তারা বাইম মাছের কৃত্রিম প্রজনন এবং চাষ পদ্ধতি

5368

তারা-বা্মি-002
তারা বাইম একটি বিলুপ্ত প্রায় মাছ। তারা বাইম বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল ও মায়ানমারে পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের নদ-নদী, খাল-বিল, ডোবা, পুকুর, দিঘি এবং প্লাবন ভূমিতে ছোট দেশিয় প্রজাতির মাছ প্রাকৃতিকভাবেই প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। কালের পরিক্রমায় বিরূপ প্রকৃতি আর প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর মানুষের অত্যাচার, জুলুমের ফলে আমাদের সমৃদ্ধ মৎস্য ভান্ডার এখন কিংবদন্তিতে রূপ নিতে যাচ্ছে। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে জলজ পরিবেশের বিপর্যয়, নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের ব্যবহার, ডুবন্ত জলজ উদ্ভিদ ও শ্যাওলা কমে যাওয়ার কারণেও এখন এ মাছটি বিলুপ্তির পথে।

তারা বাইম মাছের প্রণোদিত প্রজনন

ব্রুড ব্যবস্থাপনা:

তারাবাইম মাছের প্রণোদিত প্রজননের ক্ষেত্রে ব্রুড মাছ (মা ও বাবা মাছ) ব্যবস্থাপনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ছোট বড় যে কোন পুকুরেই ব্রুড মাছ লালন করা যেতে পারে। তবে সাধারণত ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পুকুরেই লালন করা ভাল।বাইম-পোনা
পুকুর প্রস্তুতি

আলো বাতাস পর্যাপ্ত আছে এরূপ স্থানে পুকুর নির্বাচন করতে হবে। পুকুর হতে হবে কাদামুক্ত। পুকুরের উপর কোন গাছপালা না থাকাই ভাল। মাছ যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে যে জন্য পুকুরের ভিতরের চারিদিক ঘন বাঁশের বানা দিয়ে বেড়া দিতে হবে। পুকুরের পাড়ে যেন কোন গর্ত বা ছিদ্র না থাকে সে দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। পুকুর পুরাতন হলে তলদেশ কমপক্ষে ১৫ দিন শুকনা অবস্থায় রৌদ্র লাগাতে হবে। প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন গুলে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। শতাংশে ৬/৭ কেজি হারে পচা গোবর সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। তারপর পুকুরে বৃষ্টি অথবা পাম্পের সাহায্যে ৪/৫ ফুট আয়রন মুক্ত পানি দিয়ে ভর্তি করতে হবে। পানি দেয়ার পর প্রতি শতাংশে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ১০ গ্রাম পটাশ সার এক সঙ্গে মিশিয়ে পানিতে গুলে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।

এভাবে সার দেবার পর পানি সবুজ বা বাদামি রং ধারণ করার পর প্রতি শতাংশে ৫০-৮০টি কমপক্ষে ১ বছর বয়সের ১৫-২৫ সে. মি. সাইজের তারাবাইম মাছ মজুদ করতে হবে। মাছ মজুদ করার পর সরিষার খৈল, অটোচালের কুড়া, আটারভুষি, ফিসমিল, ভিটামিন প্রি-মিক্স ও ডাই ক্যালসিয়াম ফসফেট (২০:৩৩:২৫:২০:১:১) অনুপাতে মিশিয়ে মাছের ওজনের ৪-৫% হারে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ও ভোরে খাবার প্রয়োগ করতে হবে। খাবার মাটির প্লেট অথবা ট্রেতেও দেয়া যেতে পারে। তাছাড়া বাজারের ৩০% প্রোটিন সমৃদ্ধ প্যাকেজ ফিড্ও দেয়া যেতে পারে। এভাবে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ ও পরিচর্যার মাধ্যমে তারাবাইম (পুরুষ ও স্ত্রী) মাছ ৩-৫ মাসের মধ্যে প্রজননক্ষম ও পরিপক্ক হয়ে থাকে।

এরা রাতে ও ভোরে খাবার খায়। দিনের বেলায় নিজেদের এরা গর্তে আবর্জনার নিচে ডুবন্ত উদ্ভিদের নিচে লুকিয়ে (hide habits) রাখে। এজন্য এদের আশ্রয়ের জন্য পুকুরে মাটির ভাংগা চাড়ি, ছোট ছোট বাঁশের পুল, প্লাস্টিক পাইপ ইত্যাদি দিয়ে রাখতে হবে।

