ড্রোনিক এগ্রিকালচার: সম্ভাবনার নতুন সোপান

377

পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, সমানতালে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে মানুষ, কিন্তু খাদ্য উৎপাদন সেই অনুপাতে বাড়ছে না। আবার যতটুকু বাড়ছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে তা অনেকাংশেই বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। জমির উর্বরতা হ্রাস, অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত চাষাবাদ, নিত্য নতুন বালাইয়ের আক্রমণ কৃষির উৎপাদন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।
© জাতিসংঘ বলছে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা দাঁড়াবে দশ বিলিয়নে। এত বিপুল মানুষের খাদ্যের যোগান দিতে এই সময়ের মধ্যে পৃথিবীর কৃষি উৎপাদন অন্তত ৭০ শতাংশ বাড়াতে হবে।

© বিজ্ঞানীরা কিন্তু থেমে নেই, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করতে কৃষিতে নিয়ে এসেছে বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার। এরকমই একটি প্রযুক্তি হচ্ছে, ড্রোনের ব্যবহার, যার মাধ্যমে কৃষির উৎপাদন পরিকল্পনা নেওয়া সহজতর হবে, সময় ও অর্থের সাশ্রয় হবে। আর ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষির সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াকেই “ড্রোনিক এগ্রিকালচার ” নামে অভিহিত করা হচ্ছে ।
© ড্রোনের সফটওয়্যারের মাধ্যমে কোনো জমিতে কী ফসল উৎপাদন করা যায়, তা নিরূপণ করা সম্ভব। আবাদি জমিতে পোকা বা জীবাণু আছে কি-না ড্রোনটি তাও নিরূপণ করতে পারবে। চাষের অযোগ্য কিন্তু সম্ভাবনাময় জমিও চিহ্নিত করতে পারে তাদের ড্রোন।
ড্রোন ব্যহারের সুবিধাঃ

১. মাটি ও জমির তথ্য সংগ্রহঃ

নির্দিষ্ট শস্য উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট ধরনের মাটির প্রয়োজন হয়। কোনো একটি এলাকার মাটি কোন ধরনের শস্য উৎপাদনের উপযোগী সেটা আগে থেকেই জেনে নিতে হয়। কারণ সব মাটিতে সব শস্য জন্মায় না।

© জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মাটির উপাদানেও প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে। আজ যে মাটিতে ধান জন্মাচ্ছে, আগামী কয়েকবছর পর হয়তো একই জমিতে একই পরিমাণ ধানের উৎপাদন না-ও হতে পারে। এমন পরস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য মাটি পরীক্ষা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। মাটির উপাদানের পরিবর্তন ড্রোনের মাধ্যমেই বুঝতে পারা যাবে, যদি এই প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়।
© মাটির আর্দ্রতা নির্ণয়, বিভিন্ন উপাদানের উপস্থিতি যাচাই, জমির পরিমাণ অনুসারে শস্য রোপনের ডিজাইনও ড্রোন করতে পারবে। অনেক সময় বড় আকারের জমিতে শস্য রোপণের সময় প্রচুর জায়গার অপচয় হয়, কিন্তু ড্রোনের মাধ্যমে আগে থেকেই যদি কোথায়, কীভাবে, কী পরিমাণ রোপণ করা হবে সেটা হিসেব করে নেওয়া যায়, তবে জায়গার অপচয় কমানো সম্ভব।
২. রোপণঃ

জমি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহের পর বীজ রোপণেও ড্রোনের ব্যবহার রয়েছে। চীন এবং জাপানে ইতোমধ্যে বিশেষ ড্রোনের ব্যবহার রয়েছে, যেগুলো মাটির একটু উপর থেকে বীজ রোপণ করতে পারে। সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য ড্রোনের মাধ্যমে বড় আকারের জমিতে অল্প সময়ের ভেতরই বীজ রোপণ করা সম্ভব হবে, যেখানে বর্তমানে প্রচুর সময় এবং লোকবলের প্রয়োজন হচ্ছে। বর্তমানে বীজ রোপণের প্যাটার্ন ঠিক রেখে ড্রোনগুলো ৭০ শতাংশের বেশি বীজ নির্ভূল জায়গায় রোপণ করতে সক্ষম।
৩. পর্যবেক্ষণ এবং স্প্রেঃ

