জামরুল চাষ করবেন যেভাবে

632

জামরুল ভিটামিন বি-২ সমৃদ্ধ একটি ফল।এ ফলে প্রচুর পরিমাণে পানি থাকায় ডায়াবেটিস রোগীর তৃষ্ণা নিবারণে উপকারী। জামরুলে আমিষ, খনিজ লবণ, ভিটামিন সি, লৌহ ও ক্যারোটিন রয়েছে।

জলাবায়ু : উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু জামরুল চাষের জন্য অধিক উপযোগী। অতি ঠান্ডা বা গরম উভয়ই জামরুল গাছের জন্য ক্ষতি কর।
জাত: বাংলাদেশে তিন ধরনের জামরুল ফল দেখা যায়। ধবধবে সাদা, সবুজাভ সাদা ও গোলাপীলাল বা মেরুন বর্ণের। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারি জামরুল-১ নামে একটি উচ্চ ফলনশীল ও আকর্ষণীয় মেরুন রঙের একটি জাত উদ্ভাবন করেছে। জাতটি সারা দেশে ফল চাষিদের কাছে বেশ সমাদৃত হয়েছে।

বারি জামরুল-১: প্রচুর নিয়মিত ফল উৎপাদনকারী একটি উচ্চ ফলনশীল জাত। গাছ মাঝারি, ঝোপালো ও মধ্যম খাড়া। মধ্য ফান্ডুন থেকে মধ্য চৈত্র মাসে গাছে ফুল আসে। মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত ফল সংগ্রহ করা যায়। ফল চুঙ্গাকৃতি, পাকলে আকর্ষণীয় মেরুন বর্ণ ধারণ করে। ফলের ওজন ৪০ থেকে ৪৫ গ্রাম। ভক্ষণযোগ্য অংশ শতকরা ৯৭ ভাগ। জাতটি সারা দেশে চাষযোগ্য।

বংশ বিস্তার: গুটি কলম ও শাখা কলমের মাধ্যমে বংশ বিস্তার কারা যায়। সাধারণত ফল সংগ্রহের পর গাছে নতুন পাতা গজাতে শুরু করলে কলম করা উচিত। শাখা কলমের জন্য এক বছর বয়সী গাছ নির্বাচন করে মে-জুন মাসে কমল করতে হবে। শাখা কলমের জন্য বর্ষা মৌসুমে ৪ থেকে ৫টি পর্ব সহকারে ডাল কেটে বেডে বা পলিব্যাগে রাখাতে হবে। রোপণকৃত ডাল থেকে নতুন কুঁড়ি বের হলে তা পরবর্তী বছরে মূল জমিতে বা তৈরীকৃত মাদায় রোপণ করতে হবে।

জমি নির্বাচন ও তৈরী: সুনিকাশিত দোঁ-আশ মাটি জামরুল চাষের জন্য বেশি উপযোগী। তবে সব ধরনের মাটিতেই জামরুল চাষ করা যায়। বৃষ্টি পানি জমে না এমন ধরনের উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করতে হবে। চাষ দিয়ে অথবা কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে সমতল ও আগাছামুক্ত করতে হবে।

রোপণ পদ্ধতি: সমতল ভূমিতে বর্গাকারে বা ষড়ভূজী এবং পাহাড়ী এলাকায় কণ্টুর পদ্ধতিতে চারা/ কমল রোপণ করা হয়। মধ্য জ্যৈষ্ঠ থেকে মধ্য শ্রাবণ মাস হলো জামরুলের চারা/ কলম রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে পানি সেচের সুবিধা থাকলে বৈশাখ থেকে মধ্য কার্তিক মাস পর্যন্ত জামরুলের চারা রোপণ করা যায়।

গর্ত তৈরী: কলম রোপণের ১৫ থেকে ২০ দিন পূর্বে ৬ মিটার ী ৬ মিটার দূরত্বে ১ মিটার ী ১মিটার ী ১মিটার আকারের গর্ত করতে হবে। গর্তের ওপরের মাটির সাথে ১৫ থেকে ২০ কেজি জৈব সার, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি ও ১০০ গ্রাম জিপসাম সার ভালভাবে মিশিয়ে গর্তটি ভরাট করে তাতে পানি দিতে হবে।

গর্তে চারা/ কলম রোপণ ও পরিচর্যা:গর্তে সার প্রয়োগের ১০ থেকে ১৫ দিন পর নির্বাচিত কলমটি গর্তের মাঝখানে খাড়াভাবে রোপণ করে প্রয়োজন মতো পানি, খুঁটি ও বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

গাছে সার প্রয়োগ: বৃদ্ধির সাথে সাথে গাছে প্রয়োজনীয় পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে। ১থেকে ৩ বছর বয়সী গাছের জন্য গোবর ১৫-২০ কেজি, ইউরিয়া ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম, টিএসপি ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম ও এমওপি ১০০ থেকে ২০০ গ্রাম। ৪ থেকে ৭ বছর বয়সী গাছের জন্য গোবর ২৫ থেকে ৩০ কেজি, ইউরিয়া ৪০০ থেকে ৬০০ গ্রাম, টিএসপি ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম ও এমওপি ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম, ৮ থেকে ১০ বছর বয়সী গাছের জন্য গোবর ৩৫ থেকে ৪০ কেজি, ইউরিয়া ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম, টিএসপি ৬০০ থেকে ৭০০ গ্রাম ও এমওপি ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রাম এবং ১০ বছরের বেশি বয়সের গাছের জন্য গোবর ৪০ থেকে ৫০ কেজি, ইউরিয়া ৮০০ থেকে ১০০০ গ্রাম, টিএসপি ৮০০ থেকে ১০০ গ্রাম ও এমওপি ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম।

সবটুকু সার দুই ভাগ করে বৈশাখ থেকে মধ্য আষাঢ় ও মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক মাসে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিবার সার দেয়ার পর প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে।

আগাছা দমন: গাছের গোড়া সব সময় আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। সাধারণত বর্ষার শুরুতে ও বর্ষার পর সম্পূর্ণ বাগানে হালকা চাষ দিয়ে আগাছা পরিস্কার করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।

পানি সেচ ও নিষ্কাশন: জামরুলে পানির ভাগ বেশি থাকার কারণে খরা মৌসুমে অবশ্যই পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় পানির অভাবে ফলের আকার ছোট হবে এবং ফল ঝরে পড়তে পারে। সাধারণত খরা মৌসুমে গাছে প্রয়োজন মতো ২ থেকে ৩ বার সেচ দিলে গুণগত মান সম্পন্ন ফল পাওয়া যায়। বর্ষা মৌসুমে প্রয়োজনীয় নালা কেটে গাছের গোড়া থেকে অতিরিক্ত পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
ডাল ছাঁটাইকরণ: রোগও পোকা-মাকড় আক্রান্ত ডালপালা কেটে পরিস্কার করতে হবে। গাছ ছোট অবস্থা থেকেই প্রচুর ডালপালা বিস্তার করে বিধায় প্রথম থেকেই ফল দেওয়া কাংক্সিক্ষত ডালগুলো রেখে অন্যান্য ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। সাধারণত ফল সংগ্রহ করার পর পর ভেঙ্গে যাওয়া ও মরা ডাল কেটে ফেলতে হবে।

ফল পাতলাকরণও ব্যাগিং: জামরুল সাধারণত একই পুষ্পমঞ্জুরীতে অনেকগুলো ফল থাকে বিধায় অপরিপক্ক অবস্থাতেই কিছু ফল ছেঁটে দিতে হবে। প্রতি পুষ্পমঞ্জুরীতে ২ থেকে ৩ টি ফল রাখলে ফলের আকার বড় হয়। পরিপক্ক ফল বেশ আকর্ষণীয় রঙয়ের হওয়ায় ব্যাগিং করে পাখি ও পোকার আক্রমণ রোধ করা যায়।

রোগ বালাই ও পোকা দমন: জামরুল গাছে পোকা-মাকড় ও রোগবালাইয়ের তেমন কোনে উপদ্রব দেখা যায় না। কচি পাতা খেকো পোকার আক্রমণ কদাচিৎ দেখা যায়। এদের দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি সুমিথিয়ন মিশিয়ে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করতে হবে।
ফল সংগ্রহ: ফল পূর্ণতা প্রাপ্তির পর সংগ্রহ করতে হবে। বারি জামরুল-১ এর ফল মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য জ্যৈষ্ঠ মাসে সংগ্রহ করা হয়। পরিপক্ক ফল গাঢ় তামাটে থেকে মেরুন বর্ণ ধারণ করে এবং পরিপুষ্ঠ ও টস টসে হয়। পরিপক্ক ফল হাত অথবা জালিযুক্ত বাঁশের কোটার সাহায্যে সংগ্রহ করা হয়।

ফলন: উপযুক্ত যত্ন নিলে বারি জামরুল-১ চাষে হেক্টর প্রতি ২০ মেট্রিক টন ফলন পাওয়া যায়।

ফার্মসএন্ডফার্মার/ ১২ মে ২০২১