তারা বাইম মাছ প্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় পুরুষ ও স্ত্রী চেনা কষ্টসাধ্য। তবে একই বয়সের স্ত্রী মাছ পুরুষ মাছ অপেক্ষা একটু বড় হয়ে থাকে। প্রজনন মৌসুমে পরিপক্ক স্ত্রী মাছে পেট বড় নরম ও ওভারি গোলাকার নীলাভ বর্ণের হয়ে থাকে এবং পুরুষ মাছের পেট সমান শক্ত লম্বাটে ও চাপ দিলে বিন্দু বিন্দু সাদা শুক্র (Sperm) বের হয়ে থাকে প্রজননের জন্য সাধারণত ১৫-২০ সে.মি. সাইজের অথবা ১৫-২৫ গ্রাম ওজনের মাছ ব্যবহার করাই ভালো।

বা্মি
তারা বাইম মাছের কৃত্রিম প্রজনন

উন্নত ব্রুড ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছ প্রজননের জন্য পরিপক্ক হলে প্রণোদিত প্রজননের জন্য ২টি পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। চাপ পদ্ধতি ও কচুরিপানা ব্যবহারের মাধ্যমে প্রজনন পদ্ধতি।

চাপ পদ্ধতি:

প্রথমে ব্রড মাছের পুকুর থেকে পরিপক্ক প্রজননক্ষম স্ত্রী ও পুরুষ নির্বাচন পূর্বক হ্যাচারিতে ঝর্ণার সাওয়ারের পানিতে ৮-/১০ ঘণ্টা রেখে খাপ খাওয়ানোর পর (Adaptation) প্রথমে স্ত্রী মাছকে পিজি (পিটুইটারি গ্ল্যান্ড) ৪০ মি. গ্রাম/কেজি ডোজ দিয়ে ৬ ঘণ্টা ব্যবধানে ২য় মাত্রা ৫০ মি.গ্রাম/কেজি প্রয়োগ পূর্বক পুরুষ মাছকে একক মাত্রায় ৪০ মি.গ্রাম/কেজি দিয়ে সিসর্টানে ঝর্ণার নিচে রাখতে হবে।

দ্বিতীয় ডোজের ৭-৮ ঘণ্টা পর (২৭-৩৩০ সে. তাপমাত্রায়) মাছ যখন কোর্টশিপ আচরণে জোড়ায় জোড়ায় দৌড়াদৌড়ি করতে থাকবে, আলিঙ্গন করতে থাকবে, তখন স্ত্রী মাছকে নরম টাওয়েল দিয়ে ধরে চাপ পদ্ধতিতে ছোট প্লেটে ডিম সংগ্রহ পূর্বক পুরুষ মাছ হতে একই নিয়মে শুক্রানু বের করে পালকের সাহায্যে মিশিয়ে ডিমকে নিষিক্ত পূর্বক ট্রেতে ছড়িয়ে দিতে হবে। নিষিক্ত ডিম গুলোকে ট্রেতে রেখে পাইপ লাইনে ফোঁটা ফোঁটা পানি সরবরাহ পূর্বক এরেশন দিয়ে রাখতে হবে। ট্রেতে পানির গভীরতা হবে ১০-১২ সে.মি. এবং পানি হতে হবে সর্ম্পূণ আয়রন মুক্ত। এভাবে ২০-৩৩০ সে. তাপমাত্রায় ৩৬-৪০ ঘন্টা পর ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হয়। প্রজননের জন্য মে-জুন হচ্ছে উৎকৃষ্ট সময়। তবে তারাবাইমের মে থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রজনন মৌসুম।

কচুরিপানায় প্রজনন পদ্ধতি:

চাপ পদ্ধতির মত একই নিয়মে পিজি ১ম ও ২য় মাত্রা প্রয়োগপূর্বক প্রভাবক হিসাবে পরিষ্কার কচুরিপানাযুক্ত হাপার পানিতে রেখে ঝর্ণার সাওয়ারে ৮-১০ ঘণ্টা পর স্ত্রী মাছ ডিম ছাড়ার পর পুরুষ মাছ শুক্রানু ছাড়ার মাধ্যমে নিষিক্ত করে থাকে। এই পদ্ধতিতেও ৩৬-৪০ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফোটা শুরু হয়। ডিম ফোটা শেষ হলে কচুরিপানা গুলো হাপা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।

এই পদ্ধতিতে পোনা মৃত্যু হার কম, স্বাস্থ্য ভাল থাকে ও বৃদ্ধি হারও বেশি। তারাবাইমের ডিম আঠালো। আঠালো ডিম কচুরিপানার শিখরে লেগে থাকে। ডিম গুলো দেখতে গোলাকার ও সবুজ রংয়ের হয়ে থাকে।