কোনো শস্য উৎপাদনে একটা বড় সময়জুড়ে শস্যগুলোকে প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করতে হয়। কারণ কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন ব্যবস্থাকে ব্যহত হয়ে যেতে পারে, যদি জমিতে বিভিন্ন পোকার আক্রমণ ঘটে এবং শস্য সেগুলোর মাধ্যমে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। বর্তমানে যেসব প্রযুক্তি এবং কৃষি যন্ত্র ব্যবহৃত হয় সেগুলো মূলত বড় পরিসরে পর্যবেক্ষণের জন্য যথেষ্ট নয়।
© ড্রোনে ব্যবহৃত ক্যামেরার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সহজেই কোনো নির্দিষ্ট পোকার আক্রমণ ঘটেছে কি না, কোন অংশে কী পরিমাণ শস্য আক্রমণের শিকার সেটা জানা যায়।
৪. সেচ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাঃ

ড্রোনে ব্যবহৃত থার্মাল প্রযুক্তি ফসলি জমির সবদিক থেকে মাটির তাপমাত্রার তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম। যেসব তথ্য বিশ্লেষণ করে কোনো স্থানের মাটিতে পানির ঘাটতি থাকলে সেটা জানা যাবে, সেই সাথে পানির উপস্থিতির ভিত্তিতে শস্যগুলো সঠিক পরিমাণে পানি গ্রহণ করছে কি না সেটাও বুঝতে পারা যাবে। এতে করে পরবর্তী সময়গুলোতে পানির অপচয় রোধ হবে অনেকাংশে, অতিরিক্ত পানি গ্রহণের কারণে ফসলেরও ক্ষতি হবে না আর।
৫. বালাইয়ের উপস্থিতি সনাক্তকরণঃ

দৃশ্যমান আলো এবং ইনফ্রারেড প্রযুক্তির কল্যাণে আলাদাভাবে প্রতিটি গাছ ও শস্যে ব্যাকটেরিয়া কিংবা ফাঙ্গাস আক্রমণের উপস্থিতি জানা যাবে। তখন কৃষক চাইলে নিজেই আলাদাভাবে সেই নির্দিষ্ট শস্যের দিকে নজর দিতে পারেন কিংবা ড্রোনকেই দায়িত্ব দিতে পারেন! এতে ফসলের বৃদ্ধির সময়টা জুড়ে পুরোপুরি আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে এবং কৃষকও কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে তুলতে পারবেন।
® সম্ভাবনাময় টেকসই বাণিজ্যিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে যান্ত্রিকীকরণের বিকল্প নাই, এরকমই এক নব দিগন্তের সোপান হচ্ছে এই ড্রোনিক এগ্রিকালচার বা ড্রোনিক কৃষি। বিশ্বের উন্নত দেশের মত বাংলাদেশেও কৃষিতে ড্রোন ব্যবহারের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। আমরা আশা করি, যা আজ অবাস্তব, অলীক কল্পনা বিলাস মনে হলেও, সেটাই আগামীকাল ধ্রুব তারার মত দেদীপ্যমান হয়ে কৃষি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। সেই সোনালি সুন্দর সবুজ বিপ্লবের প্রত্যাশায় শুভযাত্রা হোক ” ড্রোনিক এগ্রিকালচার ” এর।

*** তথ্যসূত্রঃ পত্রিকা, ব্লগ, গণমাধ্যমে প্রকাশিত নিউজ।

ফার্মসএন্ডফার্মার/১২অক্টোবর২০