ন্যচারাল পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণ

2147

পর্ব-১
গরু মোটাতাজা করবেন কীভাবে
গরু মোটাতাজাকরণ মূলত বিশেষ খাদ্যতালিকা ও অন্যান্য ব্যবস্থা অনুসরণ করে তুলনামূলক অল্প সময়ে গরুর শরীরে মাংস বৃদ্ধি করার একটি পদ্ধতি।

১. গরু মোটাতাজাকরণের বিভিন্ন ধাপের বর্ণনা

গরু মোটাতাজা করবেন কীভাবে
গরু মোটাতাজাকরণ মূলত বিশেষ খাদ্যতালিকা ও অন্যান্য ব্যবস্থা অনুসরণ করে তুলনামূলক অল্প সময়ে গরুর শরীরে মাংস বৃদ্ধি করার একটি পদ্ধতি। এভাবে পালন করা গরু বাজারে বিক্রি হয় কেবলমাত্র মাংস খাওয়ার জন্য। চাষবাস বা অন্য কোনো কাজ এদেরকে দিয়ে সম্ভব না। একটি গরুকে ৩-৪ মাস মোটাতাজা করার পর বিক্রি করে দেওয়া উচিত নয়তো লাভের পরিমাণ কমে যায়।

গরু মোটাতাজা করতে হলে যেসব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হয়:
১. গরু নির্বাচন ও প্রাথমিক করণীয়
২. গোয়ালঘর
৩.খাদ্য
৪.পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
৫.পরিশ্রম।
১.গরু নির্বাচন ও প্রাথমিক করণীয়
মোটাতাজা করতে হলে প্রথমে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো দেখে গরু নির্বাচন করতে হয়:
যক্ষ্মা বা অন্যান্য মারাত্মক রোগমুক্ত হতে হবে
পা ও গলা লম্বা হবে
দুই দাঁতের গরু হবে, বলদ বা এঁড়ে বাছুর হলে ভাল হয় তবে যে কোনো স্বাস্থ্যহীন গরু বাজার থেকে অল্প দামে কেনা যায়। এর বেশী দাঁতের গরুর বাড় তেমন হয় না বলে মোটাতাজা করার চেষ্টা করে তেমন লাভ হয় না।
গায়ের চামড়া ঢিলা হবে যেন পরবর্তীকালে শরীরে মাংস বাড়লে সমস্যা না হয়
হাড়ের গঠন মোটা ও পাঁজরের হাড় যেন চ্যাপ্টা হয়

গরু নির্বাচনের পর প্রাথমিক করণীয়
গরুটিকে অবশ্যই কৃমিমুক্ত করে নিতে হবে। কাছাকাছি পশু চিকিৎসককে দিয়ে গরুর গোবর পরীক্ষা করাতে হবে। যদি কৃমি পাওয়া যায় তবে তিনি যা বলেন তা করতে হবে।
শরীরের চামড়ার এঁটুলি বা আঠালি দূর করতে হবে। কম থাকলে হাতেই মারা যায় আর যদি অনেক বেশী এঁটুলি থাকে তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
প্রতি ১৫ দিন পর পর গোবর পরীক্ষা করে দেখতে হবে কৃমি হয়েছে কিনা।
ক্ষুরারোগ, তড়কা, বাদলা ও গলাফুলা রোগের টিকা নেওয়া না থাকলে টিকা দিতে হবে।
গরুর ওজন নিতে হবে।

গরুর ওজন নেওয়ার পদ্ধতি
গরুর ওজন বের করতে হলে প্রথমে এর দৈর্ঘ্য এবং বুকের বেড় মেপে নিতে হয়। এক্ষেত্রে দৈর্ঘ্য বলতে গরুর শিঙের গোড়া থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত দৈর্ঘ্যকে বোঝায়। এরপর নীচের গাণিতিক নিয়মে ওজন বের করা হয়:
গরুর ওজন (কেজিতে) = [বুকের বেড়ের বর্গ (ইঞ্চি) X গরুর দৈর্ঘ্য (ইঞ্চি)] / ৬৬০
[বুকের বেড়ের বর্গ এবং গরুর দৈর্ঘ্য গুণ করে সেই গুণফলকে ৬৬০ দিয়ে ভাগ]
ওজনের ভিত্তিতেই গরুর উপযুক্ত খাবার তালিকা তৈরী করতে হয়। মোটাতাজাকরণের জন্য যে গরু তার ওজন ১৫ দিন পর পর নিতে হয়। এতে করে গরুর শরীরে মাংস বৃদ্ধির হার বোঝা যায়।গরু মোটাতাজা করবেন কীভাবে

