বিষমুক্ত আম পেতে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি

347

ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি কিঃ

ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি বলতে ফল গাছে থাকা অবস্থায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে বা বয়সে বিশেষ ধরনের ব্যাগ দ্বারা ফলকে আবৃত করাকে বুঝায়। ব্যাগিং করার পর থেকে ফল সংগ্রহ করা পর্যন্ত ব্যাগটি গাছেই ফলের সাথে লাগানো থাকে। তবে এই ব্যাগ বিভিন্ন ফলের জন্য বিভিন্ন রং এবং আকারের হয়ে থাকে।
আমের জন্য দুই ধরনের ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। রঙিন আমের জন্য সাদা ব্যাগ আর অন্যান্য জাতের জন্য বাদামি রং এর ব্যাগ ব্যবহার করা হয়।

ফ্রুট ব্যাগিং এর প্রয়োজনীয়তাঃ

আমের কাঙ্খিত ফলন নিশ্চিত করার জন্য বর্তমানে বালাইনাশকের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত স্প্রে যেমন জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর তেমনি আমের উৎপাদন ব্যয়ও বেশি। এই অবস্থায় আমে ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে বালাইনাশকের ব্যবহার ও খরচ অনেকাংশেই কমানো সম্ভব হবে।

সঠিক সময়ে ও সঠিক পদ্ধতি মেনে ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করলে নিম্নোক্ত সুবিধা সমূহ পাওয়া যায় যেমনঃ

আমের মাছি পোকার আক্রমণ ১০০% দমন হয় এবং সঠিক সময়ে ব্যাগিং করলে ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনও সম্ভব।
আমের গায়ে কালো দাগ পড়ে না।
আমের রঙ খুবই উজ্জ্বল হয়, ফলে ক্রেতা আকৃষ্ট হয়।
ব্যাগিং করার কারণে বালাইনাশকের ব্যবহার শতকরা ৭০-৮০ ভাগ কমে যায়।
আম পাড়ার সময় নির্গত কষ থেকে ফলকে রক্ষা করে।
আমের সংগ্রহোত্তর সংরক্ষণকাল বাড়ানো যায়।
আমকে বাইরের বিভিন্ন ধরনের আঘাত, ফল ফেটে যাওয়া, কাঠবিড়ালী, বাদুর, পাখির আক্রমণ, প্রখর সূর্যালোক হতে রক্ষা করা যায়।
ব্যাগিং করা আমের গুনগত মান বজায় থাকে এবং স্বাদেও তেমন তারতম্য হয় না।
সর্বোপরি, ব্যাগিং করা আম বিষমুক্ত, নিরাপদ রোগ ও পোকামুক্ত এবং আকর্ষণীয় রঙের হওয়ায় বাজার মূল্য অধিক পাওয়া যায়।

ব্যাগিং করার উপযুক্ত সময় ও পদ্ধতিঃ
সকল জাতের আমের জন্য ব্যাগিং করার সময় এক নয়।
যেমন বারি আম-১, বারি আম-২, বারি আম-৬, বারি আম-৭, খিরসাপাত এবং ল্যাংড়া জাতের আমে ব্যাগিং করা হয় ৪০-৪৫ দিন বয়সের গুটিতে।
আমের অন্যান্য জাতগুলি যেমন বারি আম-৩, বারি আম-৪, বারি আম-৮, ফজলি ও আশ্বিনা জাতে ব্যাগিং করা হয় গুটির বয়স ৬০-৬৫ দিন হলে।

আমের প্রাকৃতিক ঝরা বন্ধ হলে এবং ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ শুরু হওয়ার পূর্বেই ব্যাগিং করতে হবে।

ব্যাগিং করার পূর্বে অবশ্যই কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক নির্দেশিত মাত্রায় ভালভাবে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। আম গাছে মুকুল আসার আনুমানিক ১৫-২০ দিন পূর্বে প্রথমবার, আমের মুকুল ১০-১৫ সেমি লম্বা হলে দ্বিতীয়বার এবং আম যখন মটর দানার মত হবে তখন তৃতীয়বার স্প্রে করতে হবে।

ফ্রুট ব্যাগিং করার নিয়মকানুনঃ

ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভালো ফলাফল পাওয়ার জন্য কিছু নিয়ম অবশ্যই মেনে চলা জরুরী যেমনঃ