লার্ভাল অবস্থায় লালন

ডিম্বথলি সম্পূর্ণ মিশে যাবার পর প্রাথমিক অবস্থায় খাদ্য হিসাবে সিদ্ধ ডিমের কুসুম, ফিস ফ্ল্যাশ, জুপ্লাঙ্কটন দিতে হবে। কেবল মাত্র প্লাংটন দিয়েই রেণু কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। তবে এ অবস্থায় রেণুর দ্রুত বাড়ার জন্য টিউবিফেক্স খুবই উপযুক্ত খাদ্য।

এ অবস্থায় রেণু পোনা ফাংগাস ও ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। এ জন্য ট্রেতে এবং হাপায় রেণু পোনা লালনের ক্ষেত্রে দিনে কমপক্ষে ২ বার মেথিলিন ব্লু ব্যবহার করতে হবে। একটি কথা মনে রাখতে হবে যদি এ অবস্থায় ফাংগাস বা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং উপযুক্ত খাদ্যের অভাব হয় তখন পোনা মৃত্যু হার হয় খুব বেশি।

ছোট বেলা থেকেই এরা নিজেদের লুকিয়ে রাখে বিশেষ করে দিনের বেলায়। সে জন্য ভাংগা মাটির চাড়ির টুকরা ট্রেতে ও হাপায় জলজ উদ্ভিদ পটাশ পানিতে ভাল করে ধুয়ে দিয়ে রাখতে হবে।

নার্সারি পুকুর ব্যবস্থাপনা

তারা বাইম চাষের পুকুরে মজুদের আগে নার্সারি পুকুরে লালন করে নেয়া ভালো। নার্সারি পুকুর হবে ৮-১০ শতাংশ। পানির গভীরতা তবে ৩-৪ ফুট। পুকুরের তলদেশ হতে হবে কাদামুক্ত। পুকুর শুকিয়ে তলদেশে কমপক্ষে ১০-১৫ দিন রৌদ্র লাগিয়ে শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। চুন প্রয়োগের পর শতাংশ প্রতি ৫ কেজি পঁচা গোবর ছিটিয়ে দিতে হবে। তারপর পানি দিয়ে শতাংশ প্রতি ইউরিয়া ১০০ গ্রাম, টিএসপি ৫০ গ্রাম ও পটাশ ১০ গ্রাম একত্রে মিশিয়ে পানিতে গুলে সমস্ত পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুরটি ভিতরের দিকে ঘন বাঁশের বানা দিয়ে বেড়া দিতে হবে যাতে পোনা ছিদ্র বা গর্ত দিয়ে বের হয়ে যেতে না পারে। এভাবে ৭/৮ দিন পর পানি সবুজ বর্ণ হলে শতাংশ প্রতি ১০ মিলি সুমিথিয়ন প্রয়োগ করে ২৪ ঘন্টা পর রেণু পোনা মজুদ করতে হবে। রেণু পোনা মজুদের পর প্রতিদিন সন্ধ্যায় ও ভোরে শরীরের ওজনের ২০-২৫% হারে নার্সারি খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। এ অবস্থায় নিয়মিত মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।

মজুদ পুকুর ব্যবস্থাপনা

তারাবাইম ছোট বড় সব ধরনের পুকুরে চাষ করা যায়। তবে ১০-২০ শতাংশ পুকুরেই চাষের জন্য ভাল। পানির গভীরতা হবে ৪-৫ ফুট। পুকুর প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা নার্সারী এবং ব্রুড মাছের পুকুরের মতই। তবে খেয়াল রাখতে হবে পুকুরের পাড়ে যেন ইদুরের বা কাঁকড়ার কোন গর্ত না থাকে। তারাবাইম মাছ পুকুরে একক ও মিশ্র পদ্ধতিতে চাষ করা যায়। একক চাষ পদ্ধতিতে শতাংশ প্রতি ৭০০-৮০০টি ও মিশ্র চাষ পদ্ধতিতে ৮০-১০০টি ১.১/২-২৴৴ সাইজের পোনা মজুদ করা যেতে পারে। সার হিসাবে গোবর, মুরগির বিষ্ঠা ও খাদ্য হিসাবে ৩০% আমিষযুক্ত সম্পুরক খাদ্য ব্যবহার করতে হবে। উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় মাছ ৬ মাসে বাজারে বিক্রি উপযোগী হয়। সূত্র: নেট থেকে সংগৃহিত।