পর্ব-২
২.গোয়ালঘর
আমাদের দেশে গোয়ালঘর সাধারণত এক বা দুই সারির হয়ে থাকে। যাঁরা একটি-দু’টি গরু পালন করেন তাঁরা সাধারণত একসারি আর যাঁরা অনেক গরু পালেন তাঁরা দুই সারি গোয়ালঘর বানিয়ে থাকেন।
একসারি বিশিষ্ট একটি পরিচ্ছন্ন গোয়ালঘর। এতে পাঁচ-ছটি গরু রাখা যাবে। আমাদের দেশে এ ধরনের গোয়ালঘর প্রায়ই দেখা যায়। ছবিটি বাগেরহাটের মোংলা থেকে তোলা।
দুই সারি বিশিষ্ট গোয়ালের ঘরগুলো পরস্পর মুখোমুখি হয়। তবে ঘরগুলোর মুখ কোন দিকে থাকবে অর্থাৎ কোন দিকে খোলা থাকবে তার ওপর নির্ভর করে দুই সারি বিশিষ্ট গোয়াল সাধারণত দুই ধরনের হয়:
অন্তর্মুখী সারি বিশিষ্ট – এ ধরনের গোয়ালে গরুগুলো পরস্পর মুখোমুখি থাকে। দুই সারি ঘরের মাঝে যাতায়াতের জায়গা থাকে।
অন্তর্মুখী সারি বিশিষ্ট গোয়ালঘর
বর্হিমুখী সারি বিশিষ্ট – এ ধরনের গোয়ালে গরুগুলো পরস্পরের দিকে পেছন ফিরে থাকে। একেক সারির খোলা অংশের সামনে দিয়ে যাতায়াতের জন্য জায়গা থাকে।
বহির্মুখী গোয়ালঘর (খালি অবস্থায়)

বহির্মুখী গোয়ালঘর
গোয়াল এক সারির বা দুই সারির যাই হোক না কেন এটিকে গরুর জন্য আরামদায়ক ও স্বাস্থ্যসম্মত করে তুলতে হলে নীচের বিষয়গুলোর দিকে

খেয়াল রাখা জরুরী:
পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা ও উত্তর-দক্ষিণে প্রস্থ করে বানানো।
ঘরে পানি ও আলোর যাতায়াতের সুব্যবস্থা রাখা।
ঘরের মেঝে পাকা হবে তবে পিচ্ছিল হবে না
মেঝে একদিক থেকে ঢালু থাকবে যাতে পানি সহজে নালায় চলে যায়।
ঘরের দৈর্ঘ্য গরু প্রতি ৩.৫-৪ ফুট জায়গা ধরে করতে হবে।
ঘরের প্রস্থ এক সারি ঘর ১১-১২ ফুট ও দুই সারি ঘর ২০ ফুট হবে।
একচালা ঘরের উচ্চতা মেঝে থেকে কমপক্ষে ৭ ফুট করা উচিত। দোচালা ঘর হলে টিন বা চালা দুটি যেখানে মিলবে তা মেঝে থেকে সর্বনিম্ন ১৪ ফুট এবং চালার বিপরীত প্রান্ত মেঝে থেকে সর্বনিম্ন ৭ ফুট উঁচু হবে।
ঘরের সামনে দিয়ে যাতায়াত পথটি ৪ ফুট চওড়া হওয়া উচিত।
খাবার দেওয়ার জায়গা বা চাড়িটি ২ ফুট বাই ২ ফুট করা উচিত।
তরল বর্জ্য যাওয়ার নর্দমা ১ ফুট চওড়া হওয়া উচিত।

৩.খাবার
মোটাতাজা করার উদ্দেশ্যে যে গরু পালন করা হয় তার জন্য একটি নির্দিষ্ট খাদ্যতালিকা মেনে চলা উচিত। এক্ষেত্রে প্রথম কথা, গরুর ওজন অনুযায়ী তাকে খাদ্য দিতে হবে।
এ ধরনের গরুকে তিন ধরনের খাবার দিতে হয়:
ইউরিয়া-মোলাসেস খড়: পরিমাণমতো ইউরিয়া সার, চিটাগুড়, খড় ও পানি মিশিয়ে তৈরী হয়।
দানাদার খাদ্য: গম, চালের খুদ, ভুষি ইত্যাদি দানা জাতীয় খাদ্য।
কাঁচা ঘাস: কাঁচা ঘাস ছাড়াও শাক-পাতা জাতীয় খাবারও এর মধ্যে পড়বে।
ওজন অনুযায়ী গরুর দৈনিক খাদ্যতালিকা
গরুর ওজন (কেজি)
ইউরিয়া-মোলাসেস খড় (কেজি)
দানাদার খাদ্য
(কেজি)
কাঁচা ঘাস
(কেজি)
৫০ ০.৫ ১.২৫ ২
৭৫ ১ ২ ৩
১০০ ১.৫ ৩ ৪
১৫০ ২ ৩.৫ ৫
২০০ ৩ ৪ ৬
২৫০ ৩.৫ ৪.৫ ৭

