বাংলাদেশ যেভাবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলো

406

মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার প্রথমটিই খাদ্য, আর বাংলাদেশের ৯০ ভাগ লোকের প্রধান খাবার ভাত। আবহমানকাল থেকে বাংলাদেশে খাদ্যশস্য বলতে আমরা ধানকেই বুঝে থাকি। ধানকে এদেশের জাতীয় সমৃদ্ধির প্রতীক বিবেচনা করা হয়। দেশের শিল্প, সাহিত্য, অর্থনীতি কিংবা রাজনীতি-সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় এই খাদ্য নিরাপত্তা দিয়ে। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের এ দেশে সবার খাবারের নিরাপত্তা দেওয়া সহজ কথা নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্যি যে, ষাটের দশকে এদেশে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে পাঁচ কোটির কাছাকাছি কিন্তু অভাব ছিল সীমাহীন। অনেকটা ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ অবস্থা। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে, সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষেরা ক্ষুধা নিবারণের জন্য এক পেয়ালা ভাতের মাড়ের জন্য বিত্তবানদের কাছে ধরনা দিতো। এমনকি স্বাধীনতাত্তোর সময়েও এ অবস্থার ততোটা উন্নতি হয়নি। যা বর্তমান প্রজন্মের কাছে মনে হবে যেন রূপকথার গল্প।

সত্তরের দশকের শুরুতে সদ্য স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় প্রবর্তন করা হলো উফশী জাত আইআর৮। ব্রির বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো উদ্ভাবন করলেন তিন মৌসুমে চাষ উপযোগী উচ্চফলনশীল ধানের আধুনিক জাত বিআর৩, যা বিপ্লব ধান নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়। সত্যিকার অর্থেই এ জাতটি দেশের ধান উৎপাদনে বিপ্লবের সূচনা করে। আইআর৮ ও বিপ্লব এ দুটি উফশী জাত প্রবর্তন ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে মূলত আধুনিক ধান চাষের গোড়াপত্তন হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাঁর ঘোষিত সবুজ বিপ্লব কর্মসূচিও থমকে যায়। আমরা পরিণত হই পরনির্ভরশীল জাতিতে। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকারে এলে বঙ্গবন্ধুর সবুজ বিপ্লবের ধারণা নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। শুরু হয় খাদ্য উৎপাদনে নতুন এক অধ্যায়, সবুজ বিপ্লব পায় নতুন মাত্রা। ১৯৯৯ সালে এসে দেশ প্রথমবারের মতো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে প্রদান করা হয় জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) কর্তৃক মর্যাদাপূর্ণ সেরেস পদক। ২০০৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যখন দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করেন; তখন খাদ্য ঘাটতি ছিলো ২৬ লাখ মেট্রিক টন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উচ্চফলনশীল ধানের জাত ও আনুষঙ্গিক লাগসই চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কৃষক পর্যায়ে এসব প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে ২০১৩ সালে এসে দেশ শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাই অর্জন করেনি, খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হয়। এমনকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত চাল বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। এটি আমাদের জাতীয় জীবনে এক অসামান্য অর্জন। অতীতের তলাবিহীন ঝুড়ি এখন শক্ত ভিত্তির উদ্বৃত্ত খাদ্যের বাংলাদেশ; ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় এবং গড় ফলনের হিসাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম।

করোনা মহামারীর কারণে বিশ্ব যেখানে নিশ্চিত খাদ্য সংকটের পথে; ঠিক তখন বাংলাদেশ সম্পর্কে উল্টো তথ্য দিচ্ছে মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ)। ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরে (২০১৯-২০) দেশে চালের উৎপাদন তিন কোটি ৬০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। বিগত আমন, আউশ ও চলতি বোরোর আশাতীত বাম্পার ফলন হওয়ায় প্রকৃতপক্ষে এ বছর চালের উৎপাদন হবে মোট ৩৮.৫৪ লাখ টন। এতদিন চাল উৎপাদনের তিন নম্বর স্থানটি দখলে ছিল ইন্দোনেশিয়ার। প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে চীন-ভারত থাকলেও তিন নম্বর স্থানটি দখল করে নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

চলতি অর্থবছরে আমন মৌসুমে রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে। আবার গত আউশ মৌসুমেও চালের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বশেষ চলতি বোরো মৌসুমে সাড়ে চার লাখ টন বাড়তে পারে চালের উৎপাদন। তিন মৌসুমে উৎপাদন বৃদ্ধির সম্মিলিত ফলাফলেই শীর্ষ তিনে চলে আসে বাংলাদেশ। বিগত ৪৯ বছরে ব্রি উদ্ভাবিত ১০২টি জাতের প্রতিটিই কোন না কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন, যেমন- খরা, বন্যা, লবণসহিঞ্চু, জিংক সমৃদ্ধ, প্রিমিয়াম কোয়ালিটি, ডায়াবেটিক রাইসসহ অধিক উচ্চফলনশীল।বর্তমানে ব্রি ধানের জাতসমূহ দেশের শতকরা ৮০ ভাগ জমিতে চাষ হচ্ছে এবং এ থেকে পাওয়া যাচ্ছে দেশের মোট ধান উৎপাদনের ৯১ ভাগ। ঘাত সহনশীল ও অনুকূল পরিবেশ উপযোগী জাতগুলোর আবাদ সম্প্রসারণের ফলে ২০১০-১৯ পর্যন্ত ৬.০ লাখ টন হারে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং উৎপাদন বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। অথচ আবাদি জমির পরিমাণ প্রতিবছর কমছে ১ শতাংশ হারে।

প্রাথমিক পর্যায়ে ব্রি’র গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল অল্প জমি থেকে বেশি পরিমাণ ধান উৎপাদন করা। বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানোই ছিল তখনকার মূল লক্ষ্য। বর্তমানে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাহিদা ও রুচিতে পরিবর্তন এসেছে। তাই উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি সরু-সুগন্ধি এবং রপ্তানির উপযোগী প্রিমিয়াম কোয়ালিটির জাত উদ্ভাবনে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ব্রি। স্থানীয় জাতের পরিবর্তে ব্রি নিয়ে এসেছে উচ্চফলনশীল সুগন্ধি ধানের জাত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ হচ্ছে সরু-সুগন্ধি ধান। কারণ এই ধান চাষে সমান শ্রমে বেশি লাভ, রয়েছে দেশ-বিদেশে ব্যাপক চাহিদা। ভিটামিন এ সমৃদ্ধ ধান, রক্তশূন্যতা ও ডায়রিয়া রোগীদের বিশেষ উপকারী জিংক সমৃদ্ধ অবমুক্ত করার ফলে দেশের অন্নদাতা প্রতিষ্ঠান ব্রি এখন বিশ্বব্যাপি পুষ্টিদাতা প্রতিষ্ঠান হিসাবেও পরিচিতি পাচ্ছে।

উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রি উদ্ভাবিত উফশী ধানের প্রসার না হলে খাদ্য কিনতে বাংলাদেশকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হতো। অভ্যন্তরীণ আয়ের বেশিরভাগ অংশ ব্যয় হতো খাদ্য আমদানিতে। আধুনিক ধানের জাত ও চাষাবাদ পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। ফলে অভ্যন্তরীণ আয় থেকেই পদ্মাসেতু, মেট্রোরেলের মতো বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারছে বাংলাদেশ। দেশের সাম্প্রতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন তুলে ধরে বহুল প্রচারিত পত্রিকা হংকং পোস্ট এক প্রবন্ধে লিখেছে, ‘রাইজ অ্যান্ড রাইজ অব বাংলাদেশ’ কিন্তু আমরা বলি, ‘রাইস ইজ দ্য রাইজ অব বাংলাদেশ’।

লেখক:কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন
ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট।

ফার্মসএন্ডফার্মার/২০জুন২০