নির্দিষ্ট বয়সের এবং আকারের দাগমুক্ত আমে ব্যাগিং করতে হবে। একটি পুষ্মমঞ্জুরীতে অনেকগুলো আম থাকলে প্রথমেই ফল পাতলা করতে হবে।

এরপর সবচেয়ে ভালো, দাগমুক্ত একটি অথবা দুটি আমে ব্যাগিং করতে হবে। তবে বড় জাতের আমের ক্ষেত্রে প্রতি পুষ্মমঞ্জুরীতে একটির বেশি ফল রাখা উচিত নয়। বোঁটায় মরা ও শুকনা আম, উপপত্র, মুকুলের অংশবিশেষ লেগে থাকলে তা পরিষ্কার করে ব্যাগিং করতে হবে।

ব্যাগিং করার পূর্বে শুধু আমকে একটি কীটনাশক ও একটি ছত্রাকনাশক একত্রে মিশিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। এরপর আমগুলো শুকালে ব্যাগিং আরম্ভ করতে হবে। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে ব্যাগিং করা উত্তম।

ব্যাগের উপরের অংশ দুই পার্শ্ব হতে ভাঁজ করতে করতে মাঝ বরাবর আসতে হবে। এরপর সংযুক্ত তার দ্বারা ভালোভাবে মুড়িয়ে দিতে হবে যেন কোন অবস্থাতেই পানি, পিঁপড়া, মিলিবাগ ইত্যাদি প্রবেশ করতে না পারে।

রঙিন আমের জন্য একস্তর যুক্ত সাদা ব্যাগ এবং অন্য যে কোন জাতের জন্য বাদামি রঙের ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, দুই স্তর যুক্ত বাদামি রঙের ব্যাগ যে কোন আমকে রঙিন করতে পারে অর্থাৎ হলুদ করতে পারে। আর এই রঙ পরিবর্তনে সময় লাগে ৩৫-৪৫ দিন।

অপেক্ষাকৃত খাটো ও মাঝারী উচ্চতা সম্পন্ন গাছে ব্যাগিং করা ভালো। তবে গাছ বড় বা লম্বা হলে মই ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে মানুষের গড় উচ্চতা ও মইয়ের উচ্চতা সহ আনুমানিক ১৪ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন আম গাছে ব্যাগিং করা যায়। তবে একটি গাছের সব আম ব্যাগিং করতে হবে এমন কোন কথা নেই। পাহাড়ী ঢালু জায়গায় অধিক উচ্চতা সম্পন্ন গাছে ব্যাগিং এর চেষ্টা না করাই ভালো।

অপেক্ষাকৃত বড় সাইজের আম যেমন বারি আম-৪, মল্লিকা ও আশ্বিনা আমে ব্যাগিং করলে লাভের হার বেশী। তবে ছোট বা মাঝারি আকারের আমের ক্ষেত্রে একটি ব্যাগে দুটো আম ব্যাগিং করা যেতে পারে। শুধু মাছি পোকা দমনের জন্য বাদামি রঙের ব্যাগ পর পর দু’বছর ব্যবহার করা যাবে।

পলিথিন ব্যাগ দিয়ে ব্যাগিং করলে ব্যাগের নিচের দিকে বা দু’পাশে কৌণিকভাবে কেটে দিতে হয়।

ব্যাগিং প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত আম খাওয়ার নিয়মঃ
ব্যাগিং করা উৎপাদিত আম গাছ থেকে সংগ্রহ করার সাথে সাথে খাওয়া যাবে না। সংগ্রহের সাথে সাথে বা ২/১ দিনের মধ্যে খেলে কম মিষ্টি লাগবে। এই আমগুলো যতবেশি ঘরে রেখে খাওয়া যাবে ততই মিষ্টতা বাড়বে। সাধারণভাবে দেখা গেছে যে, জাতভেদে ব্যাগিংয়ের আম সংগ্রহের ৬-৭ দিন পর ভালোভাবে নরম হয় এবং খেতে সুস্বাদু হয়। কোন অবস্থাতেই শুধুমাত্র রঙ বিবেচনা করে আম কাটা ঠিক হবে না। জাতভেদে আমগুলো ৯-১৪ দিন পর্যন্ত ঘরে রেখে খাওয়া যাবে।

তথ্য সূত্র: ড. মোঃ শরফ উদ্দিন ও ড. মোঃ হামিম রেজা, আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট।

ফার্মসএন্ডফার্মার/ ০৫ মে ২০২১