খাবার তৈরীর পদ্ধতি
ইউরিয়া-মোলাসেস খড়: এই খাবারে ইউরিয়ার পরিমাণ ঠিক রাখা অত্যন্ত জরুরী। পরিমাণের চেয়ে বেশী ইউরিয়া খাওয়ালে গরুর শরীরে বিষক্রিয়া ঘটতে পারে।
ইউরিয়া-মোলাসেস খড় কীভাবে বানাবেন: এই খাবারটি বানানোর দু’টি পদ্ধতি এখানে আলোচনা করা হলো। প্রথম পদ্ধতিতে ইউরিয়া-মোলাসেস খড় বানিয়ে ৭ দিন পরে গরুকে খাওয়ানো হয়। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে ইউরিয়া-মোলাসেস খড় বানিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই গরুকে খাওয়ানো যায়।
প্রথম পদ্ধতি (৭ দিন পরে খাওয়ানোর উপযোগী): প্রথমে ডালির নীচে একটি বড় পলিথিন বিছিয়ে নিতে হবে। ১০ কেজি শুকনা খড় পলিথিনের ওপর বিছাতে হবে। এরপর ১০ লিটার পানিতে ৪০০ গ্রাম ইউরিয়া ভালভাবে মিশিয়ে খড়ের ওপর ছিটাতে হবে। পানি ছিটানো শেষে পা দিয়ে ভালভাবে খড়গুলো মাড়িয়ে নিতে হবে যাতে করে পানি খুব ভালভাবে খড়ের মধ্যে ঢুকে যায়। তারপর পলিথিনের প্রান্ত এমনভাবে গুটিয়ে খড়গুলোকে বাঁধতে হবে যাতে করে ভেতরে বাতাস না থাকে। বায়ুশূন্য অবস্থায় এভাবে ৭ দিন রাখার পর এই খড় গরুকে খাওয়াতে হবে।
এই পদ্ধতিতে প্রতি ১০০ কেজি খড়ের সঙ্গে পানি, চিটাগুড় ও ইউরিয়া যেভাবে মেশাবেন:
খড় (কেজিপ্রতি)
পানি (লিটারপ্রতি)
চিটাগুড় (কেজিপ্রতি)
ইউরিয়া (কেজিপ্রতি)
১০০ ৫০-৭০ ২০-২৪ ৩

দ্বিতীয় পদ্ধতি (সঙ্গে সঙ্গে খাওয়ানোর উপযোগী): এক্ষেত্রে প্রতি ১৫ দিনে ইউরিয়ার পরিমাণ কিছু কিছু করে বাড়ানো হয় তবে বাকি উপকরণের পরিমাণ একই থাকে। গরুকে প্রথম ১৫ দিন ৫ গ্রাম (বা ১ চা চামচ) ইউরিয়া ২০০ মিলি চিটাগুড় ও দেড় থেকে দুই লিটার পানির সঙ্গে মিশিয়ে টুকরা করা খড় দিয়ে খাওয়ানো যায়। এর পরের ১৫ দিন ইউরিয়ার পরিমাণ ৫ গ্রাম বাড়িয়ে মোট ১০ গ্রাম (বা ২ চা চামচ) একই পরিমাণ চিটাগুড় ও পানির সঙ্গে মিশিয়ে কাটা ঘাস বা খড় দিয়ে খাওয়াতে হবে। পরবর্তী ১৫ দিন একইভাবে ৫ গ্রাম ইউরিয়া অর্থাৎ ১৫ গ্রাম করে একই নিয়মে খাওয়াতে হবে। শেষ ১৫ দিন ২০ গ্রাম ইউরিয়া একই নিয়মে খাওয়াতে হবে। মনে রাখতে হবে এই পদ্ধতিতে কোনোভাবেই ২০ গ্রামের বেশী খাওয়ানো চলবে না।
দানাদার খাদ্য: চাল, গম, ভুষি ইত্যাদি দানা জাতীয় খাবারকে দানাদার খাদ্য বলে। বিভিন্নদানাদার খাবার মিশিয়ে মোটাতাজাকরণের গরুর জন্য আদর্শ খাদ্যটি তৈরী হয়। নীচের তালিকায় দানাদার খাবারের পাঁচ ধরনের মিশ্রণ উল্ল্লেখ করা হলো। এটি সাধারণ স্বাস্থ্যের অধিকারী দুই দাঁতের গরুর যা দৈনিক খাওয়াতে হবে।

