তীব্র দাবদাহে আমের রাজ্যে চিন্তার ভাঁজ

18

রাজশাহীর আমচাষিরা এবার তীব্র উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এ বছরের অস্বাভাবিক তাপমাত্রা আম ফলনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। বৃষ্টির অভাবে ফলনের মান এবং পরিমাণ দুই-ই কমছে। এই অবস্থা চাষিদের আর্থিক দুর্দশা বাড়াচ্ছে। পানির সংকট তাদের চিন্তাকে আরও গভীর করেছে। বাজারে আমের দাম এখন অনিশ্চিত। চাষিরা তাদের পরিশ্রমের যথাযথ মূল্য পাবেন কি না, তা নিয়ে চিন্তিত।

বৈশাখের আবির্ভাব হলেও বরেন্দ্র অঞ্চলের মাঠজুড়ে দেখা মেলেনি কালো মেঘ আর ঝড়-বৃষ্টির। তবে এবার বৃষ্টির অভাবে খরতাপে এখন পুড়ছে পুরো অঞ্চল। চলমান তীব্র তাপপ্রবাহের প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের আমের রাজ্য হিসাবে পরিচিত রাজশাহীর আম বাগানগুলোয়। তীব্র তাপে পুড়ছে আমের মুকুল, বিপর্যস্ত হচ্ছে জনজীবন। তাছাড়া চলতি মৌসুমে রাজশাহীর আম বাগানগুলোয় তুলনামূলকভাবে কম মুকুল আসায় চিন্তা বেড়েছে বাগান মালিকদের।

এবার রাজশাহীতে বৃষ্টিহীনতার পাশাপাশি নামতেই চাইছে না তাপমাত্রা। তীব্র খরার সঙ্গে যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গরমও। একদিকে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অন্যদিকে বৃষ্টিহীনতার কারণে শুকাতে শুরু করেছে আমের বোঁটার রস। এতে ঝরতে শুরু করেছে আমের গুটি। আমের গুটি ঝরার সঙ্গে সঙ্গে যেন ঝরে পড়ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের আমচাষিদের স্বপ্ন।

আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের দাবি, এরই মধ্যে অনেক বাগানে প্রায় ৩০ ভাগ আমের গুটি ঝরে গেছে। রাজশাহীর ৯টি উপজেলার আম বাগানগুলোয় মুকুল এসেছিল চাহিদার তুলনায় অনেক কম। এরপর আবার গত কয়েক দিনের তীব্র দাবদাহে বোঁটা শুকিয়ে ঝরে যাচ্ছে গুটি। পানির সেচসহ নানা পদ্ধতি অবলম্বন করেও ঠেকানো যাচ্ছে না আমের গুটি ঝরা।

কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তর জানায়, গত মৌসুমে জেলার ১৯ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমি থেকে আম চাষিদের আয় হয়েছিল এক হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। এবার জেলার ৯ উপজেলায় ১৯ হাজার ৬০২ হেক্টর জমিতে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ৬০ হাজার ১৬৪ টন।

বাঘা উপজেলার মনিগ্রাম এলাকার আমচাষি আব্দুল জব্বার বলেন, গত বছরের চেয়ে এবার মুকুলের সংখ্যা কম হলেও প্রায় সবগুলোতেই গুটি বাঁধছে। তবে বৃষ্টি না হওয়ার কারণে গুটি ঝরে যাচ্ছে। সেচ দিয়ে ঝরে পড়া রোধ করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে বৃষ্টি না হওয়ার কারণে এবার আমের আকার বেশ ছোট হবে, সেই সঙ্গে আমের উৎপাদনও কমে আসবে। মৌসুমের শুরু থেকেই আমের দাম বেশ চড়া থাকবে। কেননা গাছে তো আম নেই।

আমের চাষ একটি প্রধান কৃষি কার্যক্রম। এই এলাকা বিশেষ করে আমের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু সম্প্রতি তীব্র তাপমাত্রায় আমের ফলন ও গুণগত মানের ওপর বিপুল প্রভাব পড়ছে। এ বিষয়ে কৃষক আব্দুল হান্নানের চিন্তা ও উদ্বেগ স্পষ্ট।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার আমচাষি আব্দুল হান্নান বলেন, এই বছর তাপমাত্রা অনেক বেশি বেড়ে গেছে, যা আমাদের আমের বাগানে বিশেষ করে ফলনে খুব খারাপ প্রভাব ফেলেছে। ফুল ঝরে যাচ্ছে এবং ফলের আকার আগের চেয়ে ছোট হয়েছে।

তাপমাত্রার বৃদ্ধি আমের পাকার প্রক্রিয়াকেও অস্বাভাবিক করে তুলেছে, যা আমের স্বাদ ও মানের ওপর নেগেটিভ প্রভাব ফেলেছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা কী করব, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক চিন্তা ও উদ্বেগ রয়েছে। পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ এবং ছায়া দেয়া নিয়ে আমরা চেষ্টা করছি, কিন্তু এসবের পরেও ফলন আগের মতো হচ্ছে না। তিনি সরকার ও কৃষি গবেষণা সংস্থাগুলোর কাছে আরও গবেষণা ও সহায়তা চেয়েছেন, যাতে তারা তাপমাত্রা সহনশীল আমের জাত উন্নয়ন করতে পারে এবং কৃষকদের জন্য কৃষি কৌশল ও প্রযুক্তি প্রদান করতে পারে।

নগরীর খড়খড়ির আমচাষি সাজ্জাদ হোসেন বলেন, তীব্র খরায় আমের বোঁটার রস শুকিয়ে হলুদ আকার ধারণ করে ঝরে পড়ছে। মৌসুমের শুরুর দিকে বেশ ভালো মুকুল এলেও ঘন কুয়াশা ও হালকা বৃষ্টিতে প্রথম দফায় মুকুলের ক্ষতি হয়। এরপর যে খরা চলছে, এতে করে গাছে আম ধরে রাখাই কষ্টকর।

রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ারা জানান, গত ১৭ এপ্রিল জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার জেলায় ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এর আগে গত শুক্রবার ৪০ দশমিক শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। শনিবার রাজশাহীতে চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর আজ রোববার ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এদিন সকালে বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯৭ শতাংশ।

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, গত বছর আমের অন ইয়ার থাকলেও এবার অফ ইয়ার। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমের ফলন কমবে। তবে প্রতিকূল আবহাওয়ায় কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হবে। আর তাপমাত্রার এই বৃদ্ধি যে কেবল ফলনের ক্ষতি করছে তা নয়, বরং কৃষকদের আয়ের উপরেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। অনেক কৃষকের জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এই পরিবর্তনের কারণে বিপদের মুখে পড়ছে।

রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোছা. উম্মে সালমা বলেন, সব উপজেলায় খরা মোকাবিলায় আমের গুটি টিকিয়ে রাখতে চাষিদের পরামর্শ দিতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।