কীটনাশক পানিতে মিশিয়ে বিকালে স্প্রে করতে হবে।

পাতা পোড়া

লক্ষণ: এ রোগে আক্রান্ত হলে পাতায় প্রথমে হলুদ দাগ পড়ে। ধীরে ধীরে তা বাদামি রং ধারণ করে। এরপর পাতা শুকিয়ে যায়।

প্রতিকার: আক্রান্ত পাতা অপসারণ করতে হবে। ছত্রাক জাতীয় ওষুধ পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। বাগান অপরিচ্ছন্ন রাখা যাবে না।

ফল ছিদ্রকারী পোকা

লক্ষণ: এ ধরনের পোকা ফল ছিদ্র করে ভেতরের মাংসল অংশ খায়। এতে ফল খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে।

প্রতিকার: নষ্ট ফল বাগান থেকে অপসারণ করতে হবে। কীটনাশক পানিতে মিশিয়ে শেষ বিকালে স্প্রে করে দমন করতে হবে।

শুটিমোল্ড

লক্ষণ: এ রোগের আক্রমণে পাতা, ফল ও কাণ্ডে কালো ময়লা জমে। মিলিবাগ বা সাদা মাছির আক্রমণ এ রোগ ডেকে আনে।

প্রতিকার: আক্রান্ত পাতা ও ডাল ছাঁটাই করে ধ্বংস করতে হবে। মিলিবাগ বা সাদা মাছির আক্রমণ যেহেতু এ রোগ ডেকে আনেÑতাই এদের দমনের জন্য কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। এরপর প্রোপিকোনাজল জাতীয় ছত্রাকনাশক ওষুধ পানির সঙ্গে মিশিয়ে ১৫ দিন পর দুই বার স্প্রে করে নিতে হবে।

করণীয়

ফল সংগ্রহ শেষ হলে গাছের অতিরিক্ত ও মরা ডালপালা, ফলের বোটা, রোগ বা পোকা আক্রান্ত ডালপালা ছাঁটাই করে পরিষ্কার করতে হবে। পরে ছত্রাকনাশক ও কীটনাশক দিয়ে পুরো গাছ ভালোভাবে স্প্রে করে নিন। নিয়মিত বাগান পরিদর্শন করতে হবে ও পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

পরিচর্যা ও ফসল সংগ্রহ

ভালো ফলন ও উন্নতমানের জলপাই পেতে নিয়মিতভাবে পরিচর্যা করতে হবে।

পরিচর্যা

চারা রোপণের পর নিয়মিত পানি ও সার দিতে হবে। তবে অতিরিক্ত সার ও পানি দেওয়া যাবে না। তিন ভাগে বিভক্ত করে গাছের গোড়ায় সার দিতে হবে। প্রথম কিস্তি বর্ষাকালের শুরুতে। দ্বিতীয় কিস্তি বর্ষার শেষে। শেষ কিস্তি শীতের শেষে দেওয়া উত্তম। সারের সঙ্গে মাটি মিশিয়ে গাছের গোড়া থেকে প্রায় দুই থেকে তিন ফুট দূরত্বে ভালোভাবে মিশিয়ে সেচ দিতে হবে। গর্ত করার সময় যে সার ব্যবহার করা হয়েছে তা-ই ব্যবহার করতে হবে।

সেচ ও পানি নিষ্কাশন

শুষ্ক আবহাওয়া ও খরা সহ্য করতে পারে বলে বৃষ্টির পরিমাণ, মাটি ও গাছের বয়সের ওপর ভিত্তি করে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। শীতকালে দেড় মাস ও গরমকালে ২০ দিন পর পর সেচ দেওয়া ভালো। ফল আসার পর কমপক্ষে দুইবার সেচ দিতে হবে। বর্ষা মৌসুমে গাছের গোড়ায় যাতে জলাবদ্ধতা না হয় সেজন্য দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।