খাবার বিভিন্ন নমুনায় খাবার মেশানোর পরিমাণ (গ্রাম) নমুনা-০১ নমুনা-০২ নমুনা-০৩ নমুনা-০৪ নমুনা-০৫
গমের ভূষি ৫৬০ ২৫০ ২৫০ ২৫০ ৪৮০
চালের গুঁড়া
৩০০ ৩০০ ২৪০ ১৫০
খেসারী ভুষি
২০০ ১০০ ১০০ ৫০
চালের খুদ ১০০
গম ভাঙা ১৫০ ১৫০ ১০০ ১০০
তিলের খৈল
১৫০ ১৩৫
নারকেলের খৈল
২০০ ২০০
সরিষার খৈল
১৩৫
শুঁটকি মাছ গুঁড়া
৭৫ ৫০ ৫০ ৪৫ ৫০
লবণ ৯ ৯ ৯ ৯ ৯
ঝিনুক গুঁড়া ৫ ৫ ৫ ৫ ১০
ভিটামিন ও খনিজ
(বাজারে কিনতে পাওয়া যায়)
১ ১ ১ ১ ১
১২০-১৫০ কেজি ওজনের বাছুরের দৈনিক খাদ্যতালিকা: এই ওজনের দুই দাঁতের বাছুরের জন্য নীচের খাদ্যতালিকাটি আদর্শ।
খড় ৩ কেজি
ঘাস ৪ কেজি
গমের ভূষি/চালের কুড়া ০.২৫ কেজি
তিলের খৈল ০.২৫ কেজি
ইউরিয়া ৩০ গ্রাম
লালী গুড় ৩০০ গ্রাম
লবণ ৩০ গ্রাম
হাড়ের গুঁড়া ৩০ গ্রাম

চার দাঁতের দুর্বল গরুর জন্য দানাদার খাদ্য: মোটাতাজাকরণের জন্য দুই দাঁতের বেশী দাঁতওয়ালা গরু যদিও না কেনাই ভাল তবে কেউ যদি এ ধরনের গরু মোটাতাজা করতে চান তবে তিনি নীচের দানাদার দৈনিক খাদ্যতালিকাটি অনুসরণ করতে পারেন।
খড় ২.৫ কেজি
ঘাস ৫.০ কেজি
গম বা চালের ভুষি ০.৫ কেজি
তিলের খৈল ০.৫ কেজি
ইউরিয়া ৮০ গ্রাম
লালী গুড় ৪০০ গ্রাম
লবণ ৩৫ গ্রাম
হাড়ের গুঁড়া ৩৫ গ্রাম

দুর্বল ও হালকা এঁড়ে বাছুরের খাদ্য: দুই দাঁত হওয়ার বয়স হয়নি এ ধরনের বাছুর মোটাতাজাকরণের জন্য নেওয়া উচিত না। সর্ব্বোচ্চ এক বছর বয়স এবং ওজন ৮০ কেজির মধ্যে হলে মোটাতাজাকরণের পক্ষে সেই বাছুরগুলো দুর্বল ও হালকা বলে ধরা হয়। এ ধরনের বাছুর যদি কেউ মোটাতাজা করতে চান তবে তাঁদের নীচের বিশেষ খাদ্যতালিকাটি অনুসরণকরা উচিত
:
খড় ২.৫ কেজি
ঘাস (জার্মান/দল) ৮ কেজি
সয়াবিন গুঁড়া ১৫০ গ্রাম
লবণ ৩৫ গ্রাম

৪.পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
গরুকে প্রতিদিন গোসল করাতে হবে। তারপর তার সারা শরীর ভালভাবে দলাইমলাই করে দিতে হবে।
পাতা 7 মোট 7
৫.পরিশ্রম
মোটাতাজা করা গরুকে বেশী হাঁটা-চলা করানো যাবে না। দীর্ঘ পথ হাঁটিয়ে বাজারে নেওয়া চলবে না।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২৬সেপ্টেম